Exclusive Mita Chattopadhyay: নাক কেটে দেওয়া হবে বলে নমিতা থেকে ‘ন’ বাদ পড়ল, ‘জন্মভূমি’র ‘পিসিমা’ মিতা চট্টোপাধ্যায় আর কী বললেন…?
‘পিসিমা’ থেকে সক্কলের ‘দিদা’ হয়ে ওঠা এই অভিনেত্রীর খোঁজ নিল TV9 বাংলা। প্রাণ খোলা হাসিতে আপন করে নিতে পারেন মাত্র ৫ মিনিট আগে আলাপ হওয়া কোনও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকেও। অকপটে বলতে পারেন, “ম্যাডাম নয়, আমাকে ‘দিদা’ বলে ডাকবে, কেমন...!”
স্নেহা সেনগুপ্ত
দূরদর্শনে সম্প্রচারিত ‘জন্মভূমি’ ধারাবাহিকের পিসিমাকে মনে আছে? ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত, ১৩০০টি এপিসোড অতিক্রম-করা বাংলা টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় ধারাবাহিকের দাপুটে পিসিমা তিনি— অভিনেত্রী মিতা চট্টোপাধ্যায়। এখন তাঁর বয়স ‘মাত্র’ ৯০ বছর (‘মাত্র’ শব্দটা উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে রাখার কারণ অভিনেত্রী স্বয়ং এরকমটাই মনে করেন)। আসন্ন অগস্টের ২১ তারিখ ৯১-এ পা দেবেন তিনি। তবে ৯০-এর কুঁচকে যাওয়া চামড়া তাঁর অন্তরের তরুণীকে হারাতে পারেনি এখনও। এখনও অরিজিৎ সিং অথবা রূপম ইসলামকে স্টেজে গাইতে দেখলে দর্শক আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েন (সম্প্রতি TV9 বাংলা ঘরের বায়োস্কোপ Awards 2023-তে দেখা গিয়েছে এমনই দৃশ্য)। কোমর দুলিয়ে নেচে উঠেছেন তিনি। তাঁকে হঠাৎ দেখতে পেলে অনুজ সহকর্মীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। করোনা-হানার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি ‘জন্মভূমি’র ‘পিসিমা’ মিতাদেবী। এখন নিত্যসঙ্গী তাই কলম আর খাতা। খসখস করে লিখেই চলেন অনেক কিছু। ১৭৫টি স্কুলের পাঠ্য়পুস্তকে তাঁর রচিত বিজ্ঞানভিত্তিক ছড়া। পূজা-আর্চায় মন খুব। প্রাণ খোলা হাসিতে আপন করে নিতে পারেন মাত্র ৫ মিনিট আগে আলাপ হওয়া কোনও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকেও। অকপটে বলতে পারেন, “ম্যাডাম নয়, আমাকে ‘দিদা’ বলে ডাকবে, কেমন…!”
‘পিসিমা’ থেকে সক্কলের ‘দিদা’ হয়ে ওঠা এই অভিনেত্রীর খোঁজ নিল TV9 বাংলা। ফোনের ওপার থেকে মিতাদেবী বললেন, “আমার বয়স ৯০। আমি যে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছি, বলবেন না প্লিজ়। তাতে আমার প্রেসটিজ চলে যাবে।”
প্রশ্ন: আপনার আসল নাম তো মিতা নয়, তাই না?
মিতা: একেবারেই নয়। আমি আসলে নমিতা চট্টোপাধ্যায়। অভিনয় করতে এসে নাম পাল্টে যায়। সেটা একটা কাহিনি বটে।
প্রশ্ন: সেই কাহিনি একটু শুনি…
মিতা: খাতায়-কলমে নমিতা চট্টোপাধ্যায় নামটাই আছে এখনও। মিতা হলাম হিরোইন হয়ে। নাম দিলেন অনুপ কুমার। যে ছবিতে প্রথম হিরোইন হলাম, সেই ছবিতে চারজন নমিতা নামের অভিনেত্রী ছিলেন। অনুপদার সঙ্গে ছোটবেলায় পার্ট করেছি। শিশুশিল্প ছিলাম। সেই থেকে আমাদের দাদা-বোনের সম্পর্ক ছিল। তিনিই বললেন, নমিতার তো নাকটা বেশ টিকটিকে। নাকটা কেটে দিলেই তো হয়। ব্যস, নমিতা থেকে ‘ন’ বাদ পড়ল। আমি হয়ে গেলাম ‘হিরোইন’ মিতা।
প্রশ্ন: টলিপাড়ার বহু আলোচ্য বিষয়: চট্টোপাধ্যায়দের জিনেই নাকি অভিনয়। সকল অভিনেতা-অভিনেত্রীই প্রায় চট্টোপাধ্যায়…
মিতা: এই তো, আড্ডা জমানোর একটা ভাল ক্লু পেলাম। টলিপাড়ার প্রতিষ্ঠিত অভিনেতারাই চট্টোপাধ্যায় এবং সকলেই ঘটি। উত্তম-সৌমিত্র থেকে শুরু করে আজকের আবীর-পরমও চট্টোপাধ্য়ায়। আরও মজার ব্যাপার, কোনও না-কোনওভাবে চট্টোপাধ্যায় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা লতায়-পাতায় আত্মীয়। উত্তমকুমারের বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়ির যোগাযোগ ছিল ভালই। আমার বাবা ফণিভূষণ চট্টোপাধ্যায় যাওয়া-আসা করতেন ওঁদের বাড়িতে। গান-বাজনার চর্চাও ছিল খুব। বাবা ওঁদের সঙ্গে যাত্রা করেছিলেন। সেই সূত্রে আমিও যেতাম। ধীরে-ধীরে ওঁদের বাড়ির মেয়ে হয়ে উঠলাম। খুঁজলে হয়তো খুব দূরের কোনও আত্মীয়ও হব আমরা।
প্রশ্ন: উত্তমকুমারের বাড়ির সঙ্গে এত মেলামেশা কি আপনাকে বাড়তি সুবিধে করে দিয়েছিল কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে?
মিতা: বাড়তি সুবিধে বলতে! উত্তমকুমার তো আমার পরে স্টার হয়েছেন। আমি যখন নাচে প্রতিষ্ঠিত, তখন অরুণকুমার উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি।
প্রশ্ন: আচ্ছা, সেই সময় উত্তমকুমারকে ‘ফ্লপ মাস্টার’ও বলা হত…
মিতা: ওইভাবে বলবেন না প্লিজ়। শুনলে ভারী কষ্ট লাগে।
প্রশ্ন: শুরুতে তো তাঁকে তাই-ই বলা হত!
মিতা: সেটা তো তিনিও অস্বীকার করেননি। তারপর তিনি দাঁতে-দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছেন। আমার একটা লেখাও বেরবে ওঁর জীবনী নিয়ে।
প্রশ্ন: তাই আপনি লিখেছেন?
মিতা: পাণ্ডুলিপি নিয়ে যাবে ছাপানোর জন্য।
প্রশ্ন: বেশ ভাল বিষয় কিন্তু…
মিতা: প্রসেনজিতের মা আর আমার মা বাপের বাড়ির তরফের আত্মীয়। বিশ্বজিতের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। এগুলো যোগসূত্র হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে আদান-প্রদান, যাওয়া-আসা লেগেই ছিল। তবে কেউ কারও প্রেমিক ছিলাম না। প্রেম তাঁরা অন্য লোকের সঙ্গে করেছেন (হাসি)।
প্রশ্ন: ৯০-এ নড়বড়ে হয়ে যাওয়াকে কাউকে বলতে বারণ করেছেন কেন?
মিতা: প্রেসটিজ চলে যাবে। আমি সেটা চাই না। বয়সটাকে বাগে এনে প্রাণ খুলে জীবনের স্বাদ নেওয়াই আসল বলে মনে করি। চিরকাল সেটাই মনে করে এসেছি।
প্রশ্ন: সে তো আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। আপনি এভারগ্রিন মানুষ। এখনও মনটা আপনার চিরসবুজ। কিন্তু অনেকেই তো বার্ধক্যে একা হয়ে যান। আপনি কি একাকিত্বে ভোগেন?
মিতা: কোনওদিনই নিজেকে একা ভাবিনি কিংবা একাকিত্বে ভুগিনি। আমি এখনও সংসারের মধ্য়ে আছি।
প্রশ্ন: কিন্তু সংসারের মধ্যে থেকেও তো অনেকে একা হয়ে যান…
মিতা: আসলে একা হয়ে যাওয়ার মানসিকতা আমার মধ্যে নেই। আপনারা আছেন। আপনাদের সঙ্গে গল্প করি প্রাণ খুলে। এখন যেমন এই আড্ডাটা জমে উঠেছে।
প্রশ্ন: আপনি সেলেব্রিটি। তাই কি একাকী নন?
মিতা: হ্যাঁ। সেটাও একটা কারণ বলে মনে হয়। যদি আমি একাকী হতাম, তা হলে এত জোরে, এত মজা করে কথা বলতে পারতাম না। এত জোরে হাসতে পারতাম না। এত সহজভাবে আপনাদের মতো অনুজদের ‘নাতি-নাতনি’ বলে গ্রহণও করতে পারতাম না।
প্রশ্ন: ‘জন্মভূমি’র আইকনিক ‘পিসিমা’ থেকে শুরু করে অনেক-অনেক চরিত্র। নাটকের মঞ্চে শিশিরকুমার ভাদুড়ির মতো কিংবদন্তির সঙ্গে পার্ট করেছেন। তা-ও একটা প্রশ্ন করতে মন চাইছে। আপনি খুশি? মনের মতো চরিত্র পেয়েছিলেন? নাকি অধরা কিছু রয়ে গিয়েছে?
মিতা: সিনেমায় সেরকম ভাল চরিত্র আমার জন্য থাকেনি। যদি থাকত, তা হলে ছবির জগতেও আমার অনেক বেশি খ্যাতি আর প্রতিষ্ঠা হত।
প্রশ্ন: সেটা হল না কেন?
মিতা: সুযোগ আসেনি। কিন্তু যতটুকু পেয়েছি, ততটুকু জায়গা করে নিয়েছি এবং সেই জন্য আমি পুরস্কারও পেয়েছি। যেমন ধরুন, ‘এক টুকরো আগুন’। কিছুই নেই, কেবল এক টুকরো গান আছে। দু’টো সিন আছে। সেখানে ঈশ্বর আমাকে দিয়ে এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করালেন যে, পুরস্কার পেলাম। এর কারণই হল, ভাল চরিত্র। এবং ভাল চরিত্র পেতে হবে। যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে সুপ্রিয়াদেবীর অসাধারণ অভিনয়। তাঁর স্কুলিংও ছিল সেই রকমই। আজও সকলে মনে রেখেছেন তাঁর ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’ সংলাপ। এমন একটি কথা তো সব মানুষই বলতে পারে। কিন্তু তাঁর মতো করে বলতে পারাই হল বড় কথা। এবং তাঁকে দিয়ে সেই চরিত্রটির মধ্য়ে দিয়ে বলাতে পারাটাও বড় কথা। এই ধরনের জিনিসগুলি দরকার। একটু সুযোগ যদি না পাই, তা হলে কেমন করে সম্ভব। তবে যতটুকু সুযোগ পাই, তাতে ছাপ রাখতে চেষ্টা করি।
প্রশ্ন: সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়দের অভিনীত চরিত্রগুলি কি কখনও আপনার কাছে এসেও পাশ কাটিয়ে কাছে চলে গিয়েছিল তাঁদের কাছে?
মিতা: না, এমনটা হয়নি। তেমন হলে আমাকে ভাবতে হত না। এই কথার পিঠই একটা কথা বলি। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে উত্তম-সুচিত্রা দু’জনেই অভিনয় করেছিলেন। এই ছবি হওয়ার অন্তত চার-পাঁচ বছর আগে আমি রিনা ব্রাউনের (‘সপ্তপদী’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের চরিত্র) চরিত্রে মঞ্চে অভিনয় করেছিলাম এক অ্যামেচার গ্রুপের হয়ে। শুধু অভিনয় করেছিলাম, তাই-ই নয়। অভিনয় করে সমাদৃতও হয়েছিলাম। যে কারণে তখন কাগজে এক বিদেশি অভিনেত্রীর সঙ্গে আমার তুলনাও হয়েছিল। ৬০-এর দশকের যদি কেউ এখন জীবিত থাকেন, হয়তো নাটকটি সম্পর্কে বলতে পারবেন। বাংলার নাট্যমঞ্চে সেই নাটক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
প্রশ্ন: আপনাদের সময় অভিনয় জগতে কতখানি রাজনীতি ছিল?
মিতা: রাজনীতি কোথায় নেই? বাড়িতে নেই? রাজনীতি সর্বত্র। কিন্তু আমি কোনও দলেই ছিলাম না।
প্রশ্ন: মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?
মিতা: খুব ভাল। দেখলে প্রণাম করেন। ওঁর হাত থেকে টেলি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির আর সকলে কেমন যোগাযোগ রেখেছেন আপনার সঙ্গে?
মিতা: দারুণ ভাল। সেটা যে কেমন ভাল, তা তো আপনাদের TV9 বাংলার অ্য়াওয়ার্ড শো ‘ঘরের বায়োস্কোপ’-এই দেখলেন।
প্রশ্ন: সকলেই হইহই করে উঠেছিলেন…
মিতা: আসলে সকলে আমাকে ভালবাসেন। আমি কারও খারাপ চাই না। কারও অনিষ্ট করতে চাই না। দরকার পড়লে আমার মতো করে আমি তাঁদের সাহায্য করি। তাঁদের ভালবাসি। এই আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, ভালবাসা, মায়া… এগুলো তো ফেলার নয়।
প্রশ্ন: বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা হওয়ার কারণে হর্স রাইডিং থেকে শুরু করে নাচ, সুইমিং অনেক কিছুই শিখেছিলেন… সবটা কাজে লাগাতে পারলেন?
মিতা: সবটাই কাজে লেগেছিল—পর্দায় এবং মঞ্চে। সবটা শিখেই অভিনয় করতে এসেছিলাম। আমি কিন্তু খুব ভাল গয়নাবড়িও বানাতে পারি। এটা আমার একটা দিক। আমি সকলের দিদা।