‘ছেলেদেরও কান্না পায়’, পুরুষদিবসে কষ্ট শেয়ার করুন মেনহেল্প অরগানাইজেশনকে

'বয়েজ ডোন্ট ক্রাই'। আর 'মেন'? নৈব নৈব চ! (International Men's Day) আবেগঘন মুহূর্তে যদিও বা গাল গড়িয়ে পড়েও যায় দু'ফোটা জল, তবে তা 'পৌরুষের অপমান'। আজন্মলালিত এই ধারণাই বর্তমান একবিংশ শতকেও।

'ছেলেদেরও কান্না পায়', পুরুষদিবসে কষ্ট শেয়ার করুন মেনহেল্প অরগানাইজেশনকে
গার্হস্থ হিংসার শিকার হন পুরুষেরাও।
Follow Us:
| Updated on: Nov 30, 2020 | 6:06 AM

‘বয়েজ ডোন্ট ক্রাই’। আর ‘মেন’? নৈব নৈব চ! (International Men’s Day) আবেগঘন মুহূর্তে যদিও বা গাল গড়িয়ে পড়েও যায় দু’ফোটা জল, তবে তা ‘পৌরুষের অপমান’। আজন্মলালিত এই ধারণাই বর্তমান একবিংশ শতকেও। দমদমের নাগেরবাজারের বাসিন্দা বছর ৩২-এর অমিত চক্রবর্তী (নাম পরিবর্তিত)। বাড়ির পছন্দেই বিয়ে হয়েছিল বেলেঘাটার আস্থা বসাকের (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে। মাস কয়েক আগেই তাঁদের এক ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় হঠাৎই। ভিডিয়োয় দেখা যায় অমিতকে কখনও হাত মুঠো করে ঘুষি, কখনও বা পেটে সজোরে লাথি কষিয়ে দিচ্ছেন আস্থা। অমিত হাতজোড় করে বারণ করছেন স্ত্রী’কে। আদিম উল্লাসে স্ত্রী দেওয়ালে ঠুকে দিচ্ছেন তাঁর মাথা। সমাজ নিন্দা করেছিল অমিতের। ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োর কমেন্ট বক্সে নেটিজেনরা লিখেছিলেন, “মেয়েছেলের হাতে মার খাস, কেমন পুরুষ তুই?”। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিলেন অমিত। কমেন্ট এসেছিল, “বেশ হয়েছে। শাড়ি-চুড়ি পরে বসে থাক”। পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যমের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন অমিত। পৌরুষের অহংবোধ নয়। জানিয়েছিলেন, স্ত্রী’র গায়ে হাত তুলতে তাঁকে বারণ করেছিল তাঁর বিবেক, শিক্ষা।

আগামী ১৯ নভেম্বর ‘পুরুষ দিবস’। ফেমিন্যাজিরা (যে ব্যক্তি সমানাধিকারকে গুরুত্ব না দিয়ে সর্বক্ষেত্রে নারী শাসনের প্রতিষ্ঠা চান) প্রশ্ন তুলতেই পারেন, পুরুষশাসিত দেশে পুরুষদিবস কি নেহাতই শো-অফ? সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ‘না’। এ দেশে সহ সমস্ত পৃথিবীতে গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়া থেকে শুরু করে যৌন নির্যাতনের মিথ্যা মামলায় কাঠগড়ায় দাঁড় হওয়া পুরুষের সংখ্যা কিন্তু নেহাতই কম নয়। কম বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু পুরুষ। কিন্তু আইনের ফাঁকতালে ছাড়া পেয়েছে দোষীরা। ছেলেরাও যে ধর্ষিত হন, এই কনসেপ্টে আজও বিশ্বাসী নন বহু মানুষ। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা বলছে, আইনের চোখে সবাই সমান। তবে কেন এই ফাঁক, তা তর্কের বিষয়। তবে পুরুষ দিবসে সকল পুরুষের ‘পাঞ্চিং ব্যাগ’ আর মন খুলে কথা বলার জন্য এগিয়ে এসেছে মেন হেল্পলাইন অরগানাইজেশন। তাঁদের আর্তি, “দোষীদের শাস্তি দিন, তবে মিথ্যে মামলায় , চক্রান্তের শিকার হন যে সব পুরুষেরা, তাঁদের পাশে থাকুন।” এ বছর পুরুষ দিবসের থিম বেছে নেওয়া হয়েছে ‘সুস্থ মন এবং সুস্থ শরীর’। বিশ্বজুড়ে প্যান্ডেমিকের মাঝে যা যথার্থই বলে মনে করছে সমাজবিদরা।

এ বার প্রশ্ন হল আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস শুরু হয় কবে এবং কেন? সাল ১৯৬০। নারী দিবসের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ডাক ওঠে পুরুষ দিবসেরও। ১৯২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম পালিত হয় রেড আর্মি অ্যান্ড নেভি ডে। মাতৃভূমির প্রতি পুরুষদের আত্মত্যাগ ও তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়েই এই দিন পালিত হলেও ‘মেন’স ডে’-র কনসেপ্ট তখনও প্রচারের আলো দেখেনি। ১৯৬৮ সালে মার্কিন সাংবাদিক জন হ্যারিস প্রথম তাঁর এক লেখায় নারী দিবসের পাশাপাশি পুরুষ দিবসের কথাও তুলে ধরেন। হ্যারিসের বক্তব্য ছিল, সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থায় মহিলা কর্মীদের আত্মত্যাগ এবং কঠোর পরিশ্রম উদযাপনের জন্য নারী দিবস পালিত হলে, পুরুষদের জন্য কেন এই ‘দ্বিচারিতা’? তাঁর প্রশ্ন ছিল, তাঁরা কি পরিশ্রম করেন না? হ্যারিস চেয়েছিলেন সমানাধিকার। কর্মক্ষেত্রেও, উদযাপনের নিরিখেও।

male abuse

সমানাধিকারের আশায়…

এর পর কেটেছে বেশ কিছু সময়। ১৯৯৯ সালের ১৯ নভেম্বর ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো প্রথম বার পুরুষ দিবস পালন করেন ডক্টর জেরোমি তিলাকসিং-এর নেতৃত্বে। জেরোমি’র বাবার জন্মদিন ছিল ১৯ নভেম্বর। পরে জেরোমি জানান, বাবা তাঁর কাছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ। তাই তাঁর জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতেই ওই দিন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে পুরুষ দিবসের কনসেপ্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিশ্ব জুড়ে। জামাইকা, চিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাপিয়ে ক্রমে তা ঢুকে পড়ে ভারতেও।

ভারতে প্রথম বার আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালিত হয় ২০০৭ সালে, পুরুষ অধিকার নিয়ে সওয়াল করা কিছু গ্রুপের মাধ্যমে । ২০০৯ সালে প্রথম বার পুরুষ দিবসে স্পনসরশিপ পায় তারা। এগিয়ে আসে ছেলেদের পোশাকের ব্র্যান্ড অ্যালান সোলি। এইচবিও ঠিক করে ওই দিন চ্যানেলে সবটা সময় ধরে ‘মেন ইন ব্ল্যাক’ ছবির সব কয়টি পার্ট দেখাবে তারা।

২০১৪-র নভেম্বরে পুরুষ দিবস উপলক্ষে নয়াদিল্লির আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতার রাস্তায় হয় প্রতিবাদ। পুরুষের অধিকার নিয়ে রাস্তায় নেমে সরব হন পুরষ অধিকার নিয়ে চর্চা করা দলগুলি। তাঁদের প্রশ্ন ছিল, আইনের চোখে কেন বৈষম্যর শিকার হবেন পুরুষেরা? কেন বিচ্ছেদের পর সন্তান নাবালক হলে তাঁর দায়িত্ব পাবে মা? বাবা কেন নয়? তবে ভারতে পুরুষের অধিকার এবং তা সংক্রান্ত প্রতিরোধ, প্রতিবাদের আগুন সবচেয়ে বেশি স্ফুরিত হয়েছেন ঠিক দু’বছর আগে পুরুষ দিবসের দিন, কলকাতার রাস্তাতেই। ‘অভিযান’ নামক পুরুষ সুরক্ষা এবং অধিকার সংক্রান্ত একটি সংগঠন প্ল্যাকার্ড হাঁটে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল শহরের রাস্তায়। তাঁদের মূল দাবি ছিল ভারতীয় সংবিধানের ৪৯৮এ ধারার পরিবর্তন। তাঁদের দাবি ছিল ধর্ষণের আইনকে যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধ্বে যেন কড়া হয় প্রশাসন।

এ বছর পুরুষদের মন খুলে কথা বলার ঠিকানা মেন হেল্পলাইনকে স্বাগত জানিয়েছেন সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ। ওই হেল্পলাইনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কুমার এস রতনের বক্তব্য, “ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়ে আলচনা হলেও প্রস্টেট ক্যানসার নিয়ে সে ভাবে আলোচনা হয় না। ছেলেদের জন্য কোনও হেল্পলাইনও নেই। তাঁদের কথা শোনার কেউ নেই। কোনও মহিলার মিথ্যে অভিযোগে কোনও পুরুষ ফেঁসে গেলেও পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সেই কথা মাথায় রেখেই এই উদ্যোগ।”

‘অভিযান’ প্রশ্ন তুলেছিল, ‘উওম্যান কমিশন থাকলে ম্যান কমিশন কেন নয়?’ উত্তর মেলেনি। ঠিক যেমন উত্তর পাননি দমদমের অমিত, খিদিরপুরের আরমান। পুরুষদেরও কষ্ট হয়, তাঁদেরও গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে, আপনি না হয় এড়িয়েই গেলেন, মেনহেল্প অরগাইনেশন থাকবে ওদের পাশে।