EXCLUSIVE: ‘জয়া, বাঁধনরা টলিউডে সময় দিতে পারছে, আমি পারছি না..’

এই নয় যে, হাশিম মাহমুদ আরও একটা গান লিখলেন, সেটা এই গানটার মত জনপ্রিয় হবে। 'সাদা সাদা কালা কালা'-র মত জনপ্রিয় হবে এমন কোনও কথা নেই। সবকিছু নির্ভর করে সময়ের উপর।

EXCLUSIVE: 'জয়া, বাঁধনরা টলিউডে সময় দিতে পারছে, আমি পারছি না..'
হাওয়া ফিল্ম নিয়ে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার ওপার বাংলার তারকা চঞ্চল চৌধুরি
Follow Us:
| Updated on: Aug 09, 2022 | 12:55 AM

রক্তিম ঘোষ

কলকাতাঃ হাওয়া বদলেছে। ‘হাওয়া’ বদলাচ্ছে হাওয়া। এক ‘হাওয়া’-য় এলোমেলো বাংলাদেশের সিনেমার মানচিত্রটা। এলোমেলো মানে যে সবসময় ছন্নছাড়া, এমনভাবার কারণ নেই। এই ‘হাওয়া’ এলোমেলো করে নতুন স্বপ্নের এক ভোরকে ডেকে এনেছে ওপার বাংলার সিনে দুনিয়ায়। পদ্মাপাড়ে এখন নতুন উন্মাদনার নাম  ‘হাওয়া’।ফিল্মের গান ‘সাদা সাদা কালা কালা ‘ এখন শুধু ওপার বাংলা নয়। এপার বাংলাও নয়। বলা ভাল বিশ্বব্যপী বাঙালির কাছে তুমুল জনপ্রিয়। আরও একটা পাওনা রয়েছে এই ফিল্মে। অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরির অভিনয়। ‘তকদীর’,’আয়নাবাজি’,’বলি’-র মত ফিল্ম ও ওয়েবসিরিজের সৌজন্যে এপার বাংলাতেও চঞ্চল চৌধুরির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দিন কে দিন। এখন আলোচনায় তাঁর নতুন প্রজেক্ট ‘কারাগার’ নিয়ে। প্রমোশন, শ্যুটিং-চরম ব্যস্ততার ফাঁকে সোমবার চঞ্চল চৌধুরি সাক্ষাৎকার দিলেন TV9 বাংলা ডিজিটালকে। চঞ্চল চৌধুরির গাড়ি তখন শ্যুটিং ফ্লোরমুখী। ঢাকার রাজপথের যানজট এড়িয়ে চলেছে চঞ্চল চৌধুরির গাড়ি। আর মোবাইল ফোনে চলছে অনর্গল সাক্ষাৎকার।

প্রশ্নঃ আপনার যা সাফল্যের উড়ান, এখন কি চঞ্চল চৌধুরিকে মনচঞ্চল চৌধুরি বলা যায়?

চঞ্চল চৌধুরিঃ (হাসি) আমি আসলে মেলাতে পারছি না। নাম চঞ্চল হলেও, আমার  আসলে ধীরস্থির কাজ।চঞ্চলতা দিয়ে তো সব কিছু হয়না।একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা, দায়িত্ব-সব কিছু মিলিয়ে একজন অভিনেতা হিসেবে প্রত্যেকটা চরিত্রকে আলাদাভাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরা। হ্যাঁ, সেটার জন্য মাঝেমধ্যে কিছুটা চঞ্চলতা লাগে।কিন্তু তার বাইরে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হয়, সাধনা করতে হয়।খুঁজতে হয়, আমি কোথায় যেতে চাই।একটা টার্গেট থাকতে হয়।সেই লক্ষ্যের দিকেই আমি এগোনোর চেষ্টা করছি।

CHANCHAL CHOWDHURY

প্রশ্নঃ  কেউ-ই তো এই ফিল্মে অভিনয় করেননি। স্রেফ চরিত্র হয়ে উঠেছেন।এটাই কি ‘হাওয়া’-র সাফল্যের কারণ?

চঞ্চল চৌধুরিঃ আমরা ‘হাওয়া’ ফিল্মে যাঁরা কাজ করেছি, তাঁরা কম বেশি অন্যান্য ফিল্মে একসঙ্গে অভিনয় করেছি। তারপরেও এই গল্পের চরিত্র হওয়ার জন্য আমাদের পরিচালক এক পন্থা নিয়েছিলেন। শ্যুটিং শুরু হওয়ার প্রায় ১ বছর আগে থেকে প্রত্যেক সপ্তাহে রিহার্সাল করাতেন। ৮-৯টি চরিত্র রয়েছে এই ফিল্মে। রিহার্সাল থেকে শ্যুটিং শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা ফিল্মের চরিত্রের নাম ধরে ডাকতাম। কথাও বলতাম সেরকমভাবে। সবাই তখন নিজেদের মাঝি ভাবতে শুরু করেছিলাম। ২-৩ বছর পরও দেখা হলে বা কথা হলে আমরা  চরিত্রের নাম ধরে প্রত্যেককে ডাকি। পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন আমাদের এই সুযোগটা করে দিয়েছিলেন। এটা একটা প্রক্রিয়া। যার জন্য আমরা ডিরেক্টরকে (মেজবাউর রহমান সুমন) ক্রেডিট দি।

CHANCHAL CHOWDHURY INTERVIEW

প্রশ্নঃ অতিমারির জন্য ফিল্ম রিলিজ অনেকটা বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। কি মনে হয় এটা কি ফিল্ম ‘হাওয়া’-র পক্ষে শাপে বর হল?

চঞ্চল চৌধুরিঃ আগে রিলিজ করলে কি হত, এটা বলা কঠিন। একটা রিস্কের মধ্যে আমরা ছিলাম। গত ৩ বছর অতিমারির কারণে মানুষের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এদেশের সিনেমাহলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কারণ দর্শক  বিমুখ। ভাল সিনেমা তৈরির ধারাবাহিকতা নেই।হল মালিকরা হল ভেঙে মার্কেট করে ফেলছে।এই ধরনের পরিবেশের মধ্যে দিয়ে স্ট্রাগল করে আমাদের সিনেমা তৈরি করতে হয়।এর মধ্যে একটা সিনেমা যখন ওয়ার্ক করে, তখন আবার সিনেমাহলের তালা খুলে ঝাঁড় দিয়ে আবার সিনেমা-টিনেমা চলে।আমরা খুব সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।এর মধ্যে এই ফিল্ম ‘হাওয়া’ অনেক বড় বাজেটের ছবি। আমরা জানতাম এই ফিল্ম ওটিটিতে জনপ্রিয়তা পাবে। কিন্তু পরিচালক থেকে আমরা সবাই চেয়েছিলাম দর্শককে হলমুখী করতে।

পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের এটা প্রথম ফিল্ম। আমিও অনেকদিন পরে সিনেমায় অভিনয় করলাম। ২ বছর পর সিনেমা রিলিজ হওয়ার পরও দর্শকদের এই প্রতিক্রিয়া দেখে আমরা অনেকটা চাপমুক্ত। আর এই সাফল্য দেখে অনেক নির্মাতাই নতুন করে ভাবছেন ফিল্ম তৈরির ধারা নিয়ে।

প্রশ্নঃ ফিল্ম ‘হাওয়া’-র জন্য বাংলাদেশের একটি মাল্টিপ্লেক্সে হলিউডের ‘থর’ ফিল্মের ২টো শোয়ের স্ক্রিনিং বন্ধ ছিল । আর ওপার বাংলার ‘হাওয়া’ নিয়ে এপার বাংলার অনেক পরিচালক, প্রযোজক বা ফিল্ম কলাকুশলীদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে।অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে বলছেন, হাওয়া দেখতে বাংলাদেশে যেতে চান!

চঞ্চল চৌধুরিঃ (হাসি)  ২৯শে জুলাই ফিল্ম রিলিজের পর আমি অনেক হল ভিজিট করেছি। চোখের সামনে দেখেছি কোন শ্রেণীর লোকজন এই ফিল্ম দেখতে হল ভরাচ্ছেন। যাঁরা হলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তাঁরাই দেখছি আসছেন হলে।আর আপনি যখন কলকাতার কথা বললেন, তা হলে বলি। সোশ্যাল মিডিয়ার সূত্রেই কলকাতার সঙ্গে আমি কানেক্টেড। আমি শুনেছি কলকাতার বহু মানুষ এই সিনেমাটা হলে দেখতে চান। এই নিয়ে আমি ‘হাওয়া’ ফিল্মের পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে কথাও বলেছি। কলকাতার মানুষরা যে আগ্রহ দেখাচ্ছেন ‘হাওয়া’ নিয়ে, তা প্রাপ্তির উপরে প্রাপ্তি!

সর্বদল, সর্বধর্মের সব দর্শক বাংলাদেশে ভিড় জমাচ্ছে ‘হাওয়া’ দেখতে। এটা দারুণ ঘটনা। কিছুক্ষণ আগেই আমাদের দেশের প্রাক্তন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ফোন করেছিলেন। নূরভাই অভিনয় করতেন। আমাদের থেকে সিনিয়র অভিনেতা ছিলেন। তিনিও প্রশংসা করলেন। এই সিনেমাটা আসলে একটা বিশ্বাস তৈরি করেছে।

প্রশ্নঃ শিল্প শক্তিশালী বলেই কি হারিয়ে যাওয়া হাশিম মাহমুদের গান ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটা আজ গোটা বিশ্বে চরম জনপ্রিয়?

চঞ্চল চৌধুরিঃ একদম সত্যি। আমি চারুকলায় পড়াশুনো করেছি। পরিচালক সুমন চারুকলায় আমার জুনিয়র।ফিল্ম ‘হাওয়া’ টিমের অনেকেই চারুকলার ছাত্র। চারুকলার শুরুর দিকে আমরা সেখানে হাশিম মাহমুদের গান শুনেছিলাম। তারপর পাশ করে আমরা নিজেদের পেশায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু হাশিম মাহমুদ আমাদের অন্তরে ছিলেন। এতদিন তাঁর সেই মূল্যায়ন হয়নি। এতবছর পরে হল।শিল্পের শক্তি হল আসলে আগুনের মত। চেপে রাখা যায়না। আগুনের শিখা ঠিক জ্বলে উঠবেই।

তার মানে এই নয় যে, হাশিম মাহমুদ আরও একটা গান লিখলেন, সেটা এই গানটার মত জনপ্রিয় হবে। ‘সাদা সাদা কালা কালা’-র মত জনপ্রিয় হবে এমন কোনও কথা নেই। সবকিছু নির্ভর করে সময়ের উপর। শিল্পের ব্যপ্তি হলেই তা যে চিরস্থায়ী হবে, এমন কোনও কথা নেই।লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি জানতেন না, তাঁর মোনালিসা ছবি এমন জনপ্রিয়তা পাবে।

প্রশ্নঃ অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরির পাশাপাশি এপার বাংলা গায়ক চঞ্চল চৌধুরিকেও খুব পছন্দ করে। এপার বাংলা থেকে গানের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ এলে গ্রহণ করবেন?

চঞ্চল চৌধুরিঃ অভিনয় হল সমন্বিত শিল্প। গান আসলে আমি অনুষঙ্গ হিসেবে ধারণ করি। তবে গায়ক পরিচয়কে আলাদাভাবে বহন করে মানুষকে আমি বিব্রত করতে চাইনা। আমার আসলে গানের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দু লাইন গান গাওয়ার অনুরোধ পেলে, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী গাইতে পারি।

CHANCHAL CHOWDHURY

প্রশ্নঃ আপনার মত শক্তিশালী অভিনেতাকে টলিউড অফার দেয়নি?

চঞ্চল চৌধুরিঃ টলিউডের অনেক ডিরেক্টর যোগাযোগ করেন। মাঝেমধ্যে করেন। যেমন-সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার কথা ছিল । কোভিডের কারণে হয়নি। অঞ্জন দত্তের সঙ্গে কাজ করার কথা ছিল। সাম্প্রতীককালে অরিন্দম শীলের সঙ্গে কথাবার্তাও হয়েছে।

প্রতি মাসে ২-৪টে কাজের অফার আসে। দর্শকের আমার উপর একটা এক্সপেকটেশন আছে। ভাল কাজ তাঁরা দেখতে চায়। সেটা আমি নজর রাখি।

CHANCHAL CHOWDHURY

প্রশ্নঃ ওপার বাংলা থেকে জয়া এহসান, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা,আজমেরী হক বাঁধন এপার বাংলায় নিয়মিত কাজ করতে আসেন। নায়িকারা পদ্মা পেরিয়ে এপার বাংলায় আসছেন। কিন্তু আপনার বা মোশারফ করিমের মত চরিত্রাভিনেতাদের বড্ড কম দেখা যাচ্ছে। এপার বাংলার কিন্তু একটা আফশোস রয়েছে।

চঞ্চল চৌধুরিঃ এটা যাঁর যাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।এখানে আমার দীর্ঘদিনের অভিনয় জীবন। এই ইন্ডাস্ট্রির প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। তার উপর আমার পরিবার। তাই আমি চাইলেই, ওপার বাংলায় গিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করতে পারব না। অন্যরা হয়ত সময় ম্যানেজ করতে পারছেন। আমি ম্যানেজ করতে পারিনি। আমার ইচ্ছা রয়েছে, কলকাতায় গিয়ে কাজ করতে। কিন্তু এখানে কাজের ব্যস্ততা রয়েছে। কলকাতায় বেশি কাজ করলে, আমার দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ কম করতে হত। যেটা আমি চাইনা। আমার কাজ কলকাতার মানুষ বহু দেখেছেন। দেখছেন। বছরে ২ বার গিয়ে কাজ করা সম্ভব। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে কাজ করা সম্ভব নয়। আর আমার ছেলে বড় হচ্ছে। ওর এখন ১২ বছর বয়স। ফলে অনেক বিষয় আমাকে মাথায় রাখতে হয়।

সেই কবে আমি ‘মনের মানুষ’ ফিল্মে অভিনয় করেছি। তারপর থেকে নিয়মিত অভিনয়ের অফার পাচ্ছি। প্রায় ১০০টি অফার পেয়েছি। ২০-২৫টা ওটিটির কাজের অফারও পেয়েছি। জয়া, বাঁধনরা সময় দিতে পারছে। আমি পারছি না। জয়া আমার খুব কাছের। ওঁর কাজ কতটা ভাল,সেটা বলার অপেক্ষাই রাখেনা। জয়া, বাঁধনের জন্য সবসময় শুভ কামনা। জয়ার অ্যাচিভমেন্ট নিয়ে গর্বিত হই।

প্রশ্নঃ শেষ প্রশ্ন। কবে এপার বাংলায় ফিল্ম ‘হাওয়া ‘ দেখতে পাব?

চঞ্চল চৌধুরিঃ এ তো টেকনিক্যাল বিষয়। আমরা তো ভাল সিনেমা দেখার কাঙাল। আসলে দুই রাষ্ট্রের যে কূটনৈতিক নিয়ম শৃঙ্খলা বেঁধে রাখা আছে, যা আমাদের হাতের মধ্যে নেই। আপনিও যেমন চান , আপনার দেশে সিনেমাটা দেখতে। আমরাও চাই সিনেমাটা দেখাতে।আসলে আমরা সিস্টেমের মধ্যে রয়েছি। যেখানে আমাদের কোনও হাত নেই।