Prosenjit Chattarjee Exclusive: শিল্পীদের ওপরটা রঙিন, ভেতরে অনেক রকমের দুঃখ-কষ্ট, না-পাওয়া থাকে: প্রসেনজিৎ
Jubilee: আমার মনে হয়, প্রতিটা চরিত্রই এমনই হতে যায়। দর্শকদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করতে চায়। লক্ষ্য করে দেখবেন, জুবিলি-তে সব চরিত্রই দুঃখ-না পাওয়া, হতাশার মধ্যে দিয়ে শেষ হচ্ছে।
জয়িতা চন্দ্র
দীর্ঘ ৪০ বছরের সফর, পর্দায় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে চলেছেন টলিউড স্টার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছোটবয়সেই অভিনয়ে হাতেখড়ি। সকলের প্রিয় সেই ‘বুম্বা’ই আজ ‘ইন্ডাস্ট্রি’। জনপ্রিয় সংলাপের দাপটে এই ট্যাগ তাঁর নামে জুড়লেও, তিনি মানতে না-রাজ। আজও নিজেকে ভেঙে গড়তে যিনি দ্বিধা বোধা করেন না, আজও যিনি শিখতে চান, হাত ধরে শেখাতে চান, সেই প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আজ বাংলা সিনেজগতের এক মস্ত অধ্যায়। যাঁর পরতে-পরতে জড়িয়ে বাংলা সিনেপাড়ার বহু অজানা কাহিনি, বহু ওঠাপড়ার গল্প। এক ইন্ডাস্ট্রিকে ভাঙতে দেখেছেন, গরতে দেখেছেন, দেখেছেন তাঁর মজ্জায় মজ্জায় বদলও। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে পাল্টে ফেলা সেই স্টার-ই তো প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। জুবিলি-র শ্রীকান্তে যাঁর ছাপ বর্তমান। চরিত্র থেকে সিনেপাড়া, TV 9 বাংলার মুখোমুখি হয়ে একাধিক বিষয় ছুয়ে গেলেন অভিনেতা…।
জুবিলির শ্রীকান্ত চরিত্রের মধ্যে ‘আমি ইন্ডাস্ট্রি’র ছাপ
এইরে, এই যে আপনারা বলেন, ‘আমি ইন্ডাস্ট্রি’, এটা আমি কোথায় বলেছি? এটা তো অরুণ চট্টোপাধ্যায় বলেছিল অটোগ্রাফ-এ। এইগুলো আপনারা বলেন, আর আমায় বড়রা বকে, রাগ করে। তবে হ্যাঁ, অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ফ্লেভার নয় শ্রীকান্ত রায়, পাওয়ার হাউস বটে। নিঃসন্দেহে অরুণ চট্টোপাধ্যায় পাওয়ার-ক্ষমতা। শ্রীকান্তের মধ্যেই সেই দাপট বর্তমান। দেখুন এই ক্ষমতা বা পাওয়ার বিষয়টা জেষ্ঠ্যপুত্র-র মধ্যেও ছিল। কিন্তু জেষ্ঠ্যপুত্র একটা হেরে যাওয়া চরিত্র। আসলে এই ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগুলো কোথাও না কোথাও গিয়ে যেন হেরে যায়। আমার শ্রীকান্ত রায়ও তাই।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে (শ্রীকান্ত) সে লুজার (ব্যর্থ) নয়। অনেক কিছু হারানোর মধ্যে খানিকটা স্বপ্ন বুকে বেঁধে আজ যখন শ্রীকান্ত শুরু করে, তখন অনেক কিছুই আর নেই। অনেক কিছুই হারিয়ে যাচ্ছে। সিঙ্গল স্ক্রিনের মতো। আজ বিদেশে গেলে আমরা এখনও ওয়ার্নার ব্রাদার্স-সহ অনেক স্টুডিও ফ্লোর দেখতে পাই, সেগুলোকে যত্ন করে রাখা আছে। আমাদের তো সব ভাঙা পড়ে গেল। মুম্বই-কলকাতায় সব ধুলিসাৎ। এটাতো একটা সময় খুব বড় পদক্ষেপ ছিল, মুভমেন্ট ছিল…। তার জন্যই তো আজও আমরা কথা বলছি, কাজ করছি। সেই প্রেক্ষাপটে শ্রীকান্ত রায় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
কেন শ্রীকান্ত রায়?
আমার ভাল লেগেছিল শ্রীকান্ত রায় করতে। নিঃসন্দেহে একটা পাওয়ার হাউস চরিত্র। যার মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা আছে, যার মধ্যে সেই পজিটিভিটি আছে। তাঁর জীবনে সিনেমাটাই শেষ কথা। যেখানে সে দাপটের সঙ্গে বলে, কেউ যদি আমায় সিনেমা ও বউয়ের মধ্যে কাউকে বাছতে বলে, আমি সিনেমাকেই বেছে নেব। আমি ভীষণ উপভোগ করেছি এই চরিত্রটাকে।
চরিত্রে যেভাবে একটি ইন্ডাস্ট্রিকে দীর্ঘদিন ধরে দেখেছেন, বাস্তবেও তো একইভাবে টলিউডকে দেখে এসেছেন…
দেখুন বাস্তব ও চরিত্রের মাঝে যে সব সময় মিল থাকবে এমনটা নয়। কিন্তু জীবনের সঙ্গে চরিত্রের মিল তো থাকেই। তাই জন্যই তো সেটা বাস্তব হয়ে ওঠে। তখন মানুষের ভাল লাগে। জুবিলি-তে কেউ হিরো নয়, কেউ ভিলেন নয়। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই পজিটিভিটি-নেগিটিভিটি রয়েছে। প্লাসপয়েন্ট আছে, মাইনাস পয়েন্ট আছে। একটা মানুষের জীবন যখন পর্দায় প্রতিফলিত হয়, তখনই তো আমরা বলতে পারি, চরিত্রটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আমার মনে হয়, প্রতিটা চরিত্রই এমনই হতে চায়। দর্শকদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করতে চায়। লক্ষ্য করে দেখবেন, জুবিলি-তে সব চরিত্রই দুঃখ-না পাওয়া, হতাশার মধ্যে দিয়ে শেষ হচ্ছে। আসলে শিল্পীদের জীবন যে সবসময় চকচকে হবে এমনটা নয়। তাঁদের ওপরটা রঙিন হয়, ভেতরে তাঁর অনেক রকম দুঃখ-কষ্ট থাকে। যেটা বাইরে দেখে দেখে মানুষ বুঝতে পারে না। সেই কারণেই জুবিলি মানুষদের এতটা কাছের হয়ে উঠছে।
‘তুমি স্টার হতে এসেছো, স্টার হয়েই থাকো, অভিনেতা হতে যেও না…’, ‘জুবিলি’র বিখ্যাত সংলাপ। বাস্তবে তো প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় স্টার-অভিনেতা দুই-ই, কীভাবে ব্যালান্স করেন?
খুব কঠিন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই কথাটা সত্যি নয়। আমি সংলাপের খাতিরে বলেছি ঠিকই। দেখুন এই প্রসঙ্গটা ১৯৪০-৫০-তেও একইভাবে শোনা যেত, এখনও শোনা যায়। স্টার আর অভিনেতার মধ্যে ফারাক বর্তমান। আমি এটাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি না। এক্ষেত্রে আমি আমার বন্ধুর ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি কথা শেয়ার করি, সে বলত ”প্রতিটা স্টারই দারুণ অভিনেতা। তাঁর ভেতর যে অভিনয় সত্ত্বাটা রয়েছে, সেটা কেবল একটু বার করে নেওয়া। সেটাকে একটু উষ্কে দেওয়া। এটাই একজন ভাল পরিচালকরে কাজ।”
আমারও তাই মনে হয়, একজন ভাল পরিচালক, একজন স্টারের ভেতর থেকে একজন অভিনেতাকে বার করে নিতে পারে। আমি সত্যি খুব ভাগ্যবান যে আমি তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, স্বপন সাহা, হরনাথ চক্রবর্তী থেকে শুরু করে আজ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়দের পেয়েছিল, পাচ্ছি। এই যে একটা বড় বৃত্তের পরিচালকদের সঙ্গে আমি কাজ করতে পারছি, কারণ আমি মনে করি আমি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা করে চলেছি। সেই কারণেই আজ একদর্শক একদিকে দেখছেন শ্রীকান্ত রায়কে, অন্যদিকে দেখছেন শেষপাতার বাল্মিকীকে, চিন্তে পারছে না। অভিনেতাদের এটাই চ্যালেঞ্জ। ফলে অভিনেতা-স্টারের এই ফারাকটা বর্তমান বটে, তবে আমি মনে করি না। একদম বিশ্বাস করি না।
বাংলা ওটিটি-তে ডেবিউ নয় কেন?
আমার বাংলাতে কাজ করতে কোনও অসুবিধে নেই। আমি করতেও চাই, তবে একটা সঠিক প্রজেক্ট যদি আমি পাই। দেখুন আমি ওটিটি-তে এমনই একটা চরিত্র, এমনই একটা কাজ করব, যেটা নিয়ে মানুষ কথা বলবে। তেমন কোনও চরিত্র এখনও পাইনি। পেলে নিশ্চয়ই করব। আমি তো টিভিতেও কাজ করেছি। আমার তেমন কোনও আপত্তি নেই। যে কোনও প্ল্যাটফর্মেই হোক না কেন কাজটা ভাল হলেই স্বস্তি, দর্শকদের ভাল লাগে।
বর্তমানে টলিপাড়া এক কঠিন অধ্যায় দিয়ে যাচ্ছে, অনেক ঝড় বইছে, আপনি এর অন্যতম সদস্য হিসেবে কী বলবেন?
দেখুন সব ইন্ডাস্ট্রি-ই একটি ওঠা নামা থাকে। কাজের দিক থেকে আমরা খুব ভাল একটা সময়ে আছি। দর্শকেরা আমাদের ছবি তুলনামূলকভাবে বেশি দেখছেন। ওটিটি এত ভাল চলছে। টিভি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি কাজটা বেশ ভাল করছে। ভাল-ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে। সব ছবি হয়তো ব্যবসা করছে না সেভাবে। কারণ কিছু মানুষ ধরে নিচ্ছে এই ছবিটা আমরা ওটিটি-তে দেখে নেব…। তবে মোটের ওপর বেশ ভাল চলছে। দর্শকেরা বাংলা ছবি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাচ্ছেন। এটা দারুণ। আমরা তো ভেবেছিলাম অতিমারীর পর প্রেক্ষাগৃহে দর্শকেরা হয়তো আর সেভাবে ফিরবেনই না। কিন্তু সকলের ভালবাসায় আজ আমরা এখানে…।