জলে-জঙ্গলে বিপদ! ভরাট হচ্ছে একের পর এক জলাভূমি, অবৈধ নির্মাণের দায় কার?

KMC Elections 2021: কলকাতা পুরপ্রশাসনের যদিও  দাবি, এই ঘটনায় রিজেন্ট পার্ক থানায় এফআইআর হয়েছে। যদিও সেই অভিযোগ এরপরেও দলীয় কার্যালয় তৈরি হওয়া থমকে নেই। আবার ৭ নম্বর বরোর অধীনে থাকা ট্যাংরা, তপসিয়া, তিলজলা সহ একাধিক এলাকায় কলকাতার মধ্যে জলাশয় ভরাট হবার সংখ্যা সব থেকে বেশি।

জলে-জঙ্গলে বিপদ! ভরাট হচ্ছে একের পর এক জলাভূমি, অবৈধ নির্মাণের দায় কার?
ভরাটের দায় কার? অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Dec 18, 2021 | 1:10 AM

সা য় ন্ত  ভ ট্টা  চা  র্য

একদা কবি লিখেছিলেন, ‘হাঁস ছিল, সজারু (ব্যাকরণ মানি না) / হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না’। শহর কলকাতার আনাচ-কানাচ চোখ ঘোরালে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যাবে। কীভাবে? স্রেফ এলাকার কোনও জলাভূমিতে নজর দিলেই ছবিটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এক সময়ের জলাভূমি ভরাট কখন যে হাইরাইজ় তৈরি হয়ে গেল চোখের নিমেষে তা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লেগে যাবেই। সব রাজনৈতিক দল যখন জলাভূমি রক্ষার কথা বলছে, তখন, সেই জলাভূমিই ভরাট হয়ে সেখানে শুরু হয়ে যাচ্ছে নির্মাণকার্য।

জলে-জঙ্গলে যেখানে শূন্যস্থান মিলিবে…

বাম আমল থেকেই বর্তমান শাসক আমল। জলাভূমি রক্ষায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের সদস্য বা নেতারা নির্বাচনের আগে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নির্বাচন মিটে গেলেই সেই জলাভূমি গুলি নির্মাণকার্য হওয়ার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। কলকাতার ১ থেকে ১৪৪ টি ওয়ার্ডের অবস্থা সেরকমই।

শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ দক্ষিণ শহরতলির জলাশয় ভরাট হতে হতে আজ কলকাতার বুক থেকে জলাশয় শূন্য হতে বসেছে। সম্প্রতি হাইকোর্টে জলাভূমি ভরাট সংক্রান্ত মামলায় জমা দেওয়া রাজ্য সরকার এবং কলকাতা পুরসভার নথি বলছে, ১৪৪টি ওয়ার্ডের ১৯৫টি মৌজায় গত অক্টোবর পর্যন্ত জলাশয় রয়েছে ৩৭৯০টি। যদিও প্রশাসনের একাংশের কথায়, যেভাবে বেআইনি নির্মাণ হয়ে চলেছে এবং তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মদত রয়েছে তাতে আগামী দিন সামান্য কয়েকটি বেঁচে যাওয়া জলাশয় গুলি আর থাকবে না।

কলকাতা পুরসভায় বাম আমল থেকে শুরু করে শাসকদলের বর্তমান আমলের প্রথম দিকে যেভাবে ভরাট হয়েছে জলাশয় গুলি, তাতে তো রীতিমতো তিতিবিরক্ত নগরবাসী। তবে প্রশাসন হাইকোর্টে যে তথ্য জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, কলকাতার ৩০ টি মৌজায় একাধিক জলাভূমি ভরাট এর অভিযোগে মোট ৫১৭ জনকে নোটিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ১৭টি এফআইআর করা হয়েছে। জলাশয় ভরাট রুখতে যে ধরনের উদ্যোগ বা তৎপরতা প্রয়োজন ছিল তা প্রায় দেখাই যায়নি কোন বোর্ডের আমলেই। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের প্রচ্ছন্ন মদতেই একের পর এক জলাশয় ভরাট হয়ে কলকাতার প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় থাকবে কিভাবে তা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

প্রশ্নে নিমজ্জিত…

বর্তমান শাসক দলের দাবি,  প্রথমদিকে জলাশয় ভরাট হলেও এখন তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট কড়া। যে কারণে জলাশয় ভরাট বন্ধ করা গিয়েছে। তবে কলকাতা দক্ষিণ শহরতলির বাসিন্দাদের মতে, শাসক দলের মদতেই যাদবপুর, বেহালা, জোকা, পর্ণশ্রী, টালিগঞ্জ, কুদঘাট, বাসধনি বা আরো প্রত্যন্ত এলাকায় জলাশয় ভরাট থমকে নেই। এমনকি দক্ষিণ শহরতলীর কুদঘাট এর ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডে আস্ত একটি জলাশয়ের প্রায় অনেকটা অংশ দখল করে তৈরি হয়েছে শাসকদলের দলীয় কার্যালয়।

কলকাতা পুরপ্রশাসনের যদিও  দাবি, এই ঘটনায় রিজেন্ট পার্ক থানায় এফআইআর হয়েছে। যদিও সেই অভিযোগ এরপরেও দলীয় কার্যালয় তৈরি হওয়া থমকে নেই। আবার ৭ নম্বর বরোর অধীনে থাকা ট্যাংরা, তপসিয়া, তিলজলা সহ একাধিক এলাকায় কলকাতার মধ্যে জলাশয় ভরাট হবার সংখ্যা সব থেকে বেশি। সেখানে গত কয়েক বছরের পুরসভার রিপোর্ট বলছে, প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জলাশয় কমে গিয়েছে। যা অত্যন্ত উদ্বেগের কারণ বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা। একাধিক ঘটনায় আদালতে মামলা চললেও তাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জলে জলাশয় ভরাট।

বিরোধ-বার্তা

বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ,  ২০১৫-র পুর নির্বাচনে  তৃণমূলের প্রকাশিত ২৩ পৃষ্ঠার ইস্তেহারে বলা হয়, ‘কলকাতা শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে জলাশয়ের সংখ্যা প্রায় ৩৫০০টি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই সমস্ত জলাশয়গুলির সংরক্ষণ সৌন্দর্যায়ন করে এই গুলিকে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলা হবে। এর ফলে যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা পাবে, আবার বেকার যুবক-যুবতীর উপার্জনের সুব্যবস্থা হবে এবং মহানগরী আরও রূপে গুণে সুন্দরতম হয়ে উঠবে।’

প্রসঙ্গত, ২০১০-এ কলকাতায় জলাশয় ছিল প্রায় ৭২০০টি। অর্থাৎ ২০১০-২০১৫- পাঁচ বছরে প্রায় ৪ হাজার জলাশয়ের দফারফা হয়ে গিয়েছে। ২০২১-এ রাজ্য প্রশাসনের রিপোর্টে বলা হচ্ছে কলকাতায় জলাশয় রয়েছে  মাত্র ৩৭২০ টি। অর্থাৎ একের পর এক যে জলাশয় ভরাট হয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।

তথ্যতালাশেও নিরাশা!

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ‘এনভায়রমেন্ট রিপোর্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ২০২১’-এর প্রকাশিত রিপোর্টে প্রথম খণ্ডের ২১৬ নম্বর পৃ্ষ্ঠায় রাজ্য সরকার জেলাগুলিতে পুকুর, জলাভূমি, জলাধারের তথ্য় দিয়েছে। সেখানে রয়েছে কলকাতার নাম। কিন্তু, তার পাশে কী লেখা রয়েছে?  ‘নো ডেটা।’। অর্থাৎ এই তথ্যই বলে দিচ্ছে কলকাতার জলাশয়ের অবস্থা কী! পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরকমিশনারের ৩৯ নম্বর নির্দেশিকায় এই বিষয়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, এই বিশেষ সেলের কাজ হবে বেআইনিভাবে জলাশয় ভরাট আটকানো, পরিদর্শন করা, জলাশয় পরিষ্কার করা এবং কলকাতা কর্পোরেশন এলাকায় বিভিন্ন ওয়ার্ডে বেআইনিভাবে জলাশয় ভরাটের সমস্যার সমাধান করে তা ফের পরিষ্কার করানো।

জলেই  জমে অন্ধকার!

কলকাতার ভিতর এই তথ্যগুলো শুধুমাত্র জলাশয় এর। এবার দেখা যাক পূর্ব কলকাতার জলাভূমির চিত্র। ১২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জলাভূমি বিশ্বে কোথাও নেই। সেই জলাভূমির প্রায় ৪০ শতাংশ বুজিয়ে বেআইনি নির্মাণ সেরে ফেলা হয়েছে। থানায় অভিযোগ জানানো হলেও পুলিশ কোনও ভূমিকা পালন করেনি। পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বেআইনি দখলদারি ও নির্মাণের মাধ্যমে ক্রমেই ভরাট হয়ে আসছে। গত ১৫ বছরে কী ভাবে সেই জলাভূমি ভরাট হয়েছে তা উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে। এর পরেই জলাভূমি সংরক্ষণে ও বেআইনি নির্মাণ বা দখলদার সরিয়ে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত।

সেই সংক্রান্ত একটি টাস্ক ফোর্স তৈরি ও জলাভূমি সংরক্ষণে নির্দিষ্ট ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরিরও নির্দেশ দিয়েছিল। রাজ্য সরকার জাতীয় পরিবেশ আদালত অ্যাকশন টেকন রিপোর্ট জমা দেয়, তাতে দেখা গিয়েছে, জলাভূমি ভরাট সংক্রান্ত অভিযোগ ৩৫৭টি। অথচ মাত্র পাঁচটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এই শম্বুক গতিতে যদি জলাভূমি সংরক্ষণে পুলিশ-প্রশাসন পদক্ষেপ করে, তা হলে রামসার কনভেনশন অনুযায়ী ঘোষিত এই ‘আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি’ কি আদৌ বাঁচানো সম্ভব হবে?

কলকাতার ‘কিডনি’

কলকাতার পূর্ব প্রান্তে বিপুল জলাজমি, চলতি কথায় ‘ভেড়ি’, আসলে কলকাতার ভৌগোলিক ‘কিডনি’। প্রতি দিন প্রায় ৭০০ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য জলকে সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির সহায়তায় প্রাকৃতিক উপায়ে জলজ বাস্তুতন্ত্রের শৈবাল ও মাছেরা নিজেদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে শোধন করে ফেলে এই জলাভূমিতে। ফলে আমাদের অজানতেই কলকাতা বেঁচে যায় জলদূষণ থেকে। পাশাপাশি, মাছের প্রাত্যহিক জোগানের ২০% আসে এই জলাভূমি থেকে। সেই জলাভূমি কে সংস্কার করবে এবং ভরাট ঢুকতে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করার কথা জানিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্য কে টাকা দিয়েই সংস্কারের কাজ করবে তা নিয়ে টানাপড়েন এর জন্য সেই ভরাট রুখে দেবার কাজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

রাজ্যের বিদায়ী মেয়র ফিরহাদ হাকিম যদিও জানিয়েছেন, জলাভূমি বুজিয়ে অবৈধ নির্মাণে রাজ্যের কোনও সায় নেই। বরং এই অপরাধে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হবে। পাল্টা বিজেপির তরফে তীব্র কটাক্ষ ধাবিত হয়েছে শাসক শিবিরের দিকে। অভিযোগ, ঘাসফুলের নেতারাই এই অবৈধ নির্মাণকার্যের সঙ্গে যুক্ত। পরিবেশবিদদের মতে, এভাবে যদি চলতেই থাকে তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে বাস্তুতন্ত্রে। ফলে একদিকে যেমন নানা জীবের অকাল বিলুপ্তি ঘটবে তেমনভাবেই পরিস্থিতি সঙ্গীন হবে মানুষের জন্যও। তাহলে আরও কড়া হাতে দমন করতে হবে এই অবৈধ নির্মাণ। কিন্তু, সেই সুদিন আসবে কবে? উত্তরের আশায় তিলোত্তমা।

আরও পড়ুন: Primary Literacy in West Bengal: সেরা হয়েও সন্দিহান! প্রাথমিক শিক্ষায় শীর্ষে থেকেও এখনও পিছিয়ে বাংলা