নন্দীগ্রামে শুরু, নন্দীগ্রামেই কি শেষ, মমতা-শুভেন্দুর সম্পর্কের একাল-সেকাল

যে মাটি থেকে এক সঙ্গে পথ চলা, সেই মাটিতেই এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মমতা (Mamata Banerjee) ও শুভেন্দু (Suvendu Adhikari)। একনজরে নন্দীগ্রামে (Nandigram) ফেলে আসা তাঁদের ইতিহাস। দেখে নেব কীভাবে তৃণমূল নেত্রীর একদা বিশ্বস্ত সৈনিক থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন শুভেন্দু।

নন্দীগ্রামে শুরু, নন্দীগ্রামেই কি শেষ, মমতা-শুভেন্দুর সম্পর্কের একাল-সেকাল
ফাইল ছবি
Follow Us:
| Updated on: Mar 07, 2021 | 1:41 AM

কলকাতা: এ যেন গুরু বনাম শিষ্যের লড়াই। যে তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা তলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) নেতৃত্বে নন্দীগ্রাম (Nandigram) আন্দোলনের মাধ্যমে শুভেন্দু অধিকারীর নেতা হিসাবে উত্থান, এবার সেই মমতারই মুখোমুখি শুভেন্দু (Suvendu Adhikari)। সূচ্যগ্র জমি ছাড়াতে নারাজ উভয় পক্ষ, লড়াই হবে কাঁটায় কাঁটায়।

সাল ২০০৬। সিঙ্গুরে টাটার কারখানা তৈরির জন্য হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে তৎকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সরকার। সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকরা অবশ্য রুখে দাঁড়াতে পারেননি। আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে রুখে দিয়েছিল নন্দীগ্রাম। আটকে গিয়েছিল সালেম গোষ্ঠীর কেমিক্যাল হাব তৈরির পরিকল্পনা। মাতঙ্গিনী হাজরা, ক্ষুদিরাম বসু, বীরেন্দ্রনাথ শাসমলদের জেলায় হাজারো চেষ্টার পরও জমি অধিগ্রহণে সফল হয়নি বাম সরকার। বাম সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং গ্রামবাসীদের পাশে দাঁড়াতে সেই সময় নন্দীগ্রামেও ছুটে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে পাশে পেয়ে ক্রমশ গ্রামবাসীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ জমাট বেঁধে ভিন্ন মাত্রা পায়।

পুরোদমে আন্দোলন চলাকালীন মমতা পাশে পান এক কংগ্রেস ঘরানার অভিজ্ঞ রাজনীতিকের তরুণ ছেলেকে। বয়স মেরেকেটে ৩৫। উদ্যম ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ছেলেটি কংগ্রেস নেতা শিশির অধিকারীর মেজো পুত্র শুভেন্দু। যুবা ও ফুরফুরে শুভেন্দুকে মনে ধরে মমতার। সেই থেকে শুরু হয় একসঙ্গে পথ চলা। শুভেন্দুর নেতৃত্বে নন্দীগ্রামে তৈরি হয় ভূমি উচ্ছেদ কমিটি। এই কমিটির নেতৃত্বে ক্রমশ ভরসাযোগ্য হয়ে ওঠেন শুভেন্দু।

Mamata Suvendu Nandigram

ফাইল ছবি

এর কিছুদিনের মধ্যেই ঘটে যায় সেই ঘটনা যা নাড়িয়ে দেয় আপামর দেশ, রাজ্য এবং অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলাকে। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে পুলিশের গুলি লেগে মৃত্যু হয় ভূমি উচ্ছেদ কমিটির ১৪ আন্দোলনকারীর। ফের ছোটেন মমতা। তখনও পাশে ছিলেন শুভেন্দু। শুধু মমতার নয়, সমানভাবে স্বজন হারানো গ্রামবাসীদেরও। এরপর সময়ে চাকা গড়িয়ে চলে। ক্রমশ নন্দীগ্রামের ‘দাদা’ হয়ে ওঠেন শুভেন্দু।

কাট টু ২০০৯। লোকসভা নির্বাচন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শুভেন্দুকে তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবারও হতাশ করেননি শুভেন্দু। জয়যুক্ত হন বিরাট ব্যবধানে। একবার নয়, পরপর দু’বার। শুভেন্দুই তাঁর বাবাকে তৃণমূলে আসতে রাজি করান। ২০০৯ সালেই ছেলের সঙ্গেই কাঁথি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন শিশির অধিকারীও। কালক্রমে কাঁথি পুরসভার ভার ন্যস্ত হয় শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দুর উপর। এভাবেই পূর্ব মেদিনীপুর ধীরে ধীরে অধিকারী গড় হিসাবে পরিচিতি পায়। ইতিউতি ‘নন্দীগ্রামের নায়ক’-এর মতো শব্দবন্ধ শোনা যেতে থাকে। মমতাও বুঝতে পারেন শুভেন্দুর গুরুত্ব। এরপর প্রায় ৬-৭ বছর ধরে দিল্লি ও সংসদের অলিন্দে রাজনীতি করা মানুষটিকে আচমকাই রাজ্য মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন মমতা। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেই নন্দীগ্রাম থেকে শুভেন্দুকে প্রার্থী করেন মমতা। এ বারও রেকর্ড মার্জিনে জিতে আসেন শুভেন্দু। একাধিক মন্ত্রক পান মুখ্যমন্ত্রীর মন্ত্রিসভায়।

সরকারের পাশাপাশি শুভেন্দুর সাংগঠনিক গুরুত্বও বাড়াতে শুরু করেন মমতা। জঙ্গলমহলের পাশাপাশি রাজ্যের বিবিধ জেলার সাংগঠিন দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় শুভেন্দুর ঘাড়ে। ঠিক এই সময়টায় রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন শুরু হয় যে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ছাড়া তৃণমূল থেকে একমাত্র জেতার ক্ষমতা রাখেন শুভেন্দু। এই একই সময়ে তৃণমূলে ও পরোক্ষে প্রশাসনে বিশেষভাবে গুরুত্ব বাড়তে থাকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও, এমনটাই মনে করেন অনেকে। এর আগেই অবশ্য শুভেন্দুর হাত থেকে যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতিত্ব সৌমিত্র খাঁর হাত ঘুরে চলে আসে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে অনেক আসন হাতছাড়া হয় তৃণমূলের। এরপর থেকেই তৃণমূল-শুভেন্দু সম্পর্কে ক্রমশ শীতলতা দেখা যায়। দূরত্ব বাড়তে থাকে। ক্রমশ একটু একটু করে মুখ খুলতে শুরু করেন শুভেন্দু। কখনও ‘ক্ষমতা কুক্ষিগত’ করে রাখার বিরুদ্ধে সুর চড়াতে শোনা যায়। কখনও বা অনুযোগের সুরে সরকার কলকাতার কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে, বলে গলা ওঠান ‘গ্রামের পান্তা খাওয়া ছেলে’ শুভেন্দু। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, শুভেন্দুর ধৈর্যের সীমা সম্ভবত ভেঙে যায় তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের পর্যবেক্ষকের পদ বিলুপ্ত করার পর। লোকসভা ভোটে খারাপ ফল হওয়ার পরই পর্যবেক্ষক পদ তুলে দেওয়া হয় তৃণমূলে। অর্থাৎ একাধিক জেলার দায়িত্বে থাকা শুভেন্দুর গুরুত্বে বিশেষ কোপ পড়ে, এমনটাই বিশ্লেষণ ওয়াকিবহাল মহলের।

ক্রমশ সুর বদলে তৃণমূলে ‘বেসুরো’ হয়ে উঠতে থাকেন একদা ‘নন্দীগ্রামের নায়ক’। দলীয় যে কোনও কর্মসূচিতে তাঁর অনুপস্থিতি চোখে পড়তে শুরু করে রাজনৈতিক মহলের। এর পর আত্মপ্রকাশ করেন ‘দাদার অনুগামীরা’। ক্রমশ পরিষ্কার হতে থাকে, শুভেন্দু কালীঘাটের মায়া ত্যাগ করছেন। এরপরই গত নভেম্বরে নন্দীগ্রাম ভূমি উচ্ছেদ কমিটির এক অনুষ্ঠানে এসে হুঙ্কারের সুরে জানিয়ে দেন, ‘লড়াইয়ের ময়দানে দেখা হবে।’  যেন তৃণমূলকে বুঝিয়ে দেওয়া, আজ দু’জনার দু’টি পথ দু’দিকে গেছে বেঁকে।

এর পর একে একে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি, বিধায়ক হিসাবে পদত্যাগ। এর কয়েক দিনের মধ্যেই অমিত শাহের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান সেই মেদিনীপুরের মাটিতে দাঁড়িয়েই। তখন থেকেই ‘তোলাবাজ ভাইপো’, ‘কিডনি চোরে’র মতো বাছা বাছা বিশেষণে তৃণমূলকে নিশানা করতে শুরু করেন শিশির-পুত্র।

এদিকে, হারানো জমি উদ্ধারে নন্দীগ্রামে নেমে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অধিকারী-বিরোধী শিবিরের অখিল গিরিকে গুরুত্ব দেওয়া, শিশির অধিকারীকে জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে স্পষ্ট করেন কড়া বার্তা। জানুয়ারি মাসে নন্দীগ্রামের এক জনসভা থেকে সবাইকে চমকে দিয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘আমি যদি নন্দীগ্রামে প্রার্থী হই কেমন হয়!’ মমতার এই সিদ্ধান্তকে একুশের ভোটে তৃণমূলের মাস্টার স্ট্রোক বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকদের একাংশ। এই একটি ঘোষণার মাধ্যমেই যেন নিজের একদা শিষ্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন মমতা। আজ, শনিবার দিল্লির সদর দফতরে প্রথম দুই দফার আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বিজেপি। যেখানে দেখা যায় নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী করা হয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীকে। অর্থাৎ যে চ্যালেঞ্জ দিদি ছুড়ে দিয়েছিলেন, তা যেন কার্যত ‘এক্সেপ্ট’ করলেন নন্দীগ্রামের ‘দাদা’।

সংখ্যালঘুদের একটা বড় প্রভাব নন্দীগ্রামের ভোটে সর্বদাই কাজ করে। এই আসনে দাঁড়িয়েই ২০১৬ সালে ৬০ শতাংশের বেশি ভোটে জিতেছিলেন শুভেন্দু নিজে। তবে সে বার ঘাসফুলের প্রতীকে লড়তে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এ বার তিনি লড়বেন বিজেপির প্রার্থী হয়ে। অন্যদিকে, এ বারের ভোটেও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকেই পুঁজি করেছেন মমতা। ফলে নন্দীগ্রামের মানুষ শেষ কাকে হাসার সুযোগ করে দেয়, কে-ই বা নীলবাড়ি দখলের দৌড়ে এগিয়ে যায়, এই প্রশ্নগুলির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২ মে পর্যন্ত।