Valentine’s Day: একতরফা প্রেম কি শুধুই মনখারাপ ডেকে আনে? নাকি তা জোরও দেয় মানসিকভাবে?

পৃথিবী অদ্ভুত নিয়মে চলে। ঘৃণার কথা সেখানে প্রকাশ্যে আনা যায়। কিন্তু প্রেমের কথা লুকিয়ে রাখতে হয়। প্রেমে পড়লে কোথায় সেই কথাটা আমরা লুকিয়ে রাখব, বুঝে পাই না। ঘৃণার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমি কাউকে ভালবাসি বলা কম সাহসের কথাও নয়।

Valentine's Day: একতরফা প্রেম কি শুধুই মনখারাপ ডেকে আনে? নাকি তা জোরও দেয় মানসিকভাবে?
Follow Us:
| Updated on: Feb 14, 2022 | 4:39 PM

আমার ছোটদাদু। আজীবন বিয়ে করেননি। পেশায় কেমিস্ট ছিলেন। সুপুরুষ। কড়া অনুশাসনের মানুষ ছিলেন। বড্ড ভাল সেতার বাজাতেন। জন্মের পর চোখ ফুটতেই তাঁকে দেখেছি—শিরদাঁড়া সোজা করে হাঁটতেন। বাড়ির মেয়েদের আগলে রাখতেন। বাইরে থেকে দেখে কড়া ধাঁচের পুরনো ধ্যানধারণার মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি তার কার্বোন কপি। এক্কেবারে হিটলার! কেবল মেঘলা দিনে দাদুর খিল তোলা দরজার ঘরের ভিতর থেকে সেতারের মূর্ছনা ভেসে আসত। ক্ষীণ শব্দে। মনে হত কোনও এক ভাঙা হৃদয়ের মধ্যে দিয়ে ক্রমে উপরের দিকে ভেসে যাচ্ছে সেই সুর। উঠোনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে কারও-কারও চোখ থেকে জল গড়াতেও দেখেছি। ভাবতাম সবাই কাঁদছে কেন? বুঝিনি। ছোট ছিলাম তো!

সেতারের সুরে যে অনুরাগ জমে ছিল, তার বীজ বপনের ইতিহাস জেনেছি অনেক পরে। দাদুর মৃত্যুর কয়েকদিন আগের ঘটনা। বিরাট বাড়িটার দোতলায় তাঁর ঘর। স্ট্রোকে শয্যাশায়ী দীর্ঘদিন। শরীরের বাঁ দিকটা অসাড়। মাথারও গোলমাল দেখা দিয়েছে। অনেককিছুই ভুলে গিয়েছেন। শুধুমাত্র আমাকে আর নিজের বাবা-মাকে মনে রেখেছেন। দেশভাগের পর ঢাকা-ফরিদপুর থেকে কলকাতায় চলে আসার সব ঘটনা মনে রেখেছেন। আর মনে রেখেছেন একজনকে। সম্পর্কে তিনি আমার ঠাকুমার ছোট বোন। ঘরে ঢুকতেই বইয়ের তাক থেকে একটি মোটা বই পেড়ে আনতে বলেছিলেন দাদু। ইশারা মতো বইয়ের পাতা উলটে দেখি মোনোক্রমে (সাদাকালোয়) একটি ছবি। রং প্রায় চটে গিয়েছে। কিশোরী একটি মেয়ে। দু’-দিকে দু’টি বিনুনি বাঁধা চুলে। শাড়ি পরে বসে আছে একটি টুলে। ১৫-১৬ বছরের বেশি নয়। জড়ানো গলায় দাদুর প্রশ্ন, “জানো ও কে?” মাথা নেড়ে বলেছিলাম, “চেনা চেনা লাগছে…” দাদু বলেছিলেন, “আমার বউ!”

দাদুর মৃত্যুর পর জানতে পারি ঠাকুমার আপত্তি ছিল। তাই তাঁর বোনের সঙ্গে দেওরের বিয়েতে সম্মতি দেননি। তখন ভালবাসার বিয়েতে সামাজিক স্বীকৃতি মিলত না। বরং জুটত বঞ্চনা। তাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিজ খরচে প্রিয়তমার বিয়ে দিয়েছিলেন আমার সেই ‘হিটলার’ দাদু। চিরকাল আইবুড়োই ছিলেন। কীসের অপেক্ষায়? জানেন তিনি ও জানেন অন্তর্যামী। শুনেছিলাম তাঁর বৃদ্ধা প্রেয়সীর মুখে। দাদুর মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পুকুরপাড়ে বসে শুনেছিলাম এবং বুঝেছিলাম, প্রত্যাশাহীন একতরফা এক প্রেমের উপাখ্যান। যে প্রেমের উল্লেখ জেনেছি কবিতায়, সাহিত্যে… কখনও বা সিনেমাতেও। একলা প্রেমের বাস্তব রূপ দেখেছিলাম সেই প্রথম।

প্রেমের এমন স্বরূপ তো সচরাচর দেখা যায় না। তাও এই হিংসা হানাহানির পৃথিবীতে। অনেকে প্রেমের কথা প্রকাশ করতেই লজ্জাবোধ করেন। আজও। আমার দাদুও বলতে পারেননি। কেবল দেখেছেন। দেখেছেন চোখ ভরে। অন্তর দিয়ে। চিত্তের চঞ্চলতায়। দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটু কেঁপেছে তাঁর। দেখেছেন কীভাবে ভেঙে চুরমার হয়েছে হৃদয়। টুকরো কুড়িয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন। নিজেকে বুঝিয়েছেন, ভালবাসাকেই ভালবেসেছেন। প্রেয়সীকে ভালবাসার জন্য প্রেয়সীর প্রয়োজনীয়তা ফুৎকারে উড়িয়েছেন। অন্যের ঘরে পালকিতে উঠে চলে গিয়েছেন প্রিয়তমা, চিরবিদায় জানিয়েছেন হাসি মুখে। মুখ থেকে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

আচ্ছা, ‘ভালবাসি’ বললে কি কিছু পালটে যেত? সত্যিই কি যাপনে ফারাক হত? উত্তর নেই। কত তুচ্ছ আমাদের এই জীবন… কত তুচ্ছ আমাদের এই বেঁচে থাকা। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রাণী আমরা। বিরাট আকাশটার নীচে দাঁড়িয়ে প্রাণহারা আণুবীক্ষণিক অস্তিত্ব নিয়ে কেন বলতে পারি না… ‘ভালবাসি!’ ঈশ্বরের যে দান, আমার এই প্রাণ, তার প্রতিটি কণায় মিশে আছে যে হাহাকার… সারা আকাশ চেয়ে দেখছে… আর ভাবছে… জীবনের যমুনাপারে ক’টা মাত্র বছরের প্রতিশ্রুতি… তাতেও কীই বা সময়ের মূল্য। না হোক সে আমার, তবুও সে জানুক আমি তাঁর… আজই, এখনই… যদি সব কথা সঙ্গে নিয়েই চলে যাই, প্রিয়তম মানুষটি একবারও কি জানতে পারবে না তাঁর জন্য গচ্ছিত ছিল কত বসন্ত, কত কুহুতান!

কবি শ্রীজাতর সঙ্গে কথা হচ্ছিল এ প্রসঙ্গে। শ্রীজাতর উদ্দেশে প্রশ্ন, “আমি তোমাকে ভালবাসি… একথা কি বলে ফেলাই শ্রেয়? নাকি লুকিয়ে রাখাই একমাত্র আশ্রয়। সে না জানুক, আমিই জানব, আমি তাঁর কে? এটাই কী একমাত্র রাস্তা? বহিঃপ্রকাশের কী কোনও প্রয়োজন নেই?” ভাবের জায়গা থেকে এক শিল্পমনস্ক মানুষের কথা শোনার এবং বলার দায় আছে আমাদের। উত্তরে শ্রীজাত কী বলেছিলেন জানাই। তাঁর কথায়, “জীবন খুবই ছোট। আমরা যতখানি কল্পনা করি, জীবন তাঁর চেয়েও বেশি ছোট। আমি হয়তো ভাবলাম ৭০ বছর বাঁচব, কিন্তু হয়তো আমার ২৩ বছর বাঁচার কথা। সবটা তো নিজের হাতে থাকে না। আমি হয়তো ভাবলাম অ্যান্টার্কটিকা দেখতে যাব, হয়তো সেটা হল না। কিন্তু কাউকে ভালবাসলে, সেটা তাঁকে জানিয়ে দিতে হয়তো বেশি কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। সেই ইচ্ছে লাগে, সাহস লাগে। ব্যস, ওইটুকুই।” কবির আরও সংযোজন, “জানেন তো, পৃথিবী অদ্ভুত নিয়মে চলে। ঘৃণার কথা সেখানে প্রকাশ্যে আনা যায়। কিন্তু প্রেমের কথা লুকিয়ে রাখতে হয়। এটা আমাকে আজও খুব অবাক করে। প্রেমে পড়লে কোথায় সেই কথাটা আমরা লুকিয়ে রাখব, বুঝে পাই না। কিন্তু কাউকে ঘৃণা করলে সহজেই সেটা লিখে বসি। স্লোগান দিই। ঘেরাও করি। মারামারি করি। তাতে কোনও লজ্জা নেই। শঙ্কা নেই। কিন্তু ‘আমি কাউকে ভালবাসি’ এটা বলতেই যত সংকোচ। আমার তো মনে হয় উল্টোটাই হওয়া উচিত। আমাদের যখন কম বয়স, তখন আরও অনেক ভাবপ্রবণ বিস্ফোরণ ঘটত মনে। আজকালকার বাচ্চাদের মতো আমরা অতটাও পাকাপোক্ত ছিলাম না। একটু নরম গোছেরই ছিলাম। কত মানুষ আত্মহত্যাও করেছেন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। অনেককে বুঝিয়েওছি। বলতাম, ‘এই যে বলতি পারলি, এটাই তো অনেক বড় বিষয়’। এই পৃথিবীতে হানাহানির অভাব নেই, হিংসার অভাব নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে ভালবাসার কথা বলা একধরনের প্রতিরোধ। এটা একটা স্ট্যান্ড। ঘৃণার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমি কাউকে ভালবাসি বলা কম সাহসের কথাও নয়।”

অভিনেত্রী তথা মনোবিদ সন্দীপ্তা সেন শ্রীজাতর কথার রেশ টেনে বলেছেন, “এক-একটা সম্পর্ক এক-একরকম। একেকজন মানুষ এক-একরকম। এত সত্ত্বেও বলব, কারও প্রতি প্রেম জন্মালে সরাসরি সেই মানুষটিকে বলে দেওয়াই ভাল। এতে কোনও পাপবোধ নেই। তবে পরিস্থিতি বুঝে এগোনই শ্রেয়। অপর দিকের মানুষটিরও অনেক বড় দায়িত্ব বর্তায়। প্রেম স্বাভাবিক অনুভূতি। ঐশ্বরিক অনুভূতি। ফলে নেতিবাচক ভঙ্গিতে কোনও কিছু না বলে, সুন্দরভাবে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। আমাকে ভালবেসেছে বলে আমি মহান হয়ে গেলাম, এমনটা ভাবাই উচিত নয়। বরং সম্মান দিয়ে সেই প্রেমকে অন্তরে লালন করলে ভাল থাকবেন।”

এই যে আজ প্রেম দিবস, গতকাল ছিল চুম্বন দিবস… গোটা সপ্তাহ জুড়ে ছিল একটার পর একটা স্পেশ্যাল ডে… আরও কত-কত বিশেষ দিন আসবে, যাবে। দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো… বড়দিন, নতুন বছর… মনে প্রেম নিয়ে বসে আছি আমি। কিন্তু মানুষটাই সঙ্গে নেই। সে হয়তো জানে কিংবা জানে না আমার অন্তরে গচ্ছিত এক পৃথিবী ভালবাসা। তর্কের খাতিরে ধরেই নিচ্ছি মানুষটির প্রিয়তম/প্রেয়সী তাঁকে সেই প্রেম ফিরিয়ে দিতে পারেননি। হতেই তো পারে। আমার মনে যে ফাগুনের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে দিবারাত্র, তাঁর মনে নেই লেশমাত্র স্ফুলিঙ্গ। হতেই তো পারে… আমরা প্রত্যাশাহীন একমুখী প্রেম, সেটাই আমার মুক্তস্বরূপ… আর বহিঃপ্রকাশ! সবটাই বাক্সবন্দি করে তালা দিয়ে চাবিটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছি অতল সমুদ্রে! শ্রীজাত বলছিলেন, “সৃজনশীল মানুষের সংখ্যা সামজে বেশি নয়.. এমন নয় যে প্রত্যেকেই কবিতা লিখতে পারেন, কিংবা ছবি আঁকতে পারেন… প্রত্যেকেই গান গাইতে পারেন… অনেকেই আছেন যাঁরা এর হয়তো কোনওটাই পারেন না। তাঁদেরও কিন্তু অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ দরকার হয়ে পড়ে। তাঁরা হয়তো বন্ধুদের কাছে বলেন, ডায়েরি লেখেন কিংবা কেবলই ভাবনাচিন্তা করেন। কিন্তু আমার মনে হয় একতরফা ভালবাসার মধ্যেও প্রাপ্তি আছে। আমার মনে আছে অনেকদিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘ভালবাসাকে ভালবেসেছি’। এরচেয়ে ভাল আর কিছু হয় না। আর একতরফা প্রেম সবসময় একদিকে যায় না। অনেক সময় প্রতিহিংসাও ডেকে আনে। তখন বুঝতে হবে, সেটা আর যাই-ই হোক, ‘প্রেম’ নয়। একতরফা প্রেম মানুষকে যেমন একলা করে, তেমনই সমৃদ্ধও করে। সবসময় সৃজনশীলভাবে নয়। কবিতা লিখতেই হবে, কিংবা গিটার বাজিয়ে গান গাইতেই হবে, না-ও হতে পারে। একজন রিকশাচালক যখন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হন, একজন ডাক্তার যখন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হন, তার গান গাওয়া কিংবা কবিতা লেখার অবকাশ থাকে না। তাঁদেরও কিন্তু নিজস্ব অভিব্যক্তি আছে। তাঁরা হয়তো গান, কবিতার কাছে চলে যান শ্রোতা কিংবা পাঠক হয়ে। আমি অনেক বন্ধুকে দেখেছি, একটা সময় পর হঠাৎই জগজিৎ সিং শুনতে শুরু করে দিয়েছেন। পরে কথা বলে জানতে পেরেছি, সে হয়তো প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাই আমার বার বারই মনে হয় শিল্পই আশ্রয়।”

সাহিত্যিক ও চিত্রনাট্যকার সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি ‘বাবা, বেবি, ও…’ ছবির সংলাপ নির্মাণ করেছেন। একতরফা অসমবয়সি প্রেমের সংলাপ লিখেছেন সম্রাজ্ঞী… ‘উত্তরণ’-এর মতো সামাজিক ছবিরও চিত্রনাট্যকার তিনি। একতরফা প্রেমের আলোচনায় তাঁর মূল্যবান মতামত পোষণ করতে গিয়ে সম্রাজ্ঞী বলেছেন, “যদি আমি প্রেম শব্দটা ভাবি, তা হলে সেটা চিরকালীন ভাবেই একতরফা। দ্বিতীয় মানুষটির মনেও সেই একই অনুভূতি জন্মালে তবেই সেটি প্রেম করার পর্যায় পৌঁছবে। কিন্তু প্রেমে পড়ার বিষয়টি যে কোনও মানুষের কাছেই একতরফা।” কেননা, একতরফা প্রেমেই যে প্রত্যাশ্যাহীনতার জায়গা তৈরি হতে পারে। তখনই তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডির বাইরে বেরোতে পারে মানুষ। সম্রাজ্ঞী বলেছেন, “একতরফা প্রেমে গভীর দুঃখ-কষ্ট থাকে। একদিকে সেটাই প্রাপ্তি। ব্যক্তি হয়তো কোনও নির্দিষ্ট দিন উদযাপন করতে পারছেন না, কিন্তু তাতে নতুন রাস্তাও খুলে যাচ্ছে। সেটা হল নিজের সঙ্গে নিজের সেই অনুভূতি উদযাপনের রাস্তা। দীর্ঘদিন চলতে-চলতে একটা সময় মানুষ নিজেকে উদযাপন করতে শুরু করে। হয়তো আমার ক্যাফেতে বসে প্রেমিকের সঙ্গে কফি খাওয়া হল না। কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ে যে উদযাপন করলাম, সেটাও একটা প্রেম। প্রেমকে যদি কেবল অনুভূতি হিসেবে ভাবি, তখন সেটা সার্বিকভাবেই একতরফা। আমাদের যেহেতু অনুভূতি মাপার কোনও যন্ত্র নেই, ফলে দু’টো মানুষ সমানভাবে ভালবেসেছে কি না, এটা না জেনেই মৃত্যু পর্যন্ত কাটাতে হয়। প্রেমে উত্তরণ ঘটলে খুব শক্তিশালীও হওয়া যায়। মানুষ হিসেবে অনেকটা বড় হওয়া যায়। প্রেমের ক্ষত বেশ গভীর। সেই ক্ষত যদি পার করা যায়, তা হলে অনেক ক্ষতই পার করতে পারেন সেই ব্যক্তি।”

শ্রীজাত বলছিলেন,”প্রেম সব সময়ই সুন্দর। সেটা যে ধরনের প্রেমই হোক না কেন। যাকে কাছে পেতে চাই, তাকে যদি পেয়ে যাই একরকম সুন্দর। না পাওয়ারও একটা সৌন্দর্য আছে। সেই প্রেম কিন্তু ব্যর্থ হয়ে যায় না। আমার হয়তো স্বপ্ন সত্যি হবে না। একটা দীর্ঘ সময় যাঁকে ভালবাসলাম, সে ফিরিয়ে দেওয়ায় আমার প্রেম মিথ্যে হয়ে গেল, এটাও হওয়া উচিত নয়। প্রেম কোনও আর্থিক লগ্নি নয়, এটা সবার আগে আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সবটুকু দেওয়ার জন্যই আমরা প্রেমে পড়ি। সেই প্রেম যদি আমরা পেয়েও যাই, সেটা আমাদের বাড়তি মনে হয়। যদি কিছু না-ও পাই, এই যে আমার সবটা কাউকে আমি দিতে চাইছি, এটাও কিন্তু আমার পাওয়া। একটা অন্য সত্ত্বা তৈরি হয় তখন। নতুন মানুষে রূপান্তরিত হই আমরা। যে হয়তো সবটা দিয়ে দিতে চায়, যা সে আগে কখনও পারত না। এই দিয়ে দিতে চাওয়াও অনেকখানি মানুষ হয়ে ওঠা। আসলে প্রেমে পড়া যেমন হয়, সেই পড়া থেকেই প্রেমে ওঠে মানুষ। প্রেমে উত্তরণ ঘটে তখনই।”

‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ ছবির কথা উল্লেখ করেন সন্দীপ্তা, “শাহরুখ খান বলেছিলেন, একতরফা প্রেমের মজাই আলাদা। এই প্রেমে কেবল আমার অধিকার আছে। প্রেয়সীকে ভালবাসার জন্য কেবল প্রেয়সীকেই প্রয়োজন নেই আমার…” এটাই যদি নিয়ম হয় অনেকটাই মনের আরাম! বেদনা থেকে মুক্তি।” অনুপম রায়ের গানের কথায়, ‘সব পেলে নষ্ট জীবন’… টলিপাড়ার পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “জোর করে প্রেম আদায় করা যায় না। সেটাকে মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে নিয়ে থাকাই প্রয়োজন। নিজের স্বার্থে প্রয়োজন, অন্যের স্বার্থেও প্রয়োজন। অনেকসময় খুব কষ্ট হয়। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তো মানুষ কষ্ট পায়। সেই কষ্টগুলোর মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে হয়। এবং লড়াই করতে হয়। জীবনে চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না। তাই না পেয়েও কীভাবে যাপনকে সমৃদ্ধ রাখা যায়, আনন্দঘন রাখা যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু মনের কথা বলে দেওয়াও প্রয়োজন।”

যন্ত্রণা বয়ে বেড়ালে পরিবর্তে ভালবাসা পাওয়া যায় না। বলেছেন মনোবিদ শতভিষা চট্টোপাধ্যায়। পরিবর্তে দু’জন মানুষের মধ্যে যদি যোগাযোগ থেকে যায়, তাঁরা নানাভাবে আলাপ আলোচনা করতে থাকেন, দীর্ঘদিনের কথাবার্তার মধ্যে দেখতেই পারেন সম্পর্কের মধ্যে কোনও সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে কি না। তিনি বলেছেন, “মাথায় রাখতে হবে, প্রেম মানসিক, নিউরো-বায়োকেমিক্যাল নাকি শারীরিক… কোনটা দিয়ে আমরা প্রেমের অর্থ বুঝব। নিউরো-বায়োলজির দিক থেকে দেখতে গেলে মস্তিষ্কের রাসায়নিক ঢেউ। যার ফলে আর একটি মানুষে সাহচর্য খুঁজে নিতেও সাহায্য করে। চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যায়। মুশকিল হল, আমার মাথায় যখন সেই ঢেউ খেলছে, অন্যমানুষের ক্ষেত্রেও কি সেটাই হচ্ছে? ভালবাসা জিনিসটা খুব সুন্দর, যদি সুন্দরভাবে করা যায়। প্রকৃতভাবে পথ চলা না হলেও সম্মানের জায়গা তৈরি হতে পারে।”

কবিদের একতরফা প্রেম নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘মিউজ়’-এ পরিণত হয়েছেন প্রেমিক কিংবা প্রেয়সী। শ্রীজাতর প্রেম ছিলেন বেগম আখতার। সেই ছেলেবেলার প্রেম। কবি অস্ফুটে স্বীকার করেছেন, “আমি একজনের কথা বলতে চাই, যাঁর কথা বললে তিনি বিপদে পড়বেন না। তাঁর প্রেমে পড়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে আমি পথে পথে ঘুরেছি। কিন্তু তাঁকে সে কথাটুকু জানানোর উপায় খুঁজে পাইনি। তিনি বেগম আখতার। কৈশোরে প্রথম বেগম আখতারকে শুনি। ওকে শোনার পর এক দেড় বছর বার বার মনে হয়েছে একবার যদি তাঁকে দেখতে পেতাম। প্রবল প্রেমে পড়েছিলাম। সেই প্রেম বন্ধুর প্রেমে পড়ার মতো নয়। সেই প্রেম আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। এটাও মেনে নিয়েছিলাম, ওঁকে চাইলেও কোনওদিনও দেখতে পাব না।”

(অনুলিখনের ভিত্তিতে লিখিত)

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ

আরও পড়ুন: Valentine’s Day: ‘আসুন, ভালবাসার দিনে ভালবাসাকে আরামে নিঃশ্বাস নিতে দিই…’

আরও পড়ুন: Valentine’s Day: ‘বিরহ শব্দের অর্থ বিশেষভাবে রহ… আমি তোমারও বিরহে রহিব বিলীন…’