Digital Arrest: ডিজিটাল অ্যারেস্ট কী? কীভাবে ফেলা হচ্ছে ফাঁদে? এখানেও কি চিনের হাত!
Digital Arrest: 'এফআইআর' করা হবে, 'অ্যারেস্ট' করা হবে বলে নানা ভাবে 'টার্গেট'-এর মনে প্রতারকরা ভয় তৈরি করে। তৃতীয় পর্যায়ে, এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চিকিৎসক। আর্থিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। হঠাৎ একদিন তাঁদের কাছে একটি ফোন আসে ‘ট্রাই'(TRAI)-এর নাম করে। বলা হয় ‘আপনার নম্বরটি একাধিক ক্রাইমে ব্যবহার করা হয়েছে। আপনাকে আমরা মুম্বই পুলিশের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’ এরপরেই দেখা যায় মুম্বই পুলিশের উর্দিধারী কিছু লোক তাঁকে ভিডিয়ো কল করে। নানা সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করে ওই দম্পতির কাছ থেকে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।
এই ঘটনা প্রথম নয়, গত কয়েক মাসে এমন অগুনতি ঘটনা ঘটেছে সারা দেশ জুড়ে। কোথাও ভয় দেখিয়ে, কোথাও হ্যাক করে, কোথাও ব্যাক্তিগত ছবি লিক করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে, কোথাও খারাপ ভিডিয়ো পাঠিয়ে সম্মানহানি করার ভয় দেখিয়ে, এমন ভাবেই হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হল এই সব ঘটনার অধিকাংশই ‘অপারেশন’ করা হয় দেশের বাইরে নানা ঘাঁটি থেকে। সাইবার প্রতারণার নতুন এই পন্থার পোশাকি নাম হল ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ বা ‘ডিজিটাল গ্রেফতারি’। যা নিয়ে সম্প্রতি চিন্তার সুর শোনা গিয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কন্ঠেও।
তিনি বলেন “ডিজিটাল গ্রেফতারির জালিয়াতি সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। আইনে এই ধরনের কোনও কিছুর উল্লেখ নেই। তদন্তের জন্য কোনও সংস্থাই কাউকে ফোনে বা ভিডিয়ো কলে যোগাযোগ করে না।”
কিন্তু কেন এত উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রধানমন্ত্রী? কী এই ডিজিটাল গ্রেফতারি? কী ভাবে এই পন্থায় প্রতারণা করা হচ্ছে? প্রতারণা থেকে মুক্তির উপায় বা কী?
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান বলছে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে ডিজিটাল গ্রেফতারির জাল। প্রত্যেকে দিন বহু মানুষ লক্ষ লক্ষ টাকা খোয়াচ্ছেন এই ফাঁদে পা দিয়ে। যে তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন না কেউই। আইনজীবি, শিক্ষক, সাহিত্যিক সহ নানা বহুজাতিক সংস্থা কর্তারা— ‘টার্গেট লিস্টে’ আছেন সকলেই।
এই সবের মধ্যেও অন্যতম চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল গ্রেফতারি। সরকারি হিসাব অনুসারে নানা ভাবে এই ফাঁদে পড়ে ভারতীয় নাগরিকরা গত দশ মাসে ২ হাজার ১৪০ কোটি টাকা খুইয়েছেন। প্রত্যেক মাসে গড়ে ২১৪ কোটি টাকার প্রতারণা হচ্ছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
কী এই ডিজিটাল গ্রেফতারি?
সাইবার প্রতারকদের নতুন ‘অস্ত্র’ এই ডিজিটাল গ্রেফতারি। প্রতারকেরা প্রথমে অডিয়ো বা ভিডিয়ো কল করে কোনও এক ব্যাক্তিকে। তার পর তাঁদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য তাঁদের ভয় দেখিয়ে কোনও এক জায়গায় বন্দি করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতারিতদের বাড়িতেই করে।
কী ভাবে সংগঠিত হয় অপরাধ?
প্রথমে, কোনও ব্যক্তিকে ‘কুরিয়ার সার্ভিস’, ‘এয়ারপোর্ট অথারিটি’ অথবা ‘ট্রাই’ এই ধরনের সংস্থার নাম করে ফোন করা হয়। এর পর হয়তো সেই ব্যক্তিকে বলা হয় আপনার নামে একটি পার্সেল ধরা পড়েছে ‘কাস্টমসে’ যার মধ্যে থেকে ড্রাগস বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কিংবা হয়তো কোনও ব্যক্তি কখনও ‘নীল ছবি’ দেখেছিলেন, তাঁকে ফোন করে বলা হল ট্রাই থেকে বলছি ‘আপনি চাইল্ড পর্ন বা শিশুদের নীল ছবি দেখেছেন, সুতরাং আপনাকে অ্যারেস্ট করা হবে।’ কাউকে ফোন করে বলা হচ্ছে ‘আপনার নামে একাধিক আধার কার্ড বা প্যান কার্ড পাওয়া গিয়েছে, যা বিভিন্ন রকম অপরাধ মূলক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।’
অভিযোগ আনার পরে দ্বিতীয় ধাপে, তাঁকে হয়তো বলা হল আপনাকে ভিডিয়ো কল করছি, বা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। এবার বাইরের দেশে কোথাও থানার মতো বা ইডি, সিবিআইয়ের নকল দফতর তৈরি করে ভিডিয়ো কল করা হয়। নিয়ে ‘এফআইআর’ করা হবে, ‘অ্যারেস্ট’ করা হবে বলে নানা ভাবে ‘টার্গেট’-এর মনে প্রতারকরা ভয় তৈরি করে।
তৃতীয় পর্যায়ে, এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। এমনকি প্রথমবার টাকা দেওয়ার পরে বলা হয় এই টাকা আপনি ফেরত পেয়ে যাবেন, এটা তদন্তের একটি অংশ বলে, সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আরও টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।
অনেক সময় তাঁর পরিজনের নাম করে গুরুতর কোনও অভিযোগের কথা বলা হয়। এমনকি এর সপক্ষে পর্যাপ্ত পরিমাণ আছে বলেও দাবি করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতারকদের কাছে অনেক সময় ‘টার্গেটে’-এর ব্যাক্তিগত কিছু তথ্য আগে থেকেই উপলব্ধ থাকে। এর পর ভয় পেয়ে ভিডিয়ো কল করলে, তাঁকে আরও বেশি করে ভয় দেখানো হয়। বাড়িতে ক্যামেরা থাকলে তাঁর ‘অ্যাকসেস’ চেয়ে নেওয়া হয়। প্রতারণার পরিকল্পনাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে, ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট মেমো’ও পাঠানো হয়। শেষে সেই মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার নামে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। এই ফাঁদে পা দিলেই সর্বনাশ।
সাধারণত কোনও সরকারি সংস্থা যেমন— সিবিআই, নারকোটিক্স ডিপার্টমেন্ট, আরবিআই, ইডি, ট্রাই এই ধরনের সংস্থার আধিকারিকের পরিচয়ে ফোন করা হয় ‘টার্গেট’কে।
‘ইন্ডিয়ান স্কুল অফ এথিক্যাল হ্যাকিং’-এর ডিরেক্টর তথা সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত এই বিষয়ে বলেন, “চোর যখন নিজেই পুলিশ হয়ে ফোন করে তখন মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না কোনটা আসল, কোনটা নকল। পুলিশের পোশাক পরে যখন ফোন করে সাধারণ মানুষকে ধমকানো হয় তখন মানুষ ঘাবড়ে গিয়ে টাকা দিয়ে দেয়। আর কেউই পুলিশ বা এই ধরনের ঝামেলায় জড়াতে চায় না। সেই ভয়কেও কাজে লাগানো হয়।”
কোথা থেকে সংগঠিত হচ্ছে অপরাধ?
সন্দীপবাবু জানান, মূলত বিহার, ঝড়খন্ড, বা উত্তর ভারত বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতারকদের দল এই ধরনের ফোন করছে। এই ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হয়। যা কখনই কোনও সরকারি সংস্থা।
জালিয়াতির পিছনে বড় কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে?
এই বিষয়ে সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তথা আইনজীবি বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এটি একধরনের চিনা সাইবার যুদ্ধ। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে প্রতিদিন প্রায় ৬কোটি টাকার জালিয়াতি হচ্ছে এই পদ্ধতিতে। এই চক্রগুলি গত এক থেকে দেড় বছর ধরে সক্রিয়। তবে এখন এই সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে। তাইওয়ান, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, হংকং ভিয়েনাম, তাইল্যাণ্ড বা অনান্য উন্নয়নশীল দেশগুলি ভারতের অর্থনীতির ভারসাম্যকে নষ্ট করতে আরও এই ঘটনাগুলি ঘটাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই সব দেশে যে সব চিনা ক্যাসিনোগুলি রয়েছে সেখান থেকেই প্রধানত এই ঘটনাগুলি ঘটানো হচ্ছে। এই ক্যাসিনোগুলি এখন ক্যাসিনো কম, প্রতারক কল সেন্টারের মতো বেশি কাজ করছে। ভারত থেকেই বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরির লোভ দেখিয়ে কম্পিউটার জানা ভাল ছেলে-মেয়েদের প্রথমে এই সব দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাঁদের পাসপোর্ট বা অনান্য ডকুমেন্ট প্রথমেই নিয়ে নেওয়া হয়। এবার জোর করে সেই সব ছেলে মেয়েকে এই ধরনের প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিকদের মুখের গড়নে এবং কথা বলার ধরন এই ধরনের প্রতারণামূলক ফোনগুলিকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। তাঁদেরকে এক ধরনের ‘ডিজিটাল স্লেভ’ বা ‘ডিজিটাল দাস’-এ পরিণত করা হচ্ছে।”
বিভাসবাবু জানান, যারা বাইরে চাকরি করতে গিয়ে ‘ডিজিটাল স্লেভ’-এ পরিণত হয়েছিল তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু লোককে উদ্ধার করে ফিরিয়ে এনেছে সরকার। তদন্তের পরেই ডিজিটাল গ্রেফতারির গোটা ঘটনাটির পিছনে চিনা মদত এবং ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও সামনে এসেছে।
এই জালিয়াতি থেকে মুক্তির উপায় কী?
বিভাসবাবু এবং সন্দীপবাবু দুজনেই জানান, সচেতনতাই একমাত্র পথ। মানুষ সচেতন না হলে কোনও কিছুই হবে না। পুলিশ বা অন্য কোনও সংস্থা এই ভাবে ফোন করে কাউকে ধমকায় না। ভারতীয় আইনবিধিতেও ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’-এর কোনও জায়গা নেই।
সন্দীপবাবু বলেন, “এখন সবার নাম, ঠিকানা, আধার কার্ড, প্যান কার্ড কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তথ্যের মতো ব্যক্তিগত সব তথ্য বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। ফলে এই জালিয়াতি করা আরও সহজ হয়ে ওঠে। পুলিশ কাউকে ফোন করে ধমকায় না। এই রকম ফোন পেলে উলটে বলা উচিত আমি আপনার নামে অভিযোগ করব। তার পর লাইনটা কেটে ব্লক করে দেওয়া উচিত। সরকারের সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত হেল্প লাইন নম্বর ১৯৩০- অভিযোগ জানানো উচিত।”
এই ধরনের ফোন পেলে ভয় পাবেন না। পুলিশ কাউকে এই ভাবে ফোন করে না। এইরকম ফোন পেলে তা কেটে দিয়ে, নম্বরটি ব্লক করে দিন। মনে রাখবেন টাকা একবার বেরিয়ে গেলে কিন্তু তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই সচেতনতাই হল একমাত্র হাতিয়ার।