EXPLAINED: নেতাজি না মমতা! ‘রাজনীতির তুলাযন্ত্রে’ কার পাল্লা ভারী?
কংগ্রেস থেকে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সর্বভারতীয় একটি দল গঠন করা আর দেশের অন্দরে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য একটি আঞ্চলিক দল গঠন করা কতটা তুলনাযোগ্য? রাজনীতির কারবারিরা প্রশ্ন তুলছেন।
বাঙালিদের একটা বড় অংশ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে কোনও সাধারণ মানুষ নয়, ‘মহাপুরুষ’ বলেই ভাবেন। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেওয়ালে দেওয়ালে যাঁর ছবি দেখে বাঙালি বড় হয়, যাঁর গভীর রাতে ছদ্মবেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যে গল্প শুনলে আজও বাঙালির গায়ে কাঁটা দেয়, তাঁর সাফল্য বা জনপ্রিয়তা নিয়ে আলাদা করে কাটাছেঁড়া করার কথা ক’জনেরই বা মনে হয়? তবে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে যদি সেই নেতাজির সাফল্য বা নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে তো বিশ্লেষণ করতেই হয়।
‘নেতাজি যা পারেননি, মমতা পেরেছেন’
গত এক সপ্তাহে যে মন্তব্য নিয়ে তুমুল চর্চা হয়েছে, তা অনেকটা এরকম- “নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও কিন্তু আলাদা দল নিয়ে তিনি দলীয় রাজনীতিতে সফল হতে পারেননি। সংসদীয় রাজনীতিতে দল গড়ে ব্যর্থ হয়েছেন নেতাজি। প্রণব মুখোপাধ্য়ায়ও দল গড়ে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে, বাংলার মাটিতে যদি আলাদা দল গড়ে কোনও নেতা বা নেত্রী সফল হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়।” বক্তা তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ।
এই কয়েকটি লাইনেই শেষ হয়নি তাঁর মত প্রকাশ। নেতাজির তৈরি করা রাজনৈতিক দল ফরওয়ার্ড ব্লক যখন রে রে করে উঠেছে, তখন আবারও জবাব দিয়েছেন কুণাল ঘোষ। সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নিয়েছেন উত্তর দেওয়ার জন্য। সেখানে ফরওয়ার্ড ব্লকে-র সাধারণ সম্পাদক নরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্য়ায়কে তিনি লিখছেন, “নেতাজির জায়গায় নেতাজির যেমন মহাউচ্চতা ছিল, আছে, থাকবে। তেমনই কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে একা দল গড়ে সাফল্যের প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্বটা স্বীকার করুন। আপনার নেতা অশোক ঘোষ জীবিত থাকলে এই বাস্তবটা মানতেন।”
‘সফল নয়’! তবু আজও রাজনীতিকদের মুখে মুখে নেতাজি
দল গঠনের কথায় পরে আসা যাক, প্রশ্ন হল তুলনাটা ঠিক কার সঙ্গে হচ্ছে? ২০২২ সালে যাঁরা পূর্ণাবয়ব মূর্তি উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ইন্ডিয়া গেটে কর্তব্যপথের ওপর বসানো হয় সেই মূর্তি। ২৮০ মেট্রিক টনের গ্রানাইট পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয় ওই মূর্তি। নেতাজির এক জন্মজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলছেন, ‘ভারতকে গণতন্ত্রের জননী হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিলেন নেতাজি।’
এক পৃথক অনুষ্ঠানে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্মরণ করে বলছেন, “এ দেশে অনেক জাতি-উপজাতি-ভাষা-ধর্ম রয়েছে। তবে দেশ এই সমস্ত কিছুর উপরে, এমনই মনে করতেন নেতাজি।” বিজেপি বা আরএসএস-এর সঙ্গে নেতাজির দূর ইস্তক কোনও সম্পর্ক ছিল না, একথা সবাই জানেন। তারপরও তাঁর অন্তর্ধাণের এত বছর বাদে তাঁকে স্মরণ করছেন ওই দল ও সংগঠনের নেতারা। আর ভোটের প্রচারে বাঙালি অস্মিতাকে মাথায় রেখে সব দল কীভাবে নেতাজিকে স্মরণ করেন, তা দেখাই যায়। নেতাজির জনপ্রিয়তা যেভাবে আজও উজ্জ্বল, অন্য কোনও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর জনপ্রিয়তা এমনই থাকবে তো? ‘সফল’ নাই বা হলেন, ব্রিটিশ শাসনকাল শেষে প্রায় ৭৮ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও রাজনীতিতে এখনও প্রাসঙ্গিক নেতাজি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আর তৃণমূল জমানা তবে একই হল!
সময়, প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক তাৎপর্য- তুলনা হলে সবটারই তুলনা হওয়া প্রয়োজন। নেতাজি যে সময় রাজনীতি করেছিলেন সেটা ছিল ব্রিটিশ শাসনকাল। আর সেই সময় রাজনীতি করার উদ্দেশ্যই ছিল, ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করা।
চন্দ্র বোস বলছেন, “ব্রিটিশ আমলে রাজনীতি করা আর আজকের দিনে রাজনীতি করার অনেক তফাৎ। ইতিহাস না বুঝে কোনও মন্তব্য করা উচিত নয়।” সুভাষ চন্দ্র বসু একমাত্র নেতা সব ধর্মকে ঐক্যবদ্ধ করে ভারতীয় বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলন। আজ পর্যন্ত কোনও নেতা এটা পারেননি। নেতাজি বিষয়ক গবেষক কুণাল বোসও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রেক্ষাপটটাই ছিল আলাদা। সেই সময় রাজনৈতিক দল তৈরি করার অর্থ ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তি বাড়ানো।
গান্ধীজির থাকতে নেতাজির কংগ্রেস সভাপতির পদ পাওয়া তাহলে সাফল্য নয়?
কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নতুন দল গড়ার নিরিখে নেতাজি সাফল্য কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কুণাল ঘোষ। সেটা বিচার করার আগে কংগ্রেসে নেতাজির সাফল্যটাও স্মরণ করা দরকার।
১৯৩৯ সালে পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে কংগ্রেসের সভাপতি হন সুভাষ চন্দ্র বসু। সীতারামাইয়ার মাথায় ছিল গান্ধীজির হাত। সেই সময় গান্ধীজি নাকি বলেছিলেন, ‘সীতারামাইয়ার হার মানে আমার হার।’ অর্থাৎ নেতাজির সভাপতি হওয়া যে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তা বোঝাই যায়। আর নেতাজির সভাপতি হওয়ার অর্থ কার্যত গান্ধীজিকেই হারানো।
মনে রাখা দরকার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠন করেছিলেন তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে বিরোধের জেরে। আর নেতাজি কেন বেরিয়েছিলেন কংগ্রেস ছেড়ে? আসলে বিশেষ আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে নেতাজি এক সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন, যার জন্য গান্ধীজির সঙ্গে মত পার্থক্য হয়। সেই কারণেই নেতাজির কংগ্রেস ছাড়া।
কংগ্রেস ভেঙে সত্যিই কি সফল হয়েছিলেন নেতাজি?
টাইমলাইনে একটু নজর রাখা যাক। কংগ্রেস ভেঙে কিছু সংস্কার এনে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ তৈরি করেছিলেন নেতাজি। সেটা ১৯৩৯ সাল। ঠিক এক বছর পর ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ আন্দোলনের জন্য ১৯৪০ সালে গ্রেফতার হন নেতাজি। আর ১৯৪১ সালে দেশ ছাড়েন তিনি। অর্থাৎ একজন নেতা মাত্র এক বছর সময় পেয়েছিলেন একটা দল গড়ার জন্য, রাজনীতির ইতিহাস বলে, এইসময়টা একজন দলনেতার কাছে কিছুই নয়।
এক বছরের মধ্যে কোনও দল গঠন করে সাফল্য পাওয়া কিন্তু মুখের কথা নয়। নেতাজির প্রপৌত্র চন্দ্র বোস মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এক বছরের মধ্যেই কলকাতা পুরনিগমে ভোটে জয়ী হয় ফরওয়ার্ড ব্লক। তিনি বলেন, “এই ইতিহাসগুলো একটু জানা উচিত।” তিনি মনে করেন, একজন নেতা দল গঠনের পর যদি ১০ বছরও দায়িত্ব না নেন, তাহলে সেই দলের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অথচ নেতাজির অন্তর্ধানের এত বছর পরও টিকে আছে সেই ফরওয়ার্ড ব্লক।
চন্দ্র বোস বলছেন, “নেতাজি যদি কোনও দিন ফিরে আসতেন, আবারও ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃত্ব দিতেন, তাহলে আজ রাষ্ট্রীয় দলের মর্যাদা পেত ফরওয়ার্ড ব্লক।” নেতাজি বিষয়ক গবেষক কুণাল ঘোষ জানাচ্ছেন, পরবর্তীকালে বেশ কিছু গোয়েন্দা রিপোর্ট সামনে আসে, যাতে জানা যায়, ফরওয়ার্ড ব্লকের বাড়বাড়ন্ত দেখে ভয়ই পেয়েছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। এমনকী ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ফরওয়ার্ড ব্লককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, যাতে তারা আর কোথাও দখল করতে না পারে। শুধু কলকাতা নয়, উত্তর প্রদেশের উন্নাও-তে জন্ম হওয়া ফরওয়ার্ড ব্লক অন্যান্য রাজ্যেও সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছিল। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়, কংগ্রেস ভেঙে জন্ম হওয়ার ১৩ বছর পর যে দল ক্ষমতায় এল, তাদের সঙ্গে ফরওয়ার্ড ব্লকের তুলনা চলে কি?
আর সবথেকে বড় বিষয় হল, কংগ্রেস থেকে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সর্বভারতীয় একটি দল গঠন করা আর দেশের অন্দরে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য একটি আঞ্চলিক দল গঠন করা কতটা তুলনাযোগ্য? রাজনীতির কারবারিরা প্রশ্ন তুলছেন, নেতাজির অন্তর্ধানের পর তাঁর তৈরি দল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবর্তমানে ৮৫ বছর পর তাঁর দলের অস্তিত্ব থাকবে তো? স্বমহিমায় বিরাজ করবে তো তৃণমূল?
নিজের তৈরি দল নেতাজি ছেড়েছিলেন বৃহত্তর স্বার্থে
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যিনি দল গঠন করলেন, তিনি ছেড়ে চলে গেলেন কেন? সাফল্য বা ব্যর্থতায় মাপার মতো সময়ই পাননি তিনি। কারণ ভোট রাজনীতিতে জিতে ক্ষমতায় আসা নয়, নেতাজির লক্ষ্য ছিল, ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করা। আর সেই উদ্দেশ্য নিয়েই দল ছেড়ে নয়, আদতে দেশ ছেড়ে চলে যান নেতাজি। বিদেশ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন তিনি।
যিনি আস্ত ‘বাহিনী’ গঠন করেছিলেন, তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল তৃণমূল জমানায়!
আদতে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন রাসবিহারী বসু। কিন্তু সেই সময় ছিল ২৫,০০০ সৈন্য। নেতাজির হাত ধরে সেই বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা পৌঁছয় ৬০ হাজারে। আর সেই বাহিনীতে ছিল না কোনও ভেদাভেদ। চন্দ্র বোস বলছেন, আজাদ হিন্দ ফৌজ ছিল এমন একটি বাহিনী, যাতে হিন্দু, মুসলিম, শিখ- ধর্ম নির্বিশেষ সবাই শুধু ভারতীয় হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আর সেই আজাদ হিন্দ বাহিনী কার্যত নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশদের। যে নেতাজি হিটলারের সঙ্গে এক টেবিলে বসে আলোচনা করেছিলেন, তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে কি প্রশ্ন থাকতে পারেন? এমনটাই বলছেন নেতাজি গবেষকরা।
রাজনৈতিক দলের সভাপতি পদ থেকে মেয়র পদ, নতুন দল থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী গঠন, নেতাজির মুকুটে একের পর এক পালক যুক্ত হয়েছে। স্বাধীন ভারতে স্বপ্ন বুকে নিয়েই যাঁকে চলে যেতে হয়, তাঁর সাফল্য নিয়ে হিসেব করার প্রয়োজন পড়ছে কেন, সেই প্রশ্নই উঠছে।
অন্তর্ধানের ৮৫ বছর পর আজও বাঙালিরা বিশ্বাস করে, নেতাজি ফিরে আসবে। যদি সত্যিই নেতাজি ফিরে আসতেন, তাহলে কি তিনিই যোগ্যতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হতেন না? আর যদি তা হতেন, তাহলে আজকের সংসদীয় রাজনীতির ধারা কি এমনটাই হত?