‘শিলিগুড়ি হবে রাজধানী… আপনি দক্ষিণবঙ্গ সামলান, উত্তরবঙ্গ আমরা সামলে নেব’

সবার উন্নয়ন চাইলে, কারও ভাবাবেগে আঘাত না দিয়ে একজোট হয়ে কেন্দ্রীয় শাসিত উত্তরবঙ্গই ভাল। ছোট রাজ্য হলে সবাই মিলে উন্নতি করতে পারব।

'শিলিগুড়ি হবে রাজধানী... আপনি দক্ষিণবঙ্গ সামলান, উত্তরবঙ্গ আমরা সামলে নেব'
অলংকরণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Jun 23, 2021 | 4:48 PM

রনি চৌধুরী: ফের কি হাসি ফুরোচ্ছে পাহাড়ের? এবার পাহাড় নয়, তরাই-সমতল গোটা উত্তরবঙ্গেও কি ‘বেসুরো’ হাওয়া? বাংলা থেকে উত্তরবঙ্গকে পৃথক করার দাবি তুলেছেন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বার্লা। অনুন্নয়ন, বঞ্চনার অভিযোগ তুলে উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য বা কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হিসাবে জোর সওয়াল করে চলেছেন তিনি। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব যদিও তাঁর এই অবস্থানের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সাফ জবাব, বাংলা ভাগ তাদের দলের অ্যাজেন্ডা নয়। তাও কেন বার্লার দাবিকে সমর্থন করছেন একাধিক বিজেপি নেতা? এটা কি দলবিরোধী কাজ নয়? গোর্খাল্যান্ড নিয়ে বিজেপির এই মুহূর্তে কী অবস্থান? কেনই বা উত্তরবঙ্গ পৃথকের দাবি উঠছে? এমনই সব প্রশ্নের অকপট উত্তর দিলেন উদ্ভূত বিতর্কেরই কাণ্ডারি জন বার্লা।

কেন উত্তরবঙ্গ পৃথকের দাবি তুলছেন?

জন বার্লা: বারবার দিদি বলছেন উত্তরবঙ্গের উন্নতি হচ্ছে। সত্যিকারে উন্নয়ন হলে, ২০১১ সালে এইমস হয়েছিল উত্তরবঙ্গে। সেটা কেন কল্যাণীতে চলে গেল? এখানকার মানুষ কি জঙ্গলে থাকে? এখানকার মানুষ অসুস্থ হন না? দক্ষিণবঙ্গে তো বড় বড় নার্সিংহোম, মেডিকেল কলেজ তৈরি হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের সত্যিকারের উন্নয়ন হত, তাহলে রাজগড়েও এইমস থাকত। কিন্তু আপনি তাকে নিয়ে চলে গেলেন দক্ষিণবঙ্গে!

শুধুই একটা এইমস?

জন বার্লা: শুধু তাই নয়। এখানকার যুবক-যুবতীরা পড়াশোনা করে ঘরে বসে আছে। কাজ নেই। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিতে হলে আমাদের যেতে হয় ৫০০ কিলোমিটার দূরে। আমরা কেন চাইব না যে উত্তরবঙ্গের ছেলেময়েরা কমপক্ষে শিলিগুড়ি গিয়ে তাদের পরীক্ষা দেয়। কিন্তু দিদি এভাবে ভাবেন না। এছাড়া, এখানে তেমন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। দেখবেন, প্রতিযোগিতামূলক জায়গাতে আমাদের উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েরা নেই। দক্ষিণবঙ্গের ছেলেমেয়েরা চাকরি পান। এ নিয়ে কোন বিরোধ থাকতে পারে না। কিন্তু উত্তরবঙ্গের ছেলেমেয়েদেরও চাকরি হোক!

বলতে চাইছেন উত্তরবঙ্গ বৈষম্যের শিকার?

জন বার্লা:  অবশ্যই। এছাড়াও রয়েছে নিরাপত্তার প্রশ্ন। বারবার শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে সব অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ছে। চিনের টার্গেট শিলিগুড়ি-সহ সারা উত্তরবঙ্গ।

অর্থাৎ, এইমস, বিশ্ববিদ্যালয়, বেকারত্ব, নিরাপত্তার প্রশ্নে আপনি এই দাবি তুলছেন। আর কী কারণ থাকতে পারে?

জন বার্লা: সন্ত্রাস। দিদির সরকার ক্ষমতায় এসেছে ঠিকই। ভোটের আগে ৫০০ টাকা ভাতা, স্বাস্থ্যসাথীর সুবিধা-সহ নানা প্রকল্পের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, ভোটের পর কম করে যদি ওই সব কাজ হত! কিন্তু ২ তারিখ জেতার পর ওরা সন্ত্রাস করছে। ওনার লোক জেতার পর তো বাংলা জুড়ে সন্ত্রাস করছে। তৃণমূলের লোক আর পুলিশের অত্যাচারে গ্রামের পর গ্রাম, গলি-গলি যে সন্ত্রাস হয়েছে। ভিন রাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন আমাদের কর্মীরা। এটা উন্নয়ন নয়। আপনি জিতেছেন। কাজ করা উচিত ছিল। কিন্তু আপনার লোকজন, পুলিশ প্রশাসনকে লাগিয়ে দিনে দুপুরে ধর্ষণ করা হচ্ছে, খুন হচ্ছে। ঘরদোর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কেন? এটা তো উন্নয়ন হতে পারে না, না?

উত্তরবঙ্গ পৃথকের দাবি কি শুধুই একটা রাজনৈতিক দলের?

জন বার্লা: তৃণমূল স্তর থেকেই আওয়াজ উঠছে। কিন্তু যুবক-যুবতীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়াজ তুললে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে।

রাজ্য না কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল? কী চাইছেন?

জন বার্লা: আলাদা রাজ্যের কথা বলিনি। পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কথা বলেছি। উত্তরবঙ্গে যেমন উন্নয়ন চেয়েছিলাম তা দেখতে পাইনি। কংগ্রেস জমানায় যে হাল ছিল তা বাম আমলে পাল্টায়নি। এখন তৃণমূল জমানায় তার কোনও পরিবর্তন আসেনি। আমরা ভেবেছিলাম বিজেপি ক্ষমতায় এলে জনগণের সেবা করব। কিন্তু জিততে পারিনি। ঠিক আছে। উত্তরবঙ্গে ভালো জায়গায় রয়েছি। কিছু জায়গায় জিতেছি। কিছু জায়গায় হেরেছি।

গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময় জন বার্লা আদিবাসী বিকাশ পর্ষদের সামনে থেকে লড়াই করেছেন। তখনও তো পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি উঠেছিল…

জন বার্লা: দেখুন, এখন এ নিয়ে মন্তব্য করব না। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে আমাদের। এই বিতর্ক করলে আমাদের সমস্যার সমাধান হবে না। এখন ৯৫ শতাংশ উত্তরবঙ্গবাসী চাইছেন পৃথক উত্তরবঙ্গের। সবাই বলছেন উন্নয়ন হয়নি। হওয়া দর কার। বিরোধী বিধায়ক, নেতারাও বলছেন ছোট রাজ্য হলে উন্নয়ন সম্ভব। সামনে সিকিমের উদাহরণ রয়েছে।

এ নিয়ে কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সংগঠন যোগাযোগ করছেন আপনার সঙ্গে?

জন বার্লা: হ্যাঁ। সবাই বলছেন দাদা আপনি আগে চলুন, আমরা পাশে আছি। দিল্লি পর্যন্ত আওয়াজ তুলুন। কারণ কোনও সমস্যার সমাধান দিদি করতে পারছেন না। আমরা কার কাছে যাব? একটা খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে না জেলা শাসক শোনেন আমাদের কথা, না এসপি কানে তোলেন অভিযোগ। রাজ্যপালকে বলতে গেলে, তাঁর ওপরও হামলা হয়! তাহলে কার কাছে যাব। এজন্যই আমরা কেন্দ্রের কাছে এই আবেদন রেখেছি। আর এটা কেন্দ্রই করতে পারে। শান্তি কেন্দ্রীয় সরকারই আনবে, আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে।

সায়ন্তন বসুরা বলছেন, জন বার্লার নিজস্ব দাবি এটা, পৃথক উত্তরবঙ্গের দাবিকে বিজেপি সমর্থন করে না।

জন বার্লা: আমি এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। রাজ্য বিজেপিকে এখানকার পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করব। কথাবার্তা চলছে। যে সমস্যা, দাবি আছে তা জানাব। করোনা পরিস্থিতি ঠিক হলে দিল্লি গিয়েও পরিস্থিতি ও দাবির কথা তুলে ধরার চেষ্টা করব। কারণ, এই দাবি জন বার্লার নয়। এই দাবি উত্তরবঙ্গের মানুষের। সেই দাবিকে আমি শুধু কেন্দ্র পর্ষন্ত পৌঁছে দেব।

বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব আপনার এই দাবি সমর্থন করবে?

জন বার্লা: নিশ্চয়ই। বোঝানোর শক্তি আছে। আমি বলব। আমাদের শান্তি চাই। এটাই তো দাবি! যে মানুষরা ঘরছাড়া, তাদের ফেরানোর জন্য আমরা আর কোথায় যাব? কেন্দ্রই শেষ ঠিকানা। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের জন্য কেউ নেই। কেন্দ্রই শান্তি আনতে পারে। আমি সাংসদ। মানুষ সমস্যার কথা আমাকে জানাচ্ছে। ছাত্রছাত্রী, চা-বাগানের শ্রমিক- সবাই।

দিদি বারবার বলেন উন্নয়ন করেছি। আমি বলতে চাই, একটা চা-বাগানের ধারে গ্রাম ঘুরিয়ে আনব। সাড়ে তিনশো বাগানের প্রতিটিতে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার লোক থাকেন। তাদের প্রত্যেক চা বাগান থেকে শ্রমিকরা এখন ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। কেরল, তামিলনাড়ু, দিল্লি, মুম্বই কোথায় কোথায় তাঁরা কাজ খুঁজতে গিয়েছেন! এখানে যদি উন্নয়ন হত, তাঁরা পরিবার ছেড়ে কোথাও যেতে হত না।

মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো বলছেন, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের যে সম্পর্ক, তা খারাপ করতে, বিচ্ছিন্ন করতেই এই দাবি…

জন বার্লা: না। এটা জনতার দাবি। আপনি দক্ষিণবঙ্গ সামলান। উত্তরবঙ্গ আমরা সামলে নেব। এখানকার মানুষ বলছে। তাঁদের কথা তোলার জন্য আমাকে সাংসদ করে দিল্লি পাঠিয়েছেন। পার্লামেন্টে ঘুমনোর জন্য পাঠায়নি আমাকে। আমি জনতার দাবি দিল্লিতে রাখবই।

বর্তমান রাজ্য সরকার বিরোধী আওয়াজকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। আমার কাছে মানুষ দাবি জানাচ্ছেন,”পৃথক কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল বা রাজ্য করার ব্যবস্থা করুন। আমরা এখানে থাকতে পারছি না।” এখানে তৃণমূলের লোকেদের ১০০ দিনের কাজ মেলে। বিজেপিতে ভোট দিলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কাজও এখানে মেলে না! বিজেপি করলে রেশন কার্ড দেওয়া হয় না। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া হয় না। বিজেপি বলে জমির ফসল পর্যন্ত কেটে নিয়ে যায়।

যারা রাজ্য ছেড়ে বাইরে গিয়েছেন, তাঁদের ফিরতে হলে টাকা দিতে হয়। নিজের ঘরের সামনে তৃণমূলের পতাকা তুলতে হয়। এসব দেখেই মানুষ বাঁচতে চাইছেন। শান্তির জীবন চাইছেন। এসব দেখেই আমি বলছি, আলাদা রাজ্য নয়ত উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল করা হোক। সংসদেও এই দাবি তুলব। গ্রাউন্ড রিয়ালিটি আমি তুলে ধরব প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে।

তৃণমূল আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে যে কোনওভাবেই তাঁরা উত্তরবঙ্গকে ভাগ হতে দেবেন না।

জন বার্লা: ওনাদের ব্য়াপারে আমি কিছু বলতে পারব না। আমার কী করা দরকার আমি জানি। আমি আমার মানুষের সেতু। সেই সেতু হয়ে তাঁদের দাবি দিল্লি পৌঁছবে।

উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য হলে উন্নয়ন যে হবেই, আপনি নিশ্চিত?

জন বার্লা: অবশ্যই। আগামীতে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চল হলে কেন্দ্র প্রচুর ফান্ড দেবে। ঢালাও উন্নয়ন হবে। কাল যদি আলাদা রাজ্য হয় উত্তরবঙ্গ। শিলিগুড়ি আমাদের রাজধানী হয়ে যাবে। তখন এখান থেকেই কত সুবিধা পাবে উত্তরবঙ্গবাসী। বিশ্ববিদ্যালয় নেই, ভালো ট্রেনিং সেন্টার নেই। আমাদের লোককে ৫০০ কিমি দূরে চাকরির পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না।

এর আগে বেশ কিছু সংগঠন ও রাজনৈতিক দল পৃথক করার দাবি তুলেছে, যেমন কামতাপুর…

জন বার্লা: হ্যাঁ। আমি এর আগে কেন বলিনি, কারণ কেউ গ্রেটার কোচবিহারের দাবি করছেন, কেউ কামতাপুরের। কেউ রাজবংশীদের জন্য আলাদা হতে চাইছেন, কেউ আমরা বাঙালি। যেখানে আমিও ২০০৭ সালে আন্দোলন করেছি। ওদিকে গোর্খাল্যান্ডের জন্য দাবি উঠেছে। আমি দেখেছি, সবার উন্নয়ন চাইলে, কারও ভাবাবেগে আঘাত না দিয়ে একজোট হয়ে কেন্দ্রীয় শাসিত উত্তরবঙ্গই ভাল। ছোট রাজ্য হলে সবাই মিলে উন্নতি করতে পারব।

আরও পড়ুন: বার্লার কেন্দ্রে ভাঙন পদ্মের, একাধিক নেতার যোগদান তৃণমূলে