RT-PCR-এ ফলস নেগেটিভ! বোকা বানাচ্ছে ভ্যারিয়েন্ট? নাকি গলদ নমুনা সংগ্রহেও?
'ফলস নেগেটিভ'। এই কথাটাই গত ক'দিন ধরে অনেকবার ঘুরে-ফিরে এসেছে। সোজা কথায়, কোনও ব্যক্তি পজ়িটিভ হলেও ভুলক্রমে রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। এর বিপদ বহু। একনজরে দেখে নেওয়া যাক অবস্থাটা কেমন।
কোভিড-কালে ধাঁধার অন্ত নেই। সাম্প্রতিক ধাঁধা: যে পরীক্ষাকে ‘ক্লাসের ফার্স্ট বয়’ ধরা হয়, সেই RT-PCRকেও নাকি করোনাভাইরাস ধোঁকা দিচ্ছে! আলোচনাটা করোনার নতুন স্ট্রেন অথবা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে। চণ্ডীগড়ের এক চিকিত্সক প্রথম এই দাবি তোলেন। তার পর সেই সুর প্রতিধ্বনিত হয় আরও অনেকের মুখে। গত ডিসেম্বরে ব্রিটিশ স্ট্রেন (British Strain) যখন ভারতে প্রথম পাওয়া যায়, তখনও একই দাবির কথা শোনা গিয়েছিল। ধীরে-ধীরে হারিয়ে যায় সেই আলোচনা। এ বার কী হবে?
দেশে যে ১৬২টি করোনা-কিট ব্যবহার করা হচ্ছে, সব ক’টিরই অনুমোদন দিয়েছে আইসিএমআর (ICMR)। তাদেরই অন্যতম প্রতিষ্ঠান, পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির বিজ্ঞানী প্রিয়া আব্রাহাম সরাসরি বলছেন, ”আরটি-পিসিআর (RT-PCR) এখনও গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড টেস্ট। দেশে যে কিট রয়েছে, তা সব ভ্যারিয়েন্টই ধরতে সক্ষম। তা সে ব্রিটিশ স্ট্রেন হোক বা ভারতীয় স্ট্রেন!” বরং, নমুনার গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ”সবসময় নমুনা ঠিক না-ও হতে পারে। অনেক সময় কোভিড আক্রান্তের নমুনা দেরিতে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ততক্ষণে হয়তো ন্যাসোফ্যারিংস অঞ্চলে ভাইরাল লোড কমে গিয়েছে। সঠিক ভাবে নমুনা ল্যাব পর্যন্ত পৌঁছনো না-হলে এনজাইম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক ল্যাবে কর্মীরাই কোভিডে আক্রান্ত, লোকবলের অভাব। ফলস নেগেটিভ আসার পিছনে এগুলিও কারণ হতে পারে।”
আরও পড়ুন: গরম লাগছে বলে মাস্ক না-পরে অস্বস্তিটাকেই বড় করে দেখছেন মানুষ: চিকিৎসক সুজিত সরখেল
‘ফলস নেগেটিভ’ (False Negative)। এই কথাটাই গত ক’দিন ধরে অনেকবার ঘুরে-ফিরে এসেছে। সোজা কথায়, কোনও ব্যক্তি পজ়িটিভ হলেও ভুলক্রমে রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে। এর বিপদ বহু। প্রথমত, রিপোর্ট নেগেটিভ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চিকিত্সা সঠিক পথে এগোবে না। দ্বিতীয়ত, ওই ব্যক্তি নিজেকে আইসোলেট করবেন না। ফলে অজান্তেই করোনা ছড়িয়ে যাবেন তিনি। তাই উপসর্গ থাকলে সঠিক রিপোর্ট পেতে সিটি স্ক্যান করেও দেখে নিচ্ছেন চিকিত্সকরা।
প্রথম ঢেউয়ের সময় থেকেই করোনা পরীক্ষা হচ্ছে মোহালির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে। তার দায়িত্বে থাকা বাঙালি বিজ্ঞানী ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা, ”উপসর্গ থাকলেও কোভিড রিপোর্ট নেগেটিভ আসার বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখেছি। কিন্তু আরটি-পিসিআরকে ভ্যারিয়েন্ট (Variant) পুরোপুরি বোকা বানাচ্ছে, এটা বলা যায় না। এক-একটি কিটে দু’টি বা তিনটি প্রাইমার থাকে। সব ক’টি জিনে একসঙ্গে মিউটেশন সাধারণত হয় না। যেমন স্পাইক জিনে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নিউক্লিওটাইড জিনে মিউটেশন (Mutation) আবার তুলনায় কম। ফলে একটি মিউটেশনের জন্য একটি টার্গেটকে যদি কিট চিনতে না-ও পারে, অন্য টার্গেট কিন্তু ঠিক পজ়িটিভ রিপোর্ট দেবে। আর এই ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা দ্বিতীয় বার পরীক্ষা করে দেখে নিই।”
একই অভিমত সুরক্ষা ডায়গনস্টিকের প্যাথলজি বিভাগের চিফ অফ কোয়ালিটি অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। তিনি বলেন, ”আমরা যে কিটগুলি ব্যবহার করি, সেগুলিতে আরডিআরপি, নিউক্লিওটাইড অথবা নিউক্লিওটাইড, ওআরএফ জিন ব্যবহার করা হয়। তাই কোনও জিনে মিউটেশন হওয়ার জন্য যদি দুর্বল সঙ্কেত আসে, তখন অন্য কিটে আবার পরীক্ষা করে দেখা হয়। ফলে ভ্যারিয়েন্ট যাই-ই হোক, করোনা ঠিকই ধরা পড়বে।” প্রিয়ার সুরেই অভীক, ইন্দ্রনীল বলছেন, নমুনা সংগ্রহের উপরও জোর দেওয়া দরকার। কখন একজন আক্রান্তের থেকে নমুনা নেওয়া হচ্ছে, ন্যাসোফ্যারিংসের সঠিক জায়গা থেকেই সোয়াব নেওয়া হচ্ছে কি না, যথাযথ তাপমাত্রায় নমুনা রাখা হচ্ছে কি না, সে দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন ল্যাব টেকনিশিয়ানদের যথাযথ ট্রেনিংও।
এই মুহূর্তে কলকাতায় যা পরিস্থিতি, তাতে প্রতিটি বিষয়ই প্রাসঙ্গিক। পরীক্ষা বেড়েছে, তাই চাপ বেড়েছে ল্যাবগুলির উপর। এই বাজারে উদয় হয়েছে অনেক মিডলম্যান। তারাই বিভিন্ন ল্যাব থেকে পরীক্ষা করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিচ্ছেন। এরা যথাযথ ভাবে নমুনা নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত কি না, তা দেখার জন্য কোনও নজরদারিও নেই।
এই অবস্থায় উপসর্গ থাকলে প্রয়োজনে দু’বার আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন আইসিএমআরের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল নির্মল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ”সংক্রমণের শুরুতে ভাইরাল লোড অনেক সময়ই কম থাকে। আবার নির্দিষ্ট দিন পেরিয়ে গেলেও ভাইরাল লোড কমে যেতে পারে। এই কারণেও অনেক সময় রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তাই ২-৩ দিনের ফারাকে আরটি-পিসিআর করলে ভালো হয়।” হাইরেজোলিউশন সিটি স্ক্যান করার সুযোগ তো আছেই।
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস