‘ট্রেনের মাথায় চক্কর দিচ্ছে পাক জেট, ধানক্ষেতে লুকিয়ে অপেক্ষা করছি, হঠাৎ…’
পাকিস্তান যখন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তখন আমাকে একটি POW ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। শত্রুপক্ষের সৈন্যদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল আমাকে। অসাধারণ ছিল সেই সাক্ষাৎকার। সেখানে সৈনিকের প্রতি সৈনিকের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল অনেক বেশি।
বি ক্র ম বো হ রা (লেখক, সাংবাদিক)
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বরের এক সন্ধেবেলায় সাংবাদিক-আইনজীবী খুশবন্ত সিং আমাকে তাঁর মুম্বইয়ের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আমরা প্লেনে চড়ে যুদ্ধে যাচ্ছি, তুমি সাউথ ব্লক অফিসে আর্মি পিআরওকে রিপোর্ট করো। আমি ইতিমধ্যেই ওদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মতো আর্মিতেও তাঁর যথেষ্ট ভাল যোগাযোগ ছিল। একটি আইএ ক্যারাভেল ধরে দিল্লিতে ধৌলা কুয়াঁর বাড়িতে পৌঁছই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আমি যুদ্ধ কভার করতে যাচ্ছি শুনে তিনি ভীষণই মুষরে পড়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী সবে মাত্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন আর দুপুরের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে জম্মুগামী একটি সেনার ট্রেনে চড়ে বসি। অফিস আইডিটাও সঙ্গে নিয়ে নিই, যা এখনও রয়েছে আমার কাছে।
এখানে একটা কথা আমাকে বলতেই হবে, যদি আপনি গুগলে বোহরা ভাইদের নাম সার্চ করেন,তাহলে দেখবেন, আমরা বিশ্বের একমাত্র পরিবার যাদের চার ভাই জেনারেল পদে রয়েছে: দুজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল, দুজন মেজর জেনারেল। সশস্ত্র বাহিনীতে ১৫১ বছর ধরে দেশকে পরিষেবা দিয়ে আসছে আমার পরিবার। স্বাভাবিকভাবেই এর একটা সুবিধা রয়েছে। যেমন, এই সেক্টরের সমস্ত কমান্ডারদের চিনতাম। ইলাস্ট্রেটেড ইউকলি এবং টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টার হওয়ার দরুন একটি ড্রাইভার-সহ জিপ পেয়ে যাই। আমরা তিন কাকা ওই এলাকায় থাকায় আমার সুবিধাই হয়েছিল। একজন হডসনস হর্স (৪টি ঘোড়া) কমান্ডিং করছিলেন, অন্যজন ৩ ক্যাভ (3 Cav)-এ রয়েছেন এবং তৃতীয়জন ব্রিগেডে রয়েছেন। এবং তিনজনই ‘বসান্তর’ যুদ্ধের বর্শার ফলার অংশ হয়েছেন। রোমেলের আফ্রিকা কর্পসের পর সবচেয়ে বড় ট্যাংক হামলা হয়েছিল এই ‘বসান্তর’ যুদ্ধে।
সকাল সকাল সাম্বা পেরিয়ে যাওয়ার পর ট্রেন থেমে যায়। আমাদের ট্রেন থেকে নামার অর্ডার দেওয়া হয়। কারণ দুটি পাক যুদ্ধ বিমান (Sabres) ট্রেনের উপর চক্কর দিচ্ছিল। আমরা ট্রেন থেকে নেমে নীচু হয়ে ধানক্ষেতে আশ্রয় নিই। ওরা ট্রেনটিকে আক্রমণ করে কিন্তু সেটা সফল হয়নি। মুহূর্তের মধ্যেই প্রতি আক্রমণ চালায় তিনটি ভারতীয় ফাইটার প্লেন। এই দৃশ্য দেখে এমনভাবে উল্লাস করে উঠি যেন মনে হচ্ছে ডানক্রিকে রয়েছি বা অন্য কোথাও। এরপর ট্রেন পাঠানকোটের দিকে অগ্রসর হয়।
চিকেনস নেকে (Chicken’s neck) আমার বাবার রেজিমেন্টে যোগ দিই। তবে, মেজর জেনারেল ভাইয়া রাজওয়ারের (পাঁচের দশকে ওনার প্রতিবেশী ছিলাম। ঠাট্টা করে উনি আমায় বিক্কি বলে ডাকতেন) কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ৫ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি ভূখণ্ডের দিকে এগোলাম। চারদিকের সমস্ত চিহ্নগুলি জানান দিচ্ছিল, আপনি এখন পাকিস্তানে প্রবেশ করছেন, পাসপোর্টের প্রয়োজন নেই, নির্বিশেষে এগিয়ে চলো। অন্যদিকে আরেকটি চিহ্ন জানান দিচ্ছিল পকেটে হাত ঢোকাও, শ্যামের কথা ভাব। এখানে জেনারেল মানেকশা এবং তাঁর আদেশের কথা উল্লেখনীয়, কেউ যদি শত্রু অঞ্চলে একজনও পাকিস্তানি মহিলার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাকিস্তানে প্রায় ৮ মাইল জুড়ে বিভিন্ন গ্রামে যখন ঘুরছিলাম, চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে পচা মরদেহ এবং কর্ডাইট (এক রকমের বিস্ফোরক) মিশ্রিত গন্ধ। রেললাইনের ধারে সেনা জওয়ান এবং সাধারণ নাগরিকের মৃতদেহ ছড়ানো। এর মধ্যে অনেকগুলিই ছিল ঠাণ্ডা মাথার খুন। যুদ্ধ বিষন্ন, এটা না তো সুন্দর আর না রোমান্টিক। লাহোরের আগে একটি ছোট স্টেশন চক আমরু যাওয়ার পথে (বর্তমানে যেমন নিউ দিল্লি যাওয়ার আগে নিজামুদ্দিন পরে), পাক বাহিনী আক্রমণ করেছিল। যে কর্নেল দায়িত্বে ছিলেন তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃতদেহ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সাময়িক যুদ্ধবিরতির কথা বলেছিল ভারতীয়রা। পূর্ণ সামরিক সম্মান ও গার্ড অব অনার দেওয়া হয় তাঁকে। তারপর আবারও শুরু হয় শত্রুতা।
আমার জিপটি একটি ল্যান্ডমাইনে ধাক্কা খাওয়ায় বিট থেকেই টায়ারটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সম্ভবত এটি একটি অ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন ছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার সহকর্মী লেনি উইলিয়ামস এবং টাইম ম্যাগাজিনের একজন কর্মী। যতদূর মনে করতে পারছি, তাঁর নাম জাহাঙ্গীর গাজদার। সেই সময় মাইন ডিটেক্টর ছিল না। জওয়ানরা ৩০ মিটার দূর থেকে পাথর ছুড়ে আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা দৌড় লাগালাম। নিরাপদ স্থানে পৌঁছনো মাত্র বমি হতে থাকে। মনে হচ্ছে বমির মাধ্যমে সমস্ত সাহস বাইরে উগরে দিচ্ছি।
সেই রাতে আমরা আমরু চকে ঢুকি। সেখানে একটি পাকিস্তানি বোমার আঘাতে তৈরি হওয়ায় বিশাল গর্ত জল জমে পকুর হয়ে গিয়েছিল। যা দেখে উচ্ছ্বসিত জওয়ানরা একে একে ওই পুকুরে ঝাঁপ দেয়। পালিয়ে গিয়েছিল গ্রামবাসীরা। উনুনে চাপানো ছিল রান্না করা ডাল। ধোয়া জামাকাপড় ভেজা অবস্থায় রয়েছে। এটা ছিল অনেকটা পরাবাস্তবতার মতো, যেন সময় থমকে গিয়েছে। আমার মনে পড়ছে একজন শিখ সৈন্য মাইন ফিল্ডে পরে থাকা বোমার আঘাতে একটা পা উড়ে যাওয়া গরুকে কম্বল চাপা দিচ্ছিল। পরে সেইদিনই আমি আমার কাকার বাঙ্কারে পৌঁছই। তিনি একটি সশস্ত্র রেজিমেন্টকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পরেরদিন সকালেই একটা বড় যুদ্ধের জন্য রওনা দেবেন তারা। আমরা সেদিন তাঁর তাবুতেই রাত কাটাই। তিনি বলেন,এর মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই। কেউই মরতে চায় না, আমরা শুধু বেঁচে থাকতে চাই এবং বাড়ি ফিরতে চাই। আমি যদি তোমাকে এই যুদ্ধ কভার করতে দিই তোমার বাবা আমাকে মেরে ফেলবে। তাঁকে বলো, আমি ডিউটিতে রয়েছি, আমি আমার ইউনিফর্মে রয়েছি, আমি আসছি।
আমরা সেই প্যাটন ট্যাঙ্কগুলিকে ছিঁড়ে ফেললাম যেন তারা টিনসেল দিয়ে তৈরি। ভারতীয় T55s এবং AMX 13 ট্যাঙ্কগুলি শকরগড় বুলগের মধ্য দিয়ে ছুটে চলার ফলে মৃত স্টিলের দানবদের কবরস্থান আরও বিশাল হয়ে উঠেছে। আমরা শত্রকে গুলি করেছি,পরাস্ত করেছি এবং তাড়িয়ে দিয়েছি। আমার ছোট জিপ সেনাবাহিনীর ফর্মেশনকে অনুসরণ করে চলেছে। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে আর্টি শেল আর ট্যাঙ্কের গর্জনে। এখানের সর্বত্রই আমরা ১৭ পুণা হর্স রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট অরুণ ক্ষেত্রপালের বীরত্বের কথা শুনেছি। তিনি তার ৩টি ট্যাঙ্ককে মাইনফিল্ড এলাকায় নিয়ে যান। যাই হোক ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের আক্রমণ বজায় রাখে এবং অরুণ তার ২টি অবশিষ্ট ট্যাঙ্ক নিয়ে যুদ্ধে নিহত হওয়ার আগে লড়াই করে ১০টি ট্যাংক ধ্বংস করেন। তিনি ট্যাঙ্ক পরিত্যাগ করার আদেশ উপেক্ষা করেছিলেন, কারণ তার বন্দুকটি তখনও কার্যকর ছিল। যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত দেখে, পাকিস্তান ব্যাপক পাল্টা আক্রমণ চালায় যা প্রতিহত করা হয়। অরুণ পরমবীর চক্র পেয়েছিলেন, অন্যান্যদের মধ্যে আমার কাকা মহাবীর চক্র পান।
অনুরোধ এসেছিল ২৩ বছর বয়সী খেতারপালকেও সম্মান দেওয়ার, যদি আমি খুব ভুল না হই তাহলে জেনারেল ওয়াগ পিন্টো যুদ্ধক্ষেত্রে সেই সম্মান প্রদান করেছিলেন।
পাকিস্তান যখন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তখন আমাকে একটি POW ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। শত্রুপক্ষের সৈন্যদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল আমাকে। অসাধারণ ছিল সেই সাক্ষাৎকার। সেখানে সৈনিকের প্রতি সৈনিকের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল অনেক বেশি। আমি সেই তরুণ বালকদের ছবি তুললাম। তাদের মধ্যে কয়েকজন তো এখনও কৈশোর পেরোয়নি।
ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ আমরা একটি ভাঙাচোরা প্যাটনের উপর নাচলাম এবং রাম খেলাম। তবে আমি ভীষণই খুবই খুশি যে এরপর আর কখনও আমাকে কোনও যুদ্ধ কভার করতে হয়নি। যুদ্ধ অপমানজনক, অদ্ভুত এবং আপনাকে সর্বদা আতঙ্কিত করে রাখে।