সবার ‘ফ্রি টিকিট’ চাই, পয়সা দিয়ে নাটক দেখার অভ্যেস চলে গিয়েছে… কেয়া ভাই?: সৌরভ শুক্লা
না, নয়। একটা প্রশ্ন আমি রাখতে চাই, এগারো হাজার টাকার টিকিট কেটে আপনি কোনওদিন কোনও থিয়েটার দেখবেন? নিশ্চয়ই নয়।
কখনও তিনি ‘পিকে’ ছবিতে ভণ্ড তপস্বী আবার কখনও বা ‘লগে রহো মুন্নাভাই’ ছবির ‘বটুক মহারাজ’। তিনিই আবার ‘বরফি’ ছবির সেই মজাদার পুলিশ অফিসার সুধাংশু দত্ত। তিনি সৌরভ শুক্লা। প্রায় দু’বছর পর ‘শ্বশুরবাড়ি’ কলকাতায় এসেছেন তিনি। শুধু আসেনইনি, শুরু করে দিয়েছেন শুটও। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘মনোহর পাণ্ডে’তে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন তিনি। শুটিংয়ের ফাঁকে TV9 বাংলার সঙ্গে মন খুলে কথা বললেন তিনি। বাছলেন প্রিয় অভিনেতা, পছন্দের ওয়েব সিরিজ।
বাংলা বলতে পারেন? পারি অল্প। বুঝতে পারি।
আপনি তো বাংলার জামাইবাবু
(হেসে) হ্যাঁ, আমার স্ত্রী বাঙালি। আমার মা বাঙালি। যদিও জামাইষষ্ঠীতে নেমতন্নই পাচ্ছি না। শুকনো সাক্ষাৎকারই নিয়ে যাচ্ছেন সবাই…
কেমন দেখছেন কলকাতাকে? যেমনটা দেখেছিলাম দু’বছর আগে তেমনটাই। যতদূর মনে পড়ছে ২০১৯-এ শেষ এসেছিলাম কলকাতায়। তারপর আর আসা হয়নি।
কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ল? না, সেই একই কলকাতা। ‘স্ট্রেঞ্জ’ তো কিছুই মনে হল না। সেই একই অনুভূতি, একই ভাইবস… যে ভাইব দু’বছর আগেও পেয়েছিলাম। অনেকটা ঘরে ফেরার মতো।
(একটু থেমে) যদিও পরিবর্তন তো স্বাভাবিক। জীবন তো এ ভাবেই চলে…
যে ছবির জন্য আপনি কলকাতায় সেই ছবির পরিচালকও কিন্তু বাঙালি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি, কৌশিক আপনাকে বাছলেন না আপনি কৌশিককে?
আমি বাছিনি। কৌশিকই আমাকে বেছে নিয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন অভিনেতা বুঝি পরিচালককে বেছে নেন, এমনটা নয় কিন্তু মোটেই। পরিচালক পছন্দমতো অভিনেতা বাছেন, অভিনেতার স্ক্রিপ্ট এবং চরিত্র ভাল লাগলে পরিচালককে বেছে নেন।
গঙ্গাপাড়ের অবাঙালিদের নিয়ে ছবি, রয়েছে মাঝবয়সী মধ্যবিত্ত প্রেমও। আপনার চরিত্রটি কেমন?
(সাবধানী গলায়) চরিত্র নিয়ে এখনই কিছু বলতে পারব না। ওটা কৌশিকের কল। তবে এটুকু বলতে পারি সবাই জানেন কৌশিক রিয়্য়ালিস্টিক ছবি বানান। এই ছবিটিও তাই। রিয়্য়ালিস্টিক, সিরিয়াস… তাই বলে এই না যে গোটা ছবি জুড়েই গুরুগম্ভীর ভাব রয়েছে। হিউমারও কিন্তু রয়েছে চুটিয়ে।
ওঁর (কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) ছবি দেখেছেন? খুব বেশি বাংলা ছবি দেখিনি আমি। এখনও পর্যন্ত কৌশিকেরও কোনও ছবি আমার দেখা হয়নি। তবে আমি ওঁর ব্যাপারে অনেক শুনেছি। শুনেছি কত বড় মাপের পরিচালক। যেহেতু পরিবারের অনেকেই বাঙালি তাই ওঁর নামের সঙ্গে ভীষণভাবেই অবগত আমি। ওঁর কাজ সম্পর্কেও শুনেছি।
আপনি থিয়েটারের মানুষ, সেখান থেকে বড় পর্দা… থিয়েটারকে অবলম্বন করে কি পেট চালানো সম্ভব নয়?
না, নয়। একটা প্রশ্ন আমি রাখতে চাই, এগারো হাজার টাকার টিকিট কেটে আপনি কোনওদিন কোনও থিয়েটার দেখবেন? নিশ্চয়ই নয়। একটা সোজা হিসেব বলতে চাই, একটা তিন ঘণ্টার সিনেমা একদিনে প্রায় ৩০০০ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়। প্রতিটা প্রেক্ষাগৃহে যদি গড়ে ৫০০ করেও দর্শক দেখেন, তাহলে ৫০০-কে ৩০০০ দিয়ে গুণ করুন। কত হয়? দেড় লক্ষ। এ বার যদি প্রতিটি টিকিটের দাম ২০০ টাকাও হয়, তাকে দেড় লক্ষ দিয়ে গুণ করলে সংখ্যাটা যা হবে তা একটামাত্র শো-এর আয়। এ বার এ রকম যদি দিনে পাঁচটা শো হয় প্রতিটা প্রেক্ষাগৃহে, তাহলে দিনের শেষে সিনেমা থেকে আয়টা ভাবুন।
(উত্তেজিত) অন্যদিকে থিয়েটারে কিন্তু এক দিনে একটাই শো। একটাই জায়গায়। তাই যদি থিয়েটারকে পেশা বানাতে হয়, তাহলে আপনাকে একটা টিকিট ১৫ হাজার অথবা কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে কিনতে হবে। সেটা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয় সম্ভব নয়।
আর বিদেশে?
বিদেশে ব্যাপারটা অন্য। আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রডওয়ে থিয়েটারে যান। নাটকের একটি টিকিটের মূল্য সেখানে ২৫০ ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা আঠেরো হাজারের বেশি। তাই সেখানে এই সমস্যায় নেই। এ দেশে আর একটা সমস্যাও রয়েছে, মানুষ এখানে টিকিট কেটে নাটক দেখতে ভুলে গিয়েছে। সবাই ভাবে যদি ফ্রি টিকিট পাওয়া যায়। কেয়া ভাই? বাড়িতে যখন গ্যাস দিতে আসে তখন গ্যাসওয়ালা কি বলে, “আপনি থিয়েটার করেন, তাই আপনাকে ফ্রিতে গ্যাস দেব?” গাড়ি কিনতে গিয়ে থোড়াই দোকানে বলে, “ও আপনি থিয়েটার করেন, বেশ তবে ১০ শতাংশ ছাড়”। পেট্রোল কিনতে গেলেও কি ‘থিয়েটারের কার্ড’ দেখিয়ে ৫০ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়?
ওটিটির রমরমায় অনেক মঞ্চাভিনেতা পরিচিতি পেয়েছেন … আপনি একমত? যদি হন, তবে আরেকটা প্রশ্ন, কতটা দেরি হল পরিচিতি পেতে?
একটা কথা বলব, স্টেজ অ্যাক্টর বা মঞ্চাভিনেতা বলে কিছু হয় না। একটু দেখবেন সমস্ত মঞ্চাভিনেতাকেই কিন্তু কখনও না-কখনও সিনেমায় বা টেলিভিশুনে কাজ করতে হয়েছে। ওটিটি একটি মাধ্যম। নতুন মাধ্যম। ব্যস। আমাকেই প্রশ্ন করুন, সৌরভ শুক্লা কি থিয়েটার আর্টিস্ট? আমি বলব ‘না, নয়’। তার মানে কি আমি মঞ্চে অভিনয় করি না? করি তো। আমরা শুধু অভিনেতা। আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন ওটিটি ছিল না। সিনেমার সাপোর্টে রুজিরুটির জোগান করতে হয়েছে। তাই ‘পরিচিতি নয়’, ওয়েব সিরিজের জন্য অনেক অভিনেতার প্রয়োজন এখন… পরিচালক থেকে অভিনেতা… নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন কাজ নিয়ে। তাই ওয়েব সিরিজের জন্য অভিনেতারা পরিচিতি পাচ্ছেন—এ কথা ঠিক নয়। বরং বলা যেতে পারে সুযোগ পেয়েছেন। ওয়েব সিরিজের আগেও বহু মানুষ যাঁরা থিয়েটার করেছেন, তাঁরা কিন্তু পরিচিতি পেয়েছেন। অন্য দিকে, ওটিটিতে এমন অনেক সফল অভিনেতা রয়েছেন যাঁদের তথাকথিত থিয়েটারের স্কুলিং নেই।
ওটিটির কথা উঠল, আপনার দেখা পছন্দের ওয়েব সিরিজ কোনগুলি ? অনেকগুলো। ২০১৯-এ মুক্তি পেয়েছিল ‘দিল্লি ক্রাইম’ (নেটফ্লিক্স)। আই রিয়েলি লাভড ইট। অনেক দিন পর্যন্ত তার রেশ থেকে গিয়েছিল। এ ছাড়া ‘পঞ্চায়েত’ (অ্যামাজন প্রাইম)-ও আমার বেশ ভাল লেগেছিল।
আপনাকে যদি এই মুহূর্তে ওটিটির সেরা তিন অভিনেতা-অভিনেত্রী বেছে নিতে হয়, কাদের বাছবেন?
এই মিডিয়া র্যাঙ্কিংটাই আমার পছন্দ নয়। সবাই ভুলেই যায়, নাম্বার ওয়ান, টু, থ্রি অভিনেতা হয় না। ছবি হয়। আপনি একজন অভিনেতাকে ভালবাসেন কারণ আপনি ছবিটি ভালবেসেছেন। আপনি যদি ‘জলি এলএলবি’ ছবিতে সৌরভ শুক্লাকে ভালবেসে থাকেন তবে তা কিন্তু সৌরভের জন্য নয়, ছবিটির জন্য। এরকম শর্ত কেন হবে যে আমার কোনও একজন অভিনেতাকেই কন্ডিশানালি পছন্দ করতে হবে?
বেশ, র্যাঙ্কিং বাদ দিলাম, নিউএজ অভিনেতাদের মধ্যে পছন্দের কারা রয়েছেন? (একটু ভেবে) অনেকেই রয়েছেন। আই লাভ রণবীর কাপুর। ‘বরফি’ ছবিতে ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি আমি। আয়ুষ্মান খুরানাও বেশ পছন্দ। এ ছাড়াও রাজকুমার (রাও) রয়েছে। এ রকম প্রচুর অভিনেতা রয়েছেন। এই যেমন আমি একটি ওয়েব সিরিজে কাজ করছি, সেখানে একজন ভীষণ ইয়ং অভিনেতা রয়েছেন, নামটা মনে পড়ছে না, তাঁকেও বেশ ভাল লেগেছে আমার। আমি সিনেমার ভক্ত, অভিনেতার নই। আমি যদি একটা ছবিকে ভালবাসি, যদি সেই ছবিতে কোনও নির্দিষ্ট অভিনেতা ভাল অভিনয় করেন, তাহলে আমার তাঁকে ভাল লাগবে।
অনেকেই জানেন না যে সৌরভ শুক্লা শুধু অভিনেতা নন, তিনি পরিচালক, চিত্রনাট্যকার… সেই সৌরভ শুক্লাকে আর দেখা যাচ্ছে না কেন? এর পিছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এই মুহূর্তে হাতে দু’টো ওয়েব সিরিজ রয়েছে। এই ছবিটি রয়েছে। এগুলো আগে শেষ করা দরকার। কারণ আপনি যখনই ছবি পরিচালনা করবেন, তখন আর কিছুই করা যায় না। একটি ছবির জন্য আমায় ৮/৯ মাস দিতেই হবে। মানুষ আমাকে অভিনেতা হিসেবে এত ভালবেসেছেন যে কাজের অফার এসেই গিয়েছে। যদিও একটা কথা বলতে চাই, ছবি পরিচালনার কথা কিন্তু আমি ভেবেছিলাম। ২০২০-র ১৫ জানুয়ারি সেই ছবির শুট শুরু হওয়ার কথা ছিল।
তারপর? তারপর আর হয়নি। কারণ সেই মুহূর্তে কোভিডের দামামা বেজে গিয়েছে সারা বিশ্বজুড়ে… নানা কারণে আটকে গিয়েছে।
লকডাউন শিথিল হতে আবার শুরু করলেন না কেন? সিনেমাটাতে আবহাওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বরফের মধ্যে শুটের প্রয়োজন। জুলাই-সেপ্টেম্বরে সেটা পেতাম না। আর তার পরেই সব অভিনয়ের কাজ ঢুকতে শুরু করল। তবে পরের বছর জানুয়ারি থেকেই আবার শুট শুরু করব আমি।
সম্প্রতি জন আব্রাহাম একটি মন্তব্য় করেছেন, ”সেলিব্রিটিদের সব ব্যাপারে মন্তব্য করা উচিত নয়। জনের ভাষায় বললে সেলেবদের ‘ফ্ল্যাগ বেয়ারার’ হওয়ার দরকার নেই।” সহমত আপনি?
দেখুন, যা আপনি জানেন, যা আপনি অনুভব করেন, আপনার তা বলা উচিত। যা আপনি জানেন না, যা আপনি মিন করেন না, তা বলা উচিত নয়। শুধু সেলিব্রিটির ক্ষেত্রেই যে কথাটি প্রযোজ্য, তা নয়। ইট ইজ ফর এভরিওয়ান। আজকাল তো সবাই ফেসবুক সেলিব্রিটি। না জেনেই মানুষ অনেক কিছু বলে ফেলে। পাবলিক ফোরামে যে কোনও মতামতই সঠিক তথ্যসমৃদ্ধ হওয়া উচিত। একটা উদাহরণ দিচ্ছি, যে কেউ কিন্তু একটি ছবিকে পছন্দ অথবা অপছন্দ করতে পারেন। কিন্তু সবাই কিন্তু ছবির সমালোচক হতে পারেন না। ইংরাজিতে একটা শব্দ আছে ‘ক্রিটিক’। মনে রাখতে হবে সবাই ক্রিটিক নন। কারণ একজন ক্রিটিকের ক্রিটিসিজম করার এথিক্স রয়েছে। আপনার উদাহরণ দিচ্ছি, যে কেউ কোনও বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন, তাই বলে কি সবাই সাংবাদিক?
তার মানে কি একজন অভিনেতা বাজেট বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে মন্তব্য করবেন না?
ক্রিটিসিজমের কিন্তু নিজস্ব মূল্যবোধ, নীতিবোধ রয়েছে। ড্রয়িংরুমে বসে আপনি যা ইচ্ছে নিয়ে মন্তব্য করুন না। আপনি বলুন, ‘সচিন খেলতেই পারে না ভাই, কী বাজে শট খেলল।’ তার মানে কি সচিন বাজে খেলেন? কিন্তু আবারও বলছি পাবলিক ফোরামে যদি যথেষ্ট জ্ঞান না থাকে, সেই বিষয়ের উপর তবে তা নিয়ে মন্তব্য করা উচিত নয়। যখনই কোনও ঘটনা হয়, রাজনৈতিক অথবা বিশেষ কোনও ঘটনা… (থেমে) এই বাজেটের কথা যেমন বললেন, ফোন আসছে আমার কাছে… “স্যার, আপনার বাইট দরকার। স্টুডিয়োতে আসতে পারবেন? বলবেন প্লিজ এই বার বাজেটে কী হবে?”
আরে আমায় ফোন করছেন কেন? আমি তো অভিনেতা। একজন ইকোনমিস্টকে ফোন করুন, তাঁর এই ব্যাপারে জ্ঞান রয়েছে। আমি যা করি সে ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমার শিল্পের ব্যাপারে আমায় প্রশ্ন করুন, আমার সৃষ্টির ব্যাপারে জানতে চান… আমি বলব। আপনি যদি কোনও পলিটিশিয়ানকে অ্যাক্টিংয়ের টেকনিক নিয়ে প্রশ্ন করেন, তবে তিনি কী উত্তর দেবেন? সেটা তো তাঁর এরিয়া নয়। তবে হ্যাঁ, একই সঙ্গে কোনও অভিনেতা যদি রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হন তবে তা আলাদা ব্যাপার।
সবশেষে একটা প্রশ্ন, সৌরভ মানে তো সুগন্ধ, সুবাস। সৌরভ শুক্লার জীবনে সুগন্ধ বয়ে নিয়ে আসে কোন জিনিস? বেশ ফিলোজফিকাল প্রশ্ন। কী বলি বলুন তো? জীবন…আমার জীবনই আমার জীবনে সুগন্ধ বয়ে নিয়ে আসে।
গ্রাফিক্স এবং অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস