Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

Interview: ইঁদুর দৌড়ে বিশ্বাসী নই, কিন্তু গডফাদার ছাড়া টিকে থাকতে হলে স্ট্রাগল থাকবেই: অনিকেত মিত্র

Interview: ‘দিল বেচারা’। সুশান্ত সিং রাজপুতের শেষ ছবি। আর তাঁর প্রথম ছবি। তিনি অর্থাৎ অনিকেত মিত্র। এই বঙ্গতনয় গত চার বছরে যশরাজ, ধর্মা, সঞ্জয় লীলা ভনশালী—বলিউডের তাবড় প্রোডাকশন হাউজ়ের সঙ্গে কাজ করে ফেলেছেন।

Interview: ইঁদুর দৌড়ে বিশ্বাসী নই, কিন্তু গডফাদার ছাড়া টিকে থাকতে হলে স্ট্রাগল থাকবেই: অনিকেত মিত্র
Follow Us:
| Updated on: Nov 06, 2021 | 11:36 AM

‘দিল বেচারা’। সুশান্ত সিং রাজপুতের শেষ ছবি। আর তাঁর প্রথম ছবি। তিনি অর্থাৎ অনিকেত মিত্র। এই বঙ্গতনয় গত চার বছরে যশরাজ, ধর্মা, সঞ্জয় লীলা ভনশালী—বলিউডের তাবড় প্রোডাকশন হাউজ়ের সঙ্গে কাজ করে ফেলেছেন। সরকারি আর্ট কলেজের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট প্রাক্তনীর কাজটা ঠিক কী? বলিউড কতটা পেশাদার? আরব সাগরের পাড়ে ফিল্ম সিটির ফ্ল্যাট থেকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন TV9 বাংলাকে।

১) Studied Graphic & Communication Design নিয়ে Govt. College of Art & Craft থেকে পড়াশোনা করেছেন। পড়াশোনা কী ভাবে পেশাদার জীবনে কাজে লাগাচ্ছেন?

আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে কোন স্ট্রিম নিয়ে পড়াশোনা করব, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে সময় আমরা যারা সদ্য স্কুল পাশ করেছি, তাদের কাছে ধারণা স্পষ্ট ছিল না। সকলের ধারণা থাকে আর্ট কলেজ মানেই পেইন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করব। কিন্তু প্রত্যেকটা আর্ট কলেজের আলাদা-আলাদা স্ট্রিম থাকে। যেহেতু ছোট থেকে যে সব বিজ্ঞাপন টিভিতে দেখতাম, সিনেমাহলে সিনেমা দেখার আগে যে সব কর্মাশিয়ালস আসত, সেগুলো খুব এক্সাইট করত। তখন খোঁজ নিতে শুরু করি, যদি এই বিষয়ের উপর পড়াশোনা করতে হয়, তা হলে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা উচিত। সেখান থেকে আর্ট কলেজে গ্রাফিক্স ডিজাইন অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড আর্ট নিয়ে ভর্তি হই। তারপর সেখান থেকে পাশ করার পর প্রথমে কলকাতায় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় যোগ দিই। সেখানে কাজ করতে-করতেই কলেজ ক্যাম্পাসিং হয়েছিল। সেখান থেকে একটি তথ্য়প্রযুক্তি সংস্থায় ব্র্যান্ড ভিজ়ুয়ালাইজ়ার হিসেবে জয়েন করি। সেখানে মূলত বিদেশি ক্লায়েন্টদের জন্যই কাজ করতাম। এখনও আমার কাজের যা পরিধি, তাতে গ্রাফিক্স ডিজ়াইন অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড আর্টের বিরাট অবদান রয়েছে। সেখান থেকে ডিজ়াইন স্কিল, কমিউনিকেশন স্কিল, ডেলিভারি প্রসেস ইত্যাদির জিনিসগুলোর সো কলড ইন্ডাস্ট্রির প্রফেশনালিজ়ম অনেকটা শিখেছিলাম।

২) হঠাৎ করেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তো আপনি। বাড়িতেও কেউ জানতেন না। সে সব দিনের কথা ফেসবুকেও লিখেছিলেন। চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন?

আমি তথ্য়প্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেছি চার বছর। তারপর তিন-সাড়ে তিন বছর আর একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেছি। কলকাতায় এই দু’টো সংস্থায় চাকরি করা মানে স্বচ্ছল জীবন যাপন। মাসের শেষে মোটা মাইনে আছে। সব কিছুই ছিল। কিন্তু ক্রিয়েটিভ খিদেটা মিটছিল না। তাই পাগলের মতো রাস্তা খুঁজছিলাম, আরও ভাল কিছু করতে হবে। আমার ভিতরে অনেক কিছু আছে, কিন্তু কিছুই বের করতে পারছি না। আমাদের বয়সের ছেলে-মেয়েরা হাতে একটা কাজের অপশন নিয়ে তারপর চাকরি ছাড়ে। দ্বিতীয় তথ্য়প্রযুক্তি সংস্থার সঙ্গে আমার স্বার্থের সংঘাত এমনভাবে হল যে, আমি রাতারাতি চাকরি ছেড়ে দিলাম। সে সময় গোটা পরিবারে কেউ জানত না আমার চাকরি নেই। সাত-আট মাস কোনও কাজ ছিল না। কলকাতায় পাগলের মতো কাজ খুঁজছিলাম সে সময়। কিন্তু কারও কাছে কোনও উত্তর নেই। একটা সময়ের পর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের ছেলে কতদিন আর চাকরি ছাড়া থাকব, কারণ বাড়ির প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা তো থাকেই। তখন আমার মনে হয়েছিল দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছিল। আর কিছু করার নেই। সে সময় আর একটি তথ্যপ্রযুক্তি থেকে সুযোগ পাই। তারা আমাকে মুম্বইয়ে যাওয়ার অফার দিয়েছিল। কিন্তু সেউ কিউবিকল জব করতে হবে। মনে হল, আর কত আইটি প্রেজেন্টেশন বানাব? যে দিন ফাইনাল ইন্টারভিউ, সে দিন অফিস থেকেই আমার স্ত্রীকে ফোন করি, ‘আমার দমবন্ধ লাগছে’। ও বলে, ‘তুমি এখনই বেরোয়। তোমাকে জয়েন করতে হবে না’। ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যাই নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে। ওটা আমার পুরনো পাড়া। সেখানে গিয়ে শ্মশানে বসে ছিলাম সারা দুপুর। মন শক্ত করতে হবে। এত সহজে হাল ছাড়লে চলবে না। তার কয়েকদিন পরই ফক্সস্টার থেকে ফোন আসে। মুম্বই চলে এস…।

Aniket-inside-1

৩) চাকরি ছেড়ে দিতে ভয় লাগেনি?

একটা সময় মনে হয়েছিল, চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। এ বার হাতে অফুরন্ত সময় থাকবে। বাড়িতে প্রচুর ছবি আঁকব। চাকরি ছেড়ে প্রথম দু’-তিন দিন ভাল ছিলাম। তারপর ধীরে-ধীরে মনের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করে, অনিশ্চয়তা কাজ করতে শুরু করে। বিশ্বাস করুন, ওই সময়ে একটা ছবিও আঁকতে পারিনি। ঘুম হত না রাতে। ভাবতাম, এটা কী করছি? ঠিক করছি কি না। সবথেকে বেশি যে প্রশ্ন মনে আসত, তা হলঃ আমাদের মতো পরিবারের ছেলে যাদের এত কষ্ট করে মা-বাবা পড়াশোনা শিখিয়েছে, তাদের জন্য এই অনিশ্চয়তার জীবন—এটা কোথাও বিলাসিতা নয় তো? ভুল করছি না তো? আমি যে পথে পা বাড়িয়েছি, সেখান থেকে ফেরার কোনও রাস্তা আদৌ আছে কি? কারণ আমাদের কাছে ‘প্ল্যান বি’ বলে কিছু থাকে না। সব কিছুই ‘প্ল্যান এ’ হতে হবে। কারণ আমার বাবার অবসরের সময় আমি মাধ্যমিক দিচ্ছি। সাধারণ সরকারি কর্মচারী ছিলেন। তাঁর পেনশনও সাধারণ। দাদা ছিল। আমি জানতাম, এ বার পড়াশোনার পিছনে আর বেশি কিছু খরচা ভাবতে পারব না। সে জন্য সরকারি আর্ট কলেজে আমি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া সত্ত্বেও মাস্টার্স ডিগ্রি করতে পারিনি। কারণ তখন আমার প্রায়োরিটি ছিল পরিবার। যে ভাবে হোক ফ্যামিলির পাশে দাঁড়াতে হবে। সে জন্যই চাকরিতে জয়েন করা। না হলে আরও একটু পড়াশোনা করতে চেয়েছিলাম।

৪) যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, আম বাঙালি সেই বিষয় নিয়ে পড়তে বা সেই পেশায় কাজ করাটা এখনও ঝুঁকির মনে করে। আপনার পরিবার থেকে সমর্থন ছিল?

আমার বাড়ির দৃশ্য ছিল আগেকার দিনের বাংলা ছবির মতো। আমাদের অনেক বড় পরিবার। বাবারা পাঁচ ভাই, চার বোন। মা বড় বউ। প্রত্যেক অনুষ্ঠানে সবাই একত্রিত হত। মা বহরমপুরের মেয়ে। কলকাতায় বিয়ে করে এসে গান ছেড়ে দিতে হয়েছিল। খুব ভাল গান গাইতেন। স্বর্গীয় বিমান মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী ছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এক সময় মা গান গাইত। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে গান ছেড়ে দিতে হয়েছিল। এটা অনেক বাড়িতেই দেখা যায়। মাকে যখন প্রথম আমার আঁকার প্রতি ভালবাসার কথা জানাই, মা বলেছিল, ‘আমার গান গিয়েছে, আমি তোর আঁকা যেতে দেব না। পাশে কেউ থাকুক না থাকুক, আমি থাকব।’ সে সময় আমার মনে আছে, আমি উচ্চ-মাধ্যমিক দিয়েছি। বাবাকে নানা লোক বলছে, এই কলেজে, ওই কলেজে ভর্তি করে দাও। বাবার মন রাখতে বিদ্যাসাগর কলেজে ইংলিশ অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার মন তো ছটফট করছে। লুকিয়ে-লুকিয়ে আর্ট কলেজে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। শুধু মা জানত। আর দাদা অল্প-অল্প জানত। তারপর হঠাৎ করে যখন আর্ট কলেজে সুযোগ পেয়ে গেলাম, তখন বাবাকে বললাম, ‘আর্ট কলেজে পড়তে যাচ্ছি। তুমি আর বাধা দিও না’।

Aniket-inside-2

৫) বাবা মেনে নিয়েছিলেন?

বাবার কাছে প্রথমে ধাক্কার মতোই ছিল বিষয়টা। কারণ সকলের তো আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে অন্য রকম ধারণা আছে। সে সময় মা ভীষণভাবে পাশে ছিল। কারণ সে সময় পরিবারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কথা শুনতে হয়েছেঃ ‘… এ বার তো ছেলে নেশা-ভাঙ করে পড়ে থাকবে!’ এই ধারণাগুলো যে কতটা ভ্রান্ত, তা আর্ট কলেজে না ঢুকলে বুঝতে পারতাম না। চারটে বছর প্রচণ্ড স্ট্রাগল করতে হয়েছে। কারণ আমাদের কলেজের খরচ নেই। কিন্তু মেটিরিয়াল কস্ট বেশি। সেই খরচটা চালাতে হয়েছিল। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ফার্স্ট ইয়ার পড়াশোনা করি। সেকেন্ড ইয়ার থেকে চাকরি করব। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করতাম। সকালটা কলেজ। বিকেলে বিজ্ঞাপন দফতরে কাজ করতাম। নিজের পড়ার খরচ নিজে জোগাড় করতাম। আর রেজ়াল্ট ভাল হত বলে স্কলারশিপ পেতাম প্রতি বছর।

৬) পর্দার পিছনে থাকা পেশাদারদের কাজ সম্পর্কে সাধারণ দর্শকের খুব বেশি ধারণা থাকে না। একটা ছবির সঙ্গে আপনি কী ভাবে জড়িয়ে থাকেন? আপনার কাজ কী ভাবে ছবির মধ্যে দেখবেন দর্শক?

আমি যে সব ছবিতে কাজ করি, সেখানে প্রধান ভূমিকা থাকে স্টোরি বোর্ড আর্টিস্ট এবং কনসেপ্ট আর্টিস্টের। স্টোরি বোর্ড আর্টিস্টের কাজটা কী, আগে বলছি। ধরা যাক, একটা নির্দিষ্ট দৃশ্য শুট করা হবে। কোনও অ্যাকশন সিন বা ভিএফএক্স হেভি সিন আছে। সেটা শুট করার আগে পুরো টিমের ধারণা যাতে এক থাকে, তার জন্য পরিচালকের থেকে ব্রিফ নিয়ে পুরো দৃশ্যটা হাতে এঁকে ফেলি। পাতার পর পাতা হাতে আঁকা থাকে দৃশ্যটা। ডিরেক্টর, সিনেমাটোগ্রাফার, আর্ট ডিপার্টমেন্ট, এডিটর, অভিনেতা, অভিনেত্রী সকলে ক্লিয়ার হয়ে যান কী করতে হবে। কী শুট হবে, তার আইডিয়া করার জন্য প্রথম ভিজ়ুয়াল হল স্টোরি বোর্ড।

৭) প্রথম এই কাজটার সুযোগ কী ভাবে পেয়েছিলেন?

এই কাজটার প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন মুকেশ ছাবরা, যিনি বলিউডে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে বিখ্যাত। প্রথম একটি অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেখানে আমার স্টোরি বোর্ডের একটা প্যানেল দেখেছিলেন। ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর প্রথম ছবি ‘দিল বেচারা’র জন্য যে আমাকে প্রায় দু’-তিন বছর পর চাইবেন, সেটা ভাবিনি। ‘দিল বেচারা’ সুশান্ত সিং রাজপুতের শেষ ছবি। আমার প্রথম ছবি। ওই ছবিটা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন, প্রতিটা ফ্রেম, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার আঁকা।

Aniket-inside-3

৮) আর কনসেপ্ট আর্টিস্টের কী দায়িত্ব?

কনসেপ্ট আর্টিস্টের কাজ হল, ধরা যাক কোনও একটা দৃশ্য কল্পনা করা হচ্ছে। কোনও বড় জায়গায় দু’জন যোদ্ধা লড়াই করছেন। চারদিকে হাজার-হাজার মানুষ। কেন্দ্রস্থলে রাজা বসে আছেন। এই দৃশ্যে অনেক কিছু এনগেজড। অত হাজার মানুষ তো হয় না, ভিএফএক্স দিয়ে কভার করতে হয়। কিন্তু অত বড় জায়গা তৈরি হবে, দু’টো মানুষ লড়াই করছেন, সেটা কেমন দেখতে হবে সেটা প্রথম ভিসুয়ালাইজ় করে এঁকে ফেলার দায়িত্ব নেন একজন কনসেপ্ট আর্টিস্ট। যেটা দেখে ক্লিয়ার হয়, একটা সেট কত বড় হতে পারে, সেই সেট তৈরির পিছনে কত খরচ হবে, কী-কী মেটিরিয়াল দিয়ে তা তৈরি হবে, কোন-কোন আর্কিটেকচার সেই সেটে ব্যবহার হবে… এই কাজের জন্য আমাকে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। কারণ কিছু ক্ষেত্রে খুব রিয়ালিজ়মের দিকে চলে যাই। সেক্ষেত্রে ইতিহাসটা জানতে হয়। কোন পিলার, কোন চাঁদোয়া ব্যবহার করব, কী ধরনের কাপড় ব্যবহার করব, সেটা ইতিহাস থেকে কুড়িয়ে নিতে হয়।

৯) বলিউড ইন্ডাস্ট্রির গ্র্যাঞ্জার, পেশাদারিত্ব কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

বলিউডে কাজ করব, সেই স্বপ্ন বা সাহস কোনওদিন ছিল না। কারণ কলকাতা থেকে দেখে মনে হত, অন্য গ্রহের গল্প। বলিউডে হঠাৎ করেই কাজ শুরু করি। এখানে আসার পর দেখালম, মানুষের থেকেও ট্যালেন্টকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘বাহুবলী’ ভারতে হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই দু’টো ফিল্ডের কাজ বেড়ে গিয়েছে। লোকে প্রচুর এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করছে। প্রচুর মানুষ একটা কাজে ইনভলভড হচ্ছেন। এখানে সময় কথা বলে। পেশাদারিত্বই শেষ কথা। একটা সময় দেওয়া হবে। তার মধ্যে কেউ বিরক্ত করবে না। সেই সময়ের মধ্যে কাজ করে দিতে হবে। তার পিছনে অনেকটা টাকা ইনভলভড থাকে। কারণ আমি কাজটা করে দেওয়ার পর সাত, আটটা টিম কাজ শুরু করবে। গত চার বছরে ইন্ডাস্ট্রির সেরা প্রোডাকশন হাউজগুলোর সঙ্গে কাজ করেছি। যশ রাজ, ধর্মা, মণিরত্নমের প্রোডাকশন হাউজ়, সঞ্জয় লীলা ভনশালীর হাউজ় রয়েছে। একটা জিনিস বুঝেছি, একটা কাজ করার পর পোর্টফোলিও নিয়ে ঘুরতে হয়। এখানে কাজ মুখে-মুখে ছড়ায়। একজন কেউ যদি কাজ করে খুশি হন, তিনি আরও ১০ জনকে রেকমেন্ড করবেন। এখানে ‘ও শুধু আমার জন্যই কাজ করবে, অন্য কাউকে কেন দেব’ সেই ব্যাপারটা কিন্তু একেবারেই নেই।

১০) বলিউডের সমস্যা কী-কী?

গত চার বছরের মধ্যে দু’-বছর কোভিডই সবচেয়ে বড় সমস্যা (হাসি)। বলিউড ইন্ডাস্ট্রি এতটাই ওপেন, এক্সপোজ়ড ইন্ডাস্ট্রি, অ্যাজ় অ্যান আর্টিস্ট, আমরা সহজেই টার্গেট হই। অনেক সময় মানুষ না বুঝে করেন, তারা ভেতরের গল্পটা জানেন না। অনেক সময় মন খারাপ হয়ে যায়। আর দ্বিতীয়ত বলিউড এমন একটা শহরে, সেখানকার লাইফস্টাইল প্রচন্ড ফাস্ট। এখানে কাজ করতে গেলে অনেক কিছু ছাড়তে হবে। বসে আড্ডা দেওয়ার সময় থাকবে না। নাম, অর্থ সব পাবে। কিন্তু কলকাতার মতো আড্ডা হবে না।

Aniket-inside-4

১১) কোয়ালিটি অব লাইফ কম্প্রোমাইজ়়ড হয়, মনে হয়েছে?

এটা বলা কঠিন। কারণ কলকাতায় যে ভাবে থাকতাম, তার থেকে অনেকটা ভাল থাকি মুম্বইতে। তবে কলকাতা হয়তো বছরে একবার যেতে পারি। সময় পাই না। আত্মীয়, বন্ধুরা অভিযোগ করে, ‘দেখা করিস না, ফোনেও কথা হয় না’। কিন্তু এখন একটু পায়ের তলার জমি শক্ত করতে হবে। অপশন নেই আমার কাছে। আমি ইঁদুর দৌড়ে বিশ্বাসী নই। কিন্তু কোনও গডফাদার ছাড়া টিকে থাকতে হলে স্ট্রাগল থাকবেই। আমি খুশি।

১২) আপনি যেটা শিখেছেন, সেটা পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে যেতে ইচ্ছে করে?

শিখিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে নয়।

১৩) কেন?

আমাকে বহু মানুষ ফোন করেন। হয়তো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসছেন। আচমকাই ফেসবুকে পিং করেন। ‘আমি কাজ করতে চাই’। সঙ্গে সঙ্গে নম্বর দিয়ে দিই। কারণ আমি কলেজে পড়তে যা ফেস করেছিলাম, তখন মাথায় থাকত, তিন দিন দেওয়াল আঁকলে তবে প্রজেক্ট কমপ্লিট করার টাকা পাব। সেই দুনিয়াটা দেখেছি। সে কারণেই লেনদেন চাই না। কেউ আসলে, আমার জানা সব কিছু শেখাতে চাই।

Aniket-inside-5

১৪) এখন যা কর্মব্যস্ততা আপনার, শেখানোর সময় বের করা মুশকিল, নাকি?

হ্যাঁ, সময় দিতে পারি না। কিন্তু ইউটিউবে এখন সব কিছু আছে। প্রয়োজনীয় সব লিঙ্ক দিয়ে দিই। আর যেটা করি, সত্যি কথাটা বলে দিই।

১৫) কী সেটা?

দু’মাস চর্চা করেই তিন মাসে কাজ পেয়ে যাবে, তা কিন্তু হবে না। এটা সাধনার জায়গা। সেই সত্যি কথাটা বলে দিই। এখানে লেগে থাকতে হবে। এমন বহু মানুষ আছেন, ১৫-২০ বছর কাজ করে তবে ব্রেক পাচ্ছেন। সত্যিটা বলে দেওয়ার পর দেখেছি, অনেকে ভয় পেয়ে সরে যান। আবার কেউ শুরু করেন, পরে পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গিয়ে অন্য প্রফেশনে চলে যান।

১৬) পর্দার পিছনে থাকা পেশাদাররা এখনও তেমনভাবে প্রচারের আলোয় আসেন না, এতে খারাপ লাগে?

এটা নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। মুম্বইতে অনেক সিনিয়র একজন প্রোডাকশন ডিজ়াইনারের সঙ্গে কাজ করছিলাম। তখন আমি একদিন বলছিলাম, ‘কী লাভ এত পরিশ্রম করে, অনেক ছবিতে নাম দিতে ভুলে যায়’। এমন বহুবার হয়েছে, প্রচুর কাজ করেছি, টাকা পেয়েছি। কিন্তু নাম দিতে ভুলে গিয়েছে। আপসেট হয়ে যেতাম। ‘দাদা বলো তো, কোনওদিনই কি স্বীকৃতি পাব না?’ সে আমাকে বলেছিল, ‘ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে যে পিচ বানায়, তাকে চিনিস? যে ইডেনে আলো সেট করে, তাকে চিনিস?’ আমি বললাম, ‘না’। ‘ওদের ছাড়া তো ম্যাচ হবে না। এটা সহজ সত্য। মেনে নিলে কষ্ট কমে যাবে।’ আমি মেনে নিয়েছি। তবে নিজের পরিচিতি তৈরি করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নিয়েছি। আমার কাজ সাধারণ মানুষের কাছে আরও কী ভাবে পৌঁছে দিতে পারব, সে চেষ্টা করছি। শুধুমাত্র সিনেমার মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকা হয়তো আমার দ্বারা হবে না। সে জন্য বুককভার, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, ওয়াল পেন্টিং বিভিন্ন ভাবে নিজের কাজটা ছড়িয়ে দিই। কারণ আমি জানি, আমার নাম যতক্ষণে আসে লোকে ততক্ষণে হল ছেড়ে চলে যায়। কাজের স্বীকৃতি ইন্ডাস্ট্রিতে অবশ্যই রয়েছে।

Aniket-inside-6

১৭) আগামী পাঁচ বছরে পেশাদার জগতে নিজের জন্য কী বেঞ্চমার্ক তৈরি করতে চান?

আমার একটাই স্বপ্ন এখনও বাঁচিয়ে রেখেছি। একদিন ছবি তৈরি করব। আজ যে প্রফেশনে কাজ করছি, তার বড় কারণ, সেই দিন যখন প্রথম কল দেব, ‘চলো এ বার সিনেমা করা যাক…’, সে সময় যেন এখনকার শেখা বিদ্যেগুলো কাজে লাগে। সে জন্য আমি সব কিছু শিখছি। অ্যাকশন, স্টোরি বোর্ড, স্ক্রিন প্লে রাইটিং, কনসেপ্ট আর্ট যতটুকু শিখে নেওয়া যায়…।

১৮) স্ক্রিপ্ট লিখছেন?

স্ক্রিপ্ট লিখছি নিজের মতো করে। কোনও একটা সময় নিজের মন থেকে সাড়া পাব। তখনই এগোব। কোনও তাড়াহুড়ো করতে চাই না।

গ্রাফিক্স: অভীক দেবনাথ।