AQI
Sign In

By signing in or creating an account, you agree with Associated Broadcasting Company's Terms & Conditions and Privacy Policy.

গরম লাগছে বলে মাস্ক না-পরে অস্বস্তিটাকেই বড় করে দেখছেন মানুষ: চিকিৎসক সুজিত সরখেল

কেন সচেতনার অভাব? এর নেপথ্যে থাকা আর্থ-সমাজিক এবং মানসিক কারণ কী-কী? ব্যাখ্যা করলেন এসএসকেএম হাসপাতালের সাইক্রিয়াটি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর-চিকিৎসক সুজিত সরখেল।

গরম লাগছে বলে মাস্ক না-পরে অস্বস্তিটাকেই বড় করে দেখছেন মানুষ: চিকিৎসক সুজিত সরখেল
| Updated on: Apr 28, 2021 | 10:47 AM
Share

করোনার  (covid 19)দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। প্রতিদিনের পরিস্থিতি আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। কিন্তু এখনও এক দল মানুষের মধ্য়ে করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহা। এখনও যেন অনেকেই সচেতন নন। কেন সচেতনার অভাব? এর নেপথ্যে থাকা আর্থ-সমাজিক এবং মানসিক কারণ কী-কী? ব্যাখ্যা করলেন এসএসকেএম হাসপাতালের সাইক্রিয়াটি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর-চিকিৎসক সুজিত সরখেল।

এক বছর হয়ে গিয়েছে। আমরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। এখন যা পরিস্থিতি, তাতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এ বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ আর নেই। প্রতিদিন যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে সচেতনতার অভাবই প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি। পরিস্থিতি যথেষ্ট ভয়াবহ। তবুও অধিকাংশ মানুষ এখনও সচেতন হচ্ছেন না কেন? নিজের ভালটুকু কেন বুঝতে চাইছেন না তাঁরা? এর ব্যখ্যা করতে গেলে খুব সাধারণ কিছু কারণ স্পষ্ট হয়ে যাবে।

সমাজে আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন স্তরের মানুষ রয়েছেন। গত বছরের লকডাউন প্রত্যেকের কাছেই চরম শিক্ষার। ব্যবসা, চাকরি সব ক্ষেত্রের মানুষ যে ক্ষয়ক্ষতি দেখেছেন, তারপর তাঁরা ডেসপারেট হয়ে গিয়েছেন। ভাবটা অনেকটা এই রকম… আমাকে বেরতে তো হবেই। কাজ করতে হবে। পেটের চিন্তা করতে হবে। ফলে করোনা হলে হবে। না খেয়ে থাকার দুশ্চিন্তা সাংঘাতিক। এই হল একটা দল।

আর একটা দল ভাবছেন, এই যে করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব, সাবধানতা অবলম্বন করব, তার বিনিময়ে আমি কী পাব? সাবধানতা মানলেও যে করোনা হবে না, তা তো নয়। ফলে সাবধান হয়ে কী লাভ? একজন সাবধান হলে, পরের জনকে সাবধান করলে যে মহামারী কিছুটা হলেও ঠেকানো যাবে, সেটা বোঝানো যাচ্ছে না।

covid-rules-txt-Card

আরও একটা দল রয়েছেন। করোনা স্বাস্থ্যবিধি না মানার ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি, আর যারই করোনা হোক না কেন, আমার হবে না। আর যদি হয়, তাহলেও তার মোকাবিলা করে নিতে পারব। হয়তো করোনা আক্রান্ত হয়ে আমার কিছু হল না। কিন্তু আমার পরিবারের বয়স্ক কেউ আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারেন, এটা লোকে বুঝতে চাইছেন না। এই ম্যাচিওরিটিই নেই। হেলথ ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ারটা কিছুতেই অধিকাংশ মানুষকে বোঝাতে পারছি না।

সর্বোপরি মাস্ক পরলে যে করোনা অনেকটা প্রতিরোধ করা যাবে, একটা সাধারণ কাপড়ের টুকরো ব্যবহার-করা মানুষ সেটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারছেন না। বহু মানুষকে দেখবেন, করোনাতে হয়তো নিকট আত্মীয় অক্সিজেন পাচ্ছেন না, হয়তো বা মারা গিয়েছেন, তাঁরা হয়তো সেই হাহাকারের কথা টিভির ক্যামেরার সামনে বলছেন। তখন কতজন সঠিক ভাবে মাস্ক পরছেন? হয়তো মাস্ক পরেছেন, নাকটা খোলা। অথবা মাস্ক থুতনিতে এসে নেমেছে। প্রিয়জন মৃতপ্রায় হলেও হেলথ ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ারের সেন্স লোকের মধ্যে গড়ে উঠছে না।

করোনা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চলার প্রবণতা কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে। তার একটা কারণ, করোনা বিষয়টা অনেকেই খুব হালকা ভাবে নিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যবিধিতে যা-যা করতে বলা হচ্ছে, তার মধ্যে নিজের সুবিধে মতো কোনও একটি কাজ করছেন। যেমন, আমাদের যা জনসংখ্যা তাতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা কার্যক্ষেত্রে অনেক সময়ই অসম্ভব। এছাড়া পরে রইল মাস্ক পরা এবং স্যানিটাইজ়েশন। লোকে কিন্তু স্যানিটাইজ় করছেন। ঘর, বাড়ি স্যানিটাইজ় করছেন। অথবা খাওয়ার আগে হাত স্যানিটাইজ় করছেন। কারণ সেটা করাটা তাঁদের সুবিধেজনক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু মাস্ক পরছেন না। কারণ মাস্ক সর্বক্ষণ পরে থাকার কিছু বাস্তবিক সমস্যা রয়েছে। সেটাকেই মানুষ বড় করে দেখছেন। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শর্টকাট অবলম্বন করছেন।

আমি এমন বহু রোগী দেখছি, যাঁরা হয়তো আমার সামনে এসে মাস্ক নামিয়ে কথা বলছেন। আমি বলছি তাঁদের, আমার সামনে তো আরও বেশি করে মাস্ক পরে থাকা উচিত। আমি সর্বক্ষণ রোগী দেখছি। ফলে সংক্রমণ যে কোনও সময় হতে পারে। তাতে তাঁদের যুক্তি, মাস্ক পরে থাকতে গরম লাগছে অথবা প্রশ্বাসের সমস্যা হচ্ছে। অর্থাৎ মাস্ক পরে তাঁরা কমফর্টেবল নন। সেই ডিসকমফর্ট বা অস্বস্তিটাকেই বড় করে দেখছেন। অস্বস্তির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ় করতে চাইছেন না।

covid-rules-txt-Card-2

কোনও ধর্মীয় সমাবেশ, রাজনৈতিক সমাবেশ বা পারিবারিক অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মানুষের অন্য রকম সাইকোলজি কাজ করে। মানুষ ভাবেন, অনুষ্ঠানটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই করোনা আতঙ্ক ভুলে তাঁরা যাচ্ছেন। আর একদল মনে করছেন, পেটের টানে কাজ করতেই হবে। নিয়ম মানলে চলবে না। এই দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু মাস্ক পরে থাকা যায়। কিন্তু মাস্কের গুরুত্ব বেশিরভাগ মানুষই এখনও বুঝতে পারছেন না। পুলিশ ধরবে বা মাস্ক না পরে অফিসে ঢোকা যাবে না বলে, অর্থাৎ পরিস্থিতির চাপে, মাস্ক পরছেন অনেকে। মাস্কের গুরুত্ব বুঝে বা নিজে থেকে পরছেন না।

এখন যা পরিস্থিতি, প্রতিদিন সংবাদ শিরোনামে পর পর মৃতদেহের সারি বা অক্সিজেনের অভাব কিন্তু রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। বহু মানুষ আতঙ্কগ্রস্তও হচ্ছেন। কিন্তু করোনার হাত থেকে বাঁচার সিম্পল স্টেপগুলো নিতে পারছেন না, কারণ মানুষ ভাবছেন, করোনা আর সকলের হবে। আমার হবে না!

আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি। যাঁরা আর্থ-সামাজিক স্তরে নিচের দিকে রয়েছেন, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত, তাঁদেরকে বোঝানো সুবিধে। যাঁরা মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত, তাঁদেরকে বললেও এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছেন। তাঁরা নিজেদের জ্ঞানী ভাবছেন। এছাড়া যে কোনও আর্থ সামাজিক পরিকাঠামোতেই অল্প বয়সীদের মধ্যে কথা না-শোনার প্রবণতা বেশি। সামগ্রিকভাবে সকলেই হয়তো ভাবছেন, যাই-ই হয়ে যাক, করোনা আমাকে ছুঁতে পারবে না। তাই আমি সব রকম বিধিনিষেধ ভাঙতে পারি। এই প্রবণতাই সংকট আরও গভীর করে তুলছে।

অলঙ্করণ: অভীক দেবনাথ।