EXCLUSIVE Mother Teresa Film: ‘অনীক দত্ত আমাকে গালে দু’টো চড় মারলেও মাথা পেতে গ্রহণ করব’, বললেন অভিনেত্রী তপতী মুন্সি
Tapati Munshi: কিছুদিন আগে TV9 বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে একটি স্টিল ফটোগ্রাফ শেয়ার করেছিলেন। ছবির চিত্ররূপ—মাদার টেরেসার মতো নীল পাড় সাদা শাড়িতে এক বিদেশিনী আলিঙ্গন করে আগলে রেখেছেন একজন ভিখারিণীকে।
স্নেহা সেনগুপ্ত
মায়ের মতো মুখটা। বাংলা থিয়েটারের অত্যন্ত পরিচিত অভিনেত্রী। সিরিয়ালের পর্দাতেও তাঁকে দেখে থাকবেন। সিনেমায় নিয়ত যাতায়াত। একমাত্র পুত্রকে হারানোর পর জীবনটা ছারখার হয়ে গিয়েছিল প্রবীণা অভিনেত্রী তপতী মুন্সির। তারপরই অভিনয়ে আসা—৫০ বছর বয়সে এসে।’ ‘সমীক্ষণ’ থিয়েটারের দল গঠন যদিও করেছিলেন আগেই। একমাত্র সন্তান বিয়োগের পর স্বামী ও নাট্যব্যক্তিত্ব পঙ্কজ মুন্সি অভিনয় শিখিয়েছিলেন তপতীকে। মানসিক ও শারীরিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য থিয়েটার কাজ করেছিল থেরাপির মতো। তারপর থেকে অভিনয়, মঞ্চ এবং শুটিং ফ্লোরই তপতীদেবীকে বেঁচে থাকার রসদ জুগিয়ে চলেছে। দিন কয়েক আগেই রাজস্থানে একটি বাংলা ছবির শুটিং করছিলেন।
ফেসবুকে খুব ‘অ্যাকটিভ’ বছর ৭৩-এর তপতীদেবী। অনুজদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন ঝরে পড়ে নরম আদর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে ভালবাসেন। অমায়িক ব্যবহার। কট্টর বামমনস্ক। কিছুদিন আগে TV9 বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে একটি স্টিল ফটোগ্রাফ শেয়ার করেছিলেন। ছবির চিত্ররূপ—মাদার টেরেসার মতো নীল পাড় সাদা শাড়িতে এক বিদেশিনী আলিঙ্গন করে আগলে রেখেছেন একজন ভিখারিণীকে। ছবি দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না ভিখারিণী আসলে তপতী। আরও বিস্তারে প্রশ্ন করায় জানা গেল সুইৎজ়ারল্যান্ড-নিবাসী ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা কমল মুসালের ছবি ‘কবিতা অ্যান্ড টেরেসা’ ছবির একটি শট সেটি। যে কমল মুসালে ‘কারি ওয়েস্টার্ন’, ‘মিলিয়ান্স ক্যান ওয়াক’, ‘বাম্বাই বার্ড’-এর মতো ছবি তৈরি করেছেন।
টানা ৫ বছর গবেষণার পর মাদার টেরেসাকে নিয়ে এই ছবি তৈরি করেছেন মুসালে। মাদারকে নিয়ে বলার অনেক কথাই রয়েছে। সবটা একত্রিত করতে সময় ব্যয় হয়েছে বিস্তর। চলতি অগস্টের ২৬ তারিখ ১১২ বছরের জন্মবার্ষিকী নোবেলজয়ী মাদারের। ছবিতে অভিনয় করেছেন মুম্বই ও বিদেশের গুণী শিল্পীরা। যেমন দীপ্তি নাভাল, ‘অক্টোবর’খ্যাত অভিনেত্রী বনিতা সান্ধু, বিক্রম কোচার, কেজ়িয়া বুরোজ়, অতুল শর্মা, লিজ়া সাদোভি এবং বাংলার তপতী মুন্সি।
কেরিয়ারে এখনও পর্যন্ত ৩০-৪০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন তপতী। প্রথম ছবি ছিল আশিস মিত্রর পরিচালনায় ‘আমরা পাঁচ’। ছবি মুক্তির পর ১৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। শুরুর দিকে বেশির ভাগটাই সিরিয়ালে অভিনয় করতেন। সিনেমায় কাজ করতে শুরু করলেন যখন, সিরিয়ালে আর সময় দিতে পারতেন না। মুসালের ছবিতে অভিনয়ের জন্য কলকাতার এক কো-অর্ডিনেটর তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। লুক সেটের জন্য ডাকেন পরিচালক। তপতী বলেছেন, ‘‘স্ট্রিট বেগারের (পড়ুন ভিখারিণী) চরিত্র। বুঝতেই পারছেন মোটাসোটা গোলগাল হলে চলবে না। আমাকে তো ভিখারিণীর মতোই দেখতে। সেই কারণেই আমাকে ডাকা হয়।’’ কথাটা বলতে-বলতে একপ্রকার হেসেই ফেলেন তপতী।
হাসতে-হাসতে বলে চললেন তপতী, ‘‘আমার লুক সেট হওয়ার পর বিপাকে পড়লাম। আমি তো ওঁদের ভাষাই বুঝতে পারছিলাম না। সুইৎজ়ারল্যান্ডের ইংরেজি বোঝার সাধ্যি কি আমার আছে?’’ লুক সেটে তপতীকে দারুণ পছন্দ হয় মুসালের। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে ছবিতে কাস্ট করেন তিনি। শুটিংয়ের ডেট স্থির হয়। মানিকতলার বসিন্দা তপতীর অসুবিধা হয়নি শুটিংয়ে। বাড়ি থেকে হাঁটা পথ। রাস্তাতেই শুটিং হত। শোভাবাজারে পিছনে ‘রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতাল’। সেখানেও কিছু দৃশ্যের শুটিং হয়। সেটে সম্মান পেয়েছেন প্রচুর। ছবিতে ভিখারিণীর চরিত্রটি বিশাল বড় নয়—খুবই ছোট। মাদার তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় রাস্তা থেকে তুলে এনে চিকিৎসা করান। কিন্তু শেষমেশ চরিত্রটির মৃত্যু হয়। অল্প সময়ের চরিত্রের জন্যও মেকআপ-ভ্যানে আলাদা করে নাম লেখা থাকত তপতীর। খাতির-যত্নের ক্রটি ছিল না। একপ্রকার বিস্মিতই ছিলেন প্রবীণা শিল্পী। কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠে তৃপ্তি ফুটে ওঠে। বলেন, ‘‘৪-৫ দিন শুটিং করেছি এই টিমের সঙ্গে। জানেন, ছবিতে আমার কোনও সংলাপও নেই। কিন্তু একটা বিষয় দেখে ভাল লাগল, ছোট চরিত্র হোক কিংবা বড়, শিল্পীদের সমাদর করতে জানাটাও একটা শিল্প। আমি খুবই ভাগ্যবতী এই টিমের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। বিদেশের মাটিতে বেড়ে উঠেছেন মুসালে। যে মাটিতে মাথায় তুলে রাখা হয় শিল্পীদের। এদেশের কাউকে ছোট না করেই বলছি, বিদেশের শিষ্টাচার যেহেতু অন্যরকম, আমাকে সেই সমাদরই ওঁরা দিয়েছেন। আমি একবারের জন্যেও সেটে দাঁড়িয়ে থাকিনি। সঙ্গে-সঙ্গে আমার জন্য চেয়ার চলে আসত।’’
এই একই ধরনের সমাদর একজন প্রবীণা শিল্পী হিসেবে বাংলা ছবিতে সবসময় পাননি তপতী। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে মন আহত হয়েছে তাঁর। বলেছেন, ‘‘আমার বলতে বাধা নেই। সেই সম্মান এখানে পাই না। কিন্তু আমি ভালটাই বলব। সম্প্রতি হরনাথ চক্রবর্তীর ছবিতে অভিনয় করলাম। সেখানে কিন্তু এই একই সমাদর পেয়েছি। অনেকেই জানেন, হরনাথের নেচার খুব নরম। অনীক দত্তর সঙ্গে কাজ করেও আমার ভাল লেগেছে। তিনি বামপন্থী। তিনি যদি আমাকে গালে দু’টো চড়ও মারেন, মাথা পেতে গ্রহণ করব। তিনি রাগী। প্রযোজকের একটা পয়সাও অপচয় করেন না। তবে শিল্পীদের খুব সম্মান করেন। খিটখিটে হলেও লোকটা ভাল। ওঁর সঙ্গে আমি কাজ করেছি ‘মেঘনাদবধ রহস্য’-এ। বেণুদা (সব্যসাচী চক্রবর্তী) ও গার্গীর (গার্গী রায়চৌধুরী) বাড়ির পরিচারিকা হয়েছিলাম। তারপরের ছবি ‘বরুণবাবুর বন্ধু’তেও সৌমিত্রদার গ্রামতুতো বোন হয়েছিলাম। অনীকদা বলেছিলেন, আমার উচ্চারণ অভিজাত। আমাকে ভাঙতে বলেছিলেন বাচনভঙ্গি। সেটা করেছিলাম বলে প্রশংসা পেয়েছি। সেটে সৌমিত্রদারও খুব স্নেহ পেয়েছি।’’
তবে বারবারই ‘কাজের লোক’ কিংবা ভিখারিণীর চরিত্রের অফার পেয়ে একপ্রকার ক্লান্ত তপতী। যদিও তিনি বিষয়টিকে চরিত্রের আঙ্গিকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। মনে করেন, একাধিকবার একই ধাঁচের চরিত্রে অভিনয় করলে, সেই চরিত্রই আসতে থাকে বারবার। বলেছেন, ‘‘এখানে যদি কেউ বিধবার চরিত্রে অভিনয় করেন, তিনি স্ট্যাম্পমারা বিধবা হয়ে যান। কাজের লোকের ক্ষেত্রেও তা-ই। নিভাননীদেবীর সময় থেকেই এটা হয়ে আসছে। এটা আমাদের ইন্ডাস্ট্রির ধারা। এই ধারা থেকে বেরনো খুবই কঠিন বিষয়। দেবের ‘কিশমিশ’-এ অভিনয় করলাম। সেখানেও তো আমাকে কাজের লোকের চরিত্রই দেওয়া হল। আমার প্রশ্ন, কাজের লোক আর বিধবা বুড়ি ছাড়া আমার ব্যাপারে আর কি কিছুই তোমাদের চোখে পড়ে না?’’
আশঙ্কার কথা জাহির করে তপতী এ-ও জানিয়েছেন, এই স্টিরিওটাইপ, একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে তাঁকে অভিনয় ছেড়ে দিতে হবে। অনেক ছবির অফারও তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। শর্ট ফিল্মে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দেশের প্রায় সবক’টি ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছবিতে কাজ করেছেন। বলেছেন, ‘‘শর্ট ফিল্ম অনেক বেশি ডায়নামিক… ছোট গল্প… শক্তিশালী…’’