মেরে উত্তমের নাক ফাটিয়ে দেন, জানেন কে সেই ব্যক্তি?
কুস্তি আয়ত্ত করার পরে আবার ভোম্বলদার সান্নিধ্যে তিনি লাঠি খেলার কৌশলও রপ্ত করেছিলেন। ব্যায়াম ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী, এছাড়াও ফুটবল, ভলি, ক্রিকেট– কোনও কিছুই বাদ যেত না তাঁর আগ্রহের তালিকা থেকে।

উত্তম কুমার, বাঙালির কাছে ম্যাটিনি আইডল। বড়পর্দায় তাঁকে দেখে বহু হৃদয়ে কম্পন ধরে। উত্তম কুমার ছোট থেকেই ছিলেন সব বিষয়ে পারদর্শী। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর বন্ধুত্বের জন্যেও প্রসিদ্ধ ছিলেন সিনে মহলে। এমনই অনেক ঘটনা মাঝে মধ্যেই উঠে আসে আলোচনায়। কখনও সেই সময়ের মানুষের মুখে-মুখে, আবার কখনও উঠে আসে পুরানো দিনের নানা পত্রিকার পাতায়। এমনই এক ঘটনা একবার উঠে আসে তথ্য কেন্দ্র পত্রিকায়। যেখান থেকে উত্তম কুমার ও ডান্স মাস্টার বব দাসের বন্ধুত্বের এক অন্য কাহিনি জানা যায়।
কী সেই গল্প?
কিশোর অরুণ কুমার ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। শিল্প-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে শরীরচর্চার এমন কোনও দিক ছিল না যেখানে তাঁর আগ্রহ ছিল না। ছবি আঁকতেন, কবিতা, গল্প লিখতেন। সাঁতারের পাশাপাশি কুস্তি খেলাতে ছিল তাঁর সমান দখল। প্রতিদিন প্রভাতে ইন্দিরা সিনেমা হলের পিছন দিকে প্রখ্যাত ননীবাবুর আখড়ায় তিনি নিয়মিত কুস্তিচর্চা করতেন। কুস্তি আয়ত্ত করার পরে আবার ভোম্বলদার সান্নিধ্যে তিনি লাঠি খেলার কৌশলও রপ্ত করেছিলেন। ব্যায়াম ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী, এছাড়াও ফুটবল, ভলি, ক্রিকেট– কোনও কিছুই বাদ যেত না তাঁর আগ্রহের তালিকা থেকে।
সেই তরুণ বয়সেই অরুণ হাজির হয়েছিলেন ভবানী প্রসাদ দাসের আখড়ায়, বক্সিংয়ের কলাকৌশল শিখতে। বিদ্যালয়ের খাতায় তাঁর পরিচিতি ছিল ভবানী প্রসাদ দাস নামে, সাউথ সাবার্বান মেন স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি জিমন্যাস্টিক ক্লাবে গ্রাউন্ড অ্যাক্রোবেট্রিক্স ও ট্রাপিজের দুরূহ খেলায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই সাউথ সাবার্বান স্কুল আন্তঃস্কুল টুর্নামেন্ট লিগে জয় লাভ করে। ফুটবলের পাশাপাশি তিনি বক্সিং শেখাও শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি রোমান ক্যাথলিক ড. ডোনাল্ড জোসেফ ডায়াসের সান্নিধ্যে আসেন। ডায়াসের প্রেরণাতেই তিনি ওয়েস্টার্ন নৃত্যের জগতে প্রবেশ করেন এবং ব্যালে নৃত্যে খ্যাতি লাভ করেন। এই নৃত্যের শিক্ষাগুরু ছিলেন মি. টম ডাকওয়ার্থ। ভবানী প্রসাদ দাস, নামটি ইংরেজদের সান্নিধ্যে এসে এক নতুন, স্মার্ট রূপ নিল, হলেন বব দাস। গড়িয়াহাটে তিনি নিজস্ব নৃত্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তবে এই কাহিনি পরে আসছে।
তখনও ভবানী প্রসাদ ‘বব দাস’-এর পরিচিতি লাভ করেননি। কলকাতা তাঁকে চিনত বক্সিংয়ের একজন সুদক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে। ছোট্ট অরুণ সেই সময় বক্সিং শেখার ইচ্ছে হল। ভবানী প্রসাদ অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁকেও প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। কিছুদিন পর তাঁর মনে হল, এই নতুন শিষ্য কতটা দক্ষ তা যাচাই করার জন্য অরুণের সঙ্গে বক্সিং লড়তে শুরু করলেন। দুর্ভাগ্যবশত, বব দাসের ঘুসিতে অরুণের নাক ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেল।
মনোহরপুকুর রোডের সামনে কে সি মাইতির মিষ্টির দোকানে বসিয়ে ভবানীবাবু জল দিয়ে পরিচর্যা করে অরুণকে গৃহে পাঠিয়েছিলেন। এবং সেই দিনের পর থেকে আর বক্সিং শেখা হয়নি উত্তমকুমারের। এরপর সময় অনেক গড়িয়েছে। বব দাস তখন ওয়েস্টার্ন নৃত্যের একজন নামকরা শিক্ষক। তাঁর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, অভিনয়ের প্রয়োজনে উত্তমকুমারেরও নৃত্য শেখা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। একদিন উত্তমকুমার গাড়ি পাঠিয়ে বব দাসকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে দেখেই প্রশ্ন করলেন, ‘কী, আমাকে চিনতে পারছেন?’ উত্তরে বব দাস জানালেন, উত্তমকুমারকে কে না চেনে? ‘ধুর মশাই, মনে নেই সেই ছোটোবেলায় বক্সিং শেখাতে গিয়ে আমার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন!’
বব দাসের স্মৃতিতে না থাকলেও উত্তমকুমার সেই দিনের কথা ভোলেননি। পরবর্তীতে ‘শহরের ইতিকথা’ চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে উত্তমকুমার বব দাসের কাছে বল ডান্স শিখতে শুরু করেন। সেই ছবিতে উত্তমের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন মালা সিনহা। সেই সূত্র ধরেই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বের এক দৃঢ় বন্ধন স্থাপিত হয়, যা মহানায়কের প্রয়াণ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল।





