আমাকে বাঙালি পরিচালকরা কেন ডাকেন না, আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি: বিদিতা বাগ

সামাজিক ও রাজনৈতিক ছবিতে কাজ করতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বাংলা ছবিতে সুযোগ পাচ্ছেন না বলে ক্ষোভও জমেছে মনে। মুক্তি পেতে চলেছে তাঁর অভিনীত ‘ফৌজি কলিং’। TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মডেল ও অভিনেত্রী বিদিতা বাগ।

আমাকে বাঙালি পরিচালকরা কেন ডাকেন না, আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি: বিদিতা বাগ
গ্রাফিক- অভিজিৎ বিশ্বাস
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Feb 11, 2021 | 5:23 PM

হাওড়ার সাঁতরাগাছি থেকে মুম্বইয়ের গ্ল্যামারাস ফ্যাশন দুনিয়ায় পাড়ি। নামী ফ্যাশন ডিজ়াইনারদের শো-স্টপার। বড় ব্ল্যান্ড এনডর্স করেছেন কেরিয়ারের শুরুতেই। ফেয়ারনেস ব্র্যান্ড এনডর্স করে ট্রোলড হয়েছেন। নেপোটিজ়ম নিয়ে মুম্বইয়ের আন্দোলন তোয়াক্কা করেন না। সামাজিক ও রাজনৈতিক ছবিতে কাজ করতে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বাংলা ছবিতে সুযোগ পাচ্ছেন না বলে ক্ষোভও জমেছে মনে। মুক্তি পেতে চলেছে তাঁর অভিনীত ‘ফৌজি কলিং’। TV9 বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মডেল ও অভিনেত্রী বিদিতা বাগ।

 সামাজিক ও রাজনৈতিক ছবি করার প্রতি এত ঝোঁক কেন আপনার?

অধিকাংশ মানুষই নাচ-গানাওয়ালা ছবিতে অভিনয় করেন। আজকাল ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য অল্পসল্প এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। তবে আমি মনে করি সামাজিক ও রাজনৈতিক ছবিতে কাজ করার জন্য জিগর (সাহস) চাই। অনেক ঝুঁকি থাকে। সেই ঝুঁকি সকলে নিতে চান না। আমরা এমন-এমন সব লোকেশনে শুটিং করি, যেখানে মানুষ মারাও যেতে পারেন। আগে আরও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ প্রজেক্টে কাজ করতাম আমি।

 আপনার কেন মনে হল এই ঝুঁকি নেওয়া প্রয়োজন?

এই গল্পগুলো কে বলবে তাহলে? গল্পগুলো তো কোনওদিনই আর মানুষের সামনে আসবে না। এই গল্পগুলো কোনও সরকারই সমর্থন করে না।

 সামনেই আপনার অভিনীত ‘ফৌজি কলিং’ ছবিটি মুক্তি পেতে চলেছে। সেটাও কি এই ধরনের ছবি?

এই ছবি ততটাও ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ভারতীয় সৈনিকদের পরিবারকে নিয়ে গল্প। আমাদের দেখা ‘ওয়ার’ ফিল্মের চেয়ে অনেক আলাদা।

 সেটা কীরকম?

সেনারা তাঁদের শক্তি পান মা-বাবা, বাচ্চা কিংবা তাঁদের স্ত্রীর থেকে। তাঁরা জানেন, বাড়ির ছেলে কিংবা মেয়েটি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। সঙ্গে এটাও জানেন পরিবারের সকলে সব দিক সামলে নেবেন। আমি এক আর্মি অফিসারের স্ত্রীয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছি। আসলে বলা ভাল, দেশের সব আর্মি স্ত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করেছি।

 এরকম কোনও পরিবারকে আপনি সত্যি চেনেন?

আমি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। অনেক বন্ধুর মা-বাবাই ভারতীয় সেনায় কর্মরত ছিলেন। আমার অনেক বন্ধুও আছে। সুতরাং, আমি তাঁদের জীবন সম্পর্কে অবগত। ওঁদের জীবন খুবই কঠিন। অফিসারদের পার্টনাররা প্রথম থেকে এটা জেনেই বিয়ে করেন যে, মানুষটি তাঁর নন। তিনি দেশের। যে কোনও সময় শহিদ হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সবটা জেনেই তো বিয়ে করেন। এটাও দেখা যায়, কোনও মা তাঁর এক সন্তানকে যুদ্ধে হারালে, অন্য সন্তানকেও পাঠিয়ে দেন। এর জন্য অনেক বড় জিগর চাই।

 আপনি তো অ্য়াডের খুব পরিচিত মুখ। অসংখ্য অ্যাড শুটে কাজ করেছেন। সুপার মডেলও ছিলেন। অ্যাড দুনিয়া থেকে এলে সিনেমার জগত কি সহজে গ্রহণ করে নেয়?

সত্যি কথা বলতে কী, মডেলদের খুব একটা সিরিয়াসলি নেওয়া হয় না। তাঁদের অভিনয় প্রতিভা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। যদিও অনেক মডেলই অভিনয় এসে ভাল কাজের পরিচয় দিয়েছেন।

আপনারও কি একই অভিজ্ঞতা?

আমাকেও সিরিয়াসলি নেওয়া হয়নি। আমি আগে খুব রোগা ছিলাম। ব়্য়াম্পের মডেল ছিলাম। অনেকগুলো বিউটি ব্র্য়ান্ড এনডোর্স করেছি। সিনেমার দুনিয়া থেকে শুনতে হয়েছে, “এ তো ব়্য়াম্পের মডেল। এর তো হাঁটাই অন্যরকম। গ্রামের মেয়ের চরিত্র করতে দিলে কীভাবে হাঁটবে! মানুষের অনেক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা থাকে। সেগুলো পাল্টানো খুব মুশকিল। এই মানসিকতা ভেঙে কাজ করতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সেই জন্য আর্ট ফিল্ম করা শুরু করেছিলাম।

 আর্ট ফিল্ম করলে খুব সহজেই কেরিয়ারে ‘আর্ট ফিল্ম’-এর ট্যাগ বসে যায়! আপনার ক্ষেত্রে কী হয়েছে?

অন্য সমস্যা শুরু হয়েছে। লোকে আমার আগের ইমেজ ভুলতে শুরু করেছে। শুধু রাস্টিক রোলের অফার আসছে আমার কাছে।

একটা সময় তো অনেকগুলো ফেয়ারনেস ক্রিমের অ্যাড করেছিলেন…

হ্যাঁ করেছি। আমাকে দিয়ে অনেকগুলো ফেয়ারনেস ব্র্যান্ডে লঞ্চ করেছিল।

অনেক অভিনেত্রী এই ধরনের ব্র্যান্ডকে এনডোর্স করবেন না বলে নাকচ করেছেন সরাসরি। একটি ব্র্যান্ড বাধ্য হয়ে ‘ফেয়ার’ শব্দটাই সরিয়ে দিয়েছে। আপনার কখনও কিছু মনে হয়নি?

২০০৯ সালে প্রথম ফেয়ারনেস ব্র্যান্ড এনডোর্স করেছিলাম। তখন এভাবে ট্রোল করা হত না। রেসিজ়ম শুনলে অন্যরকম ভাবনা মাথায় আসত। আফ্রিকা আর আমেরিকার কথা মনে হত। আমাদের দেশেও যে এভাবে রয়েছে জিনিসটা, বুঝতেই পারিনি।

 আপনাকেও তো ট্রোল করা হয়েছে অনেক?

২০১১ সাল থেকে আমাকে ট্রোল করা শুরু হয়। আমার বন্ধুবান্ধবের অনেকেই কথা শুনিয়েছিল আমাকে সেই সময়। সত্যি বলতে কী, আমার মাথাতে কোনওদিন ফর্সা-কালোর ব্যাপারটা আসেনি। এই আলোচনার মধ্যেই পড়তাম না আমি। জানতামই না ব্যাপারগুলো। যে ফেয়ারনেস ব্র্যান্ডকে আমি এনডোর্স করতাম, সেটা ছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসার খুব বড় স্টেপিং স্টোন। তারপর যখন বুঝলাম আমাদের দেশেও রেসিজ়ম আছে, আমি আর কোনও ফেয়ারনেস প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপনে কাজ করিনি।

 ছবিতে আপনার বিপরীতে কে আছেন, সেটা নিয়ে আপনার কোনও মাথা ব্যথা থাকে না?

কেরিয়ারের শুরুতে আমি কেবল চিত্রনাট্য দেখতাম। এখন দেখি পরিচালক কে, প্রোডাকশন হাউজ কাদের। এমনকী, সঙ্গে যাঁরা অভিনয় করছেন, তাঁরা কারা। আমি বিশ্বাস করি, কো-স্টার ভাল না হলে নিজেও পারফর্ম করা যায় না।

 ১০ বছরের ফিল্ম কেরিয়ারে মাত্র চারটে বাংলা ছবি- ‘ইচ্ছে’, ‘কাগজের নৌকো’, ‘সাঙ্গাবোরা’, ‘বউমা’। কিন্তু হিন্দিতে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি। অহমিয়া ও ওড়িয়া ভাষাতেও অনেক ছবি করেছেন। বাঙালি মেয়ে হয়ে বাংলায় এত কম কাজ কেন?

আমাকে বাঙালি পরিচালকরা ডাকেন না। কেন ডাকেন না, সেটা আমি আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি। হয়তো আমার ভাগ্যে রয়েছে আমি বলিউডেই নাম করব। বারবার নিজের শো-রিল কেটে, এডিট করে বাঙালি পরিচালকদের ডিভিডি পাঠাতাম। এখনও পাঠাই। আমার ছবির ট্রেলরও পাঠাই। কিন্তু তাঁরা কেউ আমাকে ছবিতে নেন না।

 

আপনার কথায় ক্ষোভ বেরিয়ে আসছে…

আছে তো। ক্ষোভ আছে, দুঃখ আছে।

 এর কারণ কী? পিআর করতে পারেননি বলে?

বাংলার মার্কেট তো খুব ছোট। সেখানে কী পিআর করব বলুন তো। পিআর প্রয়োজন মুম্বইতে।

মুম্বইয়ের কথা যখন উঠলই, সেখানে তো নেপোটিজ়ম নিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছে। আপনি কী মনে করেন?

উত্তর: নেপোটিজ়ম আছে, থাকবেও। এটা নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। বলিউডে স্টার-কিডদের ফিল্ম পাওয়ার জন্য কিছুই করতে হয় না। শুধু ওজন কমাতে হয়। সবারই এক গল্প। আমিও যদি খুব বড় স্টার হয়ে যাই, আমার ছেলেমেয়েকে সবরকম সুযোগ-সুবিধে দেব। জানি না, নেপোটিজ়ম নিয়ে এত কেন লাফালাফি হচ্ছে আজকাল। এটার কোনও দরকার নেই। খুবই বেসলেস জিনিস মনে হয়। তবে হ্যাঁ, নেপোটিজ়মের চেয়েও গুরত্বপূর্ণ অনেকগুলো ‘ইজ়ম’ আছে। অনেকে পলিটিক্যাল কানেকশন ব্যবহার করে ফিল্মে সুযোগ পায়। পয়সা দিয়ে সুযোগ পাওয়ার চেষ্টা করে। তবে কেউ যদি দু’-তিনটে ভাল ছবিতে পরপর কাজ করতে না পারে, খুব বেশি দিন ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে পারে না। এরকম নিদর্শন কিন্তু অজস্র আছে। অনেক সুপারস্টারের ছেলেমেয়ে হারিয়ে গিয়েছেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে বলিউড খুব ফেয়ার জায়গা।

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস