Rahul Gandhi: রাগা কাহিনি: ‘পাপ্পু’ পাশ হো গয়া?
Rahul Gandhi: ২০০৪-এ রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন রাহুল গান্ধী। সেই সময় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্ত, ২০১৪ আসতে আসতে সেই রাহুল গান্ধীর নামের সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছিল 'পাপ্পু' অপবাদ। ২০১৯-এ প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, পরপর দুটি ভারত জোড়ো যাত্রাই বদলে দিয়েছে রাহুল গান্ধীর গল্প। এ যেন এক হার না মানা লড়াকুর গল্প। বারবার মাটিতে পড়ে গিয়েও যে উঠে দাঁড়াচ্ছে ফের, তৈরি হচ্ছে লড়াইয়ের জন্য।
২০১১ সালের মে মাস। আগুন জ্বলছে উত্তর প্রদেশের গৌতম বুদ্ধ নগর জেলার ভাট্টা ও পরাসুল গ্রামে। আগ্রা থেকে গ্রেটার নয়ডা পর্যন্ত যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করবে মায়াবতী সরকার। তার জন্য জমি অধিগ্রহণ চলছে। আর এই সরকারি জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধেই আন্দোলন শুরু করেছিলেন কৃষকরা। অনেকটাই তার কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মতো। ১১ মে ভোর ৬টায়, ভাট্টা গ্রামের ভিতরে এসেছিল একটি মোটরবাইক। থেমেছিল এক চায়ের দোকানের সামনে। সদ্য দোকান খুলেছিলেন বিনোদ শর্মা। তাকিয়ে দেখেন, বাইকের পিছনের আসন থেকে নামছেন সাদা কুর্তা-পাজামা পরা, বছর চল্লিশের এক যুবক। দাড়ি-গোঁফ পরিষ্কার করে কাটা, চকচক করছে গোলাপি গাল। লম্বা ঝুলপিওয়ালা কোঁকড়ানো একমাথা চুল। রাহুল গান্ধী। তিনদিন আগেই ওই গ্রামে পুলিশের গুলিতে প্রাণ গিয়েছিল দুই আন্দোলনরত কৃষকের। গোটা গ্রাম ছিল তেতে। কোনও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রামে যেতে দিচ্ছিল না উত্তর প্রদেশ সরকার। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়েছিলেন রাহুল।
আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে গোটা দিন কাটিয়েছিলেন রাহুল। সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, “এখানে যা হয়েছে তা দেখে আমার নিজেকে ভারতীয় বলতে লজ্জা করছে। এখানকার সরকার নিজেদের লোকদের উপরই অত্যাচার করছে।” ওইদিন বেশি রাতে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে। কয়েক ঘণ্টা পরই অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে, এই দিনটা রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনে ছিল এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। তারও প্রায় ৯ বছর আগেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে প্রথমবার সাংসদ হয়েছিলেন, উত্তর প্রদেশের অমেঠী কেন্দ্র থেকে। যে কেন্দ্র থেকে অতীতে সাংসদ ছিলেন তাঁর বাবা রাজীব গান্ধী। ২০০৯ সালে ফের একবার অমেঠী থেকে জয়ী হয়েছিলেন রাহুল। তবে, ২০১১ সালের ১১ মে-র আগে তাঁকে কোনোদিন রাস্তার আন্দোলনে দেখা যায়নি। ভাট্টা ও পরাসুল গ্রামে সেই সফর, জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কৃষকদের পাশে দাঁড়ানো, রাহুল গান্ধীর একটা অন্য ছবি তৈরি করেছিল। শেষ পর্যন্ত, ২০১৩ সালে ভূমি অধিগ্রহণ আইন এনেছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার।
জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি নেতারা বংশবাদী রাজনীতির অভিযোগ করেন। তবে, এটাও ঠিক জাতীয় কংগ্রেসের প্রত্যেক নেতা-কর্মীই মনে করেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দেবে নেহরু-গান্ধী পরিবারের সদস্যরাই। ২০০৪ সালে রাহুল গান্ধী রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেন, সেই সময় থেকেই ‘অনিচ্ছুক রাজনীতিক’ ছিলেন রাহুল। রাজনীতি করাটা তাঁর কাছে ছিল বাধ্যবাধকতার। মন থেকে তিনি চাননি। যেমন অতীতে চাননি তাঁর বাবা রাজীব গান্ধীও। ইন্দিরা গান্ধীর নিজের বেছে নেওয়া উত্তরাধিকারী, তথা তাঁর ভাই সঞ্জয় গান্ধীর আকস্মিক মৃত্য়ুর ফলে, এক প্রকার বাধ্য হয়েছিলেন রাজনীতির পথে হাঁটতে। একইভাবে, গান্ধী পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে আসতে হয়েছিল রাহুলকে। যাইহোক, সেই সময় থেকেই কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা কিন্তু মনে মনে ধরে নিয়েছিলেন, একদিন রাহুলই দলকে নেতৃত্ব দেবেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হবেন। ইউপিএ ১ ও ইউপিএ ২ সরকারের সময়, কয়েক মাস পরপরই জল্পনা চলত, রাহুল বোধহয় এইবার কোনও একটি মন্ত্রকের দায়িত্ব নেবেন।
কিন্তু না। সেই দায়িত্ব তিনি নেননি। সরকারে তো নয়ই, দলেও কোনও বড় পদ গ্রহণ করেননি তিনি। শুধুমাত্র ২০০৭-এর সেপ্টেম্বরে দলের একজন সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন এবং ভারতীয় যুব কংগ্রেস এবং ভারতের জাতীয় ছাত্র পরিষদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সমর্থকরা অবশ্য বলেন, সেই সময় তিনি দলে বেশ কিছু সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন। যেমন, যুব কংগ্রেসের নির্বাচন, যুব কংগ্রেস এবং ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ ‘অপরাধী’ মুক্ত করা, দলে নির্বাচন করার জন্য কর্পোরেট-স্টাইলে ইন্টারভিউ, কংগ্রেস পার্টিকে গণতান্ত্রিক করে তোলার জন্য চাপ দেওয়া ইত্যাদি। সাধারণ মানুষের মধ্যেও রাহুলের এক ঝকঝকে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। বিদেশে পড়াশোনা করেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান রয়ছে, তাইকোন্ডোয় ব্ল্যাকবেল্ট, মোটরসাইকেল রেসেও অংশ নেন – সব মিলিয়ে তরুণদের মধ্যে দারুণ আকর্ষণীয় চরিত্র ছিলেন রাহুল। তবে, রাহুল গান্ধী তাঁর সেই ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং চিন্তা-ভাবনাকে ভোটে পরিণত করতে পারেননি।
২০০৭ এবং ২০১২ সালে উত্তর প্রদেশে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছিল। ২০০৭-এ ৪০৪ আসনের বিধানসভায় মাত্র ৩২ আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। ২০১২ সালে ‘রাহুল ফ্যাক্টর’ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছিল। তবে, কংগ্রেসের আসন সংখ্যা আরও চারটি কমে গিয়েছিল। একই সময়ে, আরেক তরুণ নেতা, অখিলেশ যাদব মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। শুধু উত্তর প্রদেশ নয়, ২০১০ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনেও ২৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছিল মাত্র ৪টি আসনে। নীতীশ কুমার উপহাস করে বলেছিলেন, “তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। প্রথমে তাঁকে অন্তত একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে দিন। তাকে শাসন করা শিখতে দিন।” অরুণ জেটলি বলেছিলেন, “ওরা মনে করে, শুধুমাত্র পরিবারের ক্যারিশমা দেখিয়েই নির্বাচনে জেতা যায়।”
এই নির্বাচনী ধাক্কাগুলির সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ড নিয়ে তাঁর অদ্ভূত নীরবতা। কংগ্রেস যাকে তরুণ নেতা বলে তুলে ধরেছিল, সেই তরুণ নেতাই দিল্লির রাস্তায় নেমে আসা যুবকদের সঙ্গে পা মেলাতে পারেননি। যোগাযোগ করতে পারেনি। ভাট্টা-পরাসুল গ্রামে যে লড়াকু রাহুল গান্ধীকে দেখা গিয়েছিল, তিনি উধাও ছিলেন দিল্লির ঘটনায়। আসলে এই ধারাবাহিকতার অভাবই ছিল রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে সবথেকে বড় অভিযোগ। অনিচ্ছুক রাজনীতিক রাহুল, মাঝে মাঝেই বিদেশে ছুটি কাটাতে চলে যান। খামখেয়ালিভাবে আন্দোলন করেন। এই অভিযোগের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছিল সেই সময়ই।
তবে, তারপরও ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাহুলকেই কমান্ডার হিসেবে বেছে নিয়েছিল জাতীয় কংগ্রেস। জয়পুরের বৈঠকে, গত দুইবারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বদলে, রাহুলকেই দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরার জোরালো দাবি উঠেছিল। রাহুলকে দলের সহ-সভাপতিও করা হয়। আর, তা থেকেই কংগ্রেসে তৈরি হয়েছিল নবীন-প্রবীণের লড়াই। সচিন পাইলট,জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াদের মতো তরুণ নেতাদের নিয়ে নিজের দল তৈরি করেছিলেন রাহুল। অন্যদিকে, সনিয়া সতর্ক ছিলেন, দলের প্রবীণ নেতারা যেন কেউ অসম্মানিত না হন। কংগ্রেসের এই নবীন-প্রবীণের টানাপোড়েন, দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেসকে এবং রাহুল গান্ধীকেও পিছনে টেনে ধরেছে। ২০১৪-তেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোয়া হাসান বলেছিলেন, “সনিয়া গান্ধী, সিনিয়র-প্রতিষ্ঠিত নেতাদের দলে স্থান দিতে চান। রাহুল চান তাঁর সমসাময়িকদের সামনে এগিয়ে দিতে। আগামী কয়েক বছর আমরা কংগ্রেসে এই পুরানো এবং নতুনের লড়াই দেখব।”
২০১৪ সাল ছিল রাহুলের রাজনৈতিক কেরিয়ারে পতনের সূচনা। অমেঠী আসন রক্ষা করেছিলেন রাহুল। তবে, মাত্র ৪৪টি আসন জিততে পেরেছিল কংগ্রেস। শুরু হয় রাহুলের বিরুদ্ধে পাপ্পু প্রচার। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বেই এই উপহাসের নামটি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল বিজেপি। বিজেপি নেতা, কর্মী, সমর্থকরা, আইটি সেলের কর্মীরা এমন প্রচার করেছিলেন যে, সেই সময় কেউ পাপ্পু লিখে গুগলে সার্চ করলেও রাহুল গান্ধীর প্রোফাইল দেখাত। তবে, দিল্লির সাংবাদিক মহলে কান পাতলে শোনা যায়, এই নামটি দিয়েছিলেন কংগ্রেস বর্ষিয়ান নেতারাই। যাঁরা ১৯৯৮-৯৯ সালে সনিয়া গান্ধীরও নাম দিয়েছিলেন, “গুড়িয়া”।
পাপ্পু নামের শুরুটা হয়েছিল ২০০৭ সালের নভেম্বরে। দিল্লির তালকাটোরা স্টেডিয়ামে কংগ্রেসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন হয়েছিল। সেখানেই রাহুল গান্ধীকে দলের ভবিষ্যতের মুখ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। ২২ বছর আগে কংগ্রেসের শতবর্ষে, তাঁর বাবা রাজীব গান্ধীর বক্তৃতা গোটা দলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। রাহুলও তেমনই কিছু বলবেন বলে আশা করেছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। কিন্তু, তাঁদের নিরাশ করেছিলেন রাহুল। তাঁর বক্তৃতায় রাজনীতির কোনও ছাপ ছিল না। উল্টে সেখানে তিনি বলেছিলেন, “দারিদ্র্য কী? ধনী হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় যে, সেই দরিদ্র।” একই বছরে বলিউডে একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। নাম ছিল, ‘পাপ্পু পাশ হো গয়া’। পরের বছর বলিউডে হিট য়েছিল আরেকটি গান, ‘পাপ্পু ক্যান্ট ডান্স শালা’। একই সময়ে ইউপিএ সরকারের “পলিসি প্যারালাইসিস” এবং কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থবিরতার জন্য দায়ী করা হয়েছিল রাহুল গান্ধীকে।
ওই সময়ই সিনিয়র কংগ্রেস নেতারা রাহুল গান্ধী “পার্টটাইম” রাজনীতিবিদ বলা শুরু করেছিলেন। দিগ্বিজয় সিং-কে রাহুল গান্ধীর মেন্টর বলে মে করা হত। ২০১২-র জুলাইয়ে তিনিও ছাত্র রাজনীতি এবং যুব রাজনীতিতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য রাহুলের সমালোচনা করেছিলেন। ২০১৩ সালে “পাপ্পু” নামটি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে স্থায়ীভাবে জুড়ে গিয়েছিল। ওই বছরের ৩ এপ্রিল, নয়া দিল্লিতে কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজে ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। ওই দিন, টুইটারে সেরা ট্রেন্ডিং বিষয় ছিল, #PappuCII (পাপ্পুসিআইআই)। এরপর, বিজেপির আইটি সেলের কাজটা আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল। ওই বছরের অক্টোবরে, লোকসভা নির্বাচন ২০১৪-র প্রচারে, অমিত শাহও রাহুল গান্ধীকে পাপ্পু বলে উল্লেখ করেছিলেন। জনসভায় তিনি বলেছিলেন, “কংগ্রেস মনে করে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার পাপ্পুর জন্মগত অধিকার। কিন্তু এটা গণতন্ত্র। আপনার জনগণের আশীর্বাদ দরকার। জনগণের আশীর্বাদ নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আছে। আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করেছি। কংগ্রেস প্রার্থী কে হবেন? পাপ্পু? না, তারা পাপ্পুকে প্রার্থী করবে না। কারণ তারা হেরে যাওয়ার ভয়ে আছে।”
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর কংগ্রেসে দেখা গিয়েছিল রাহুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সনিয়াকে লেখা চিঠিতে মধ্য প্রদেশের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ, প্রয়াত গুফরান আজম চরম কটাক্ষ করেছিলেন রাহুল গান্ধীকে। তখনও ২০১৯ আসা বাকি ছিল। দলের মধ্যে বিরোধিতা সত্ত্বেও, সেই নির্বাচনে কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাহুল। সনিয়া-রাহুলের দ্বৈত নেতৃত্ব ছেড়ে, দলের একচ্ছত্র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাহুলকে। দলের সভাপতি করা হয়। ফল বদলায়নি। রাফাল দুর্নীতি নিয়ে বিজেপি সরকারকে আক্রমণ করেছিলেন রাহুল। নরেন্দ্র মোদী যেখানে জাতীয় সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে, নিজেকে দেশের চৌকিদার হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। রাহুল পাল্টা প্রচার করেছিলেন, চৌকিদার চোর হ্যায়। তাঁর কোনও প্রচারই কাজে দেয়নি। আরও বেশি সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। আর নির্বাচনের পর, ভাঙা জাহাজ ফেলে এক প্রকার পালিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন রাহুল। দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন।
তার ৫ বছর পরই ছবিটা অনেকটা বদলে গিয়েছে। একটা ছবির কথাই বলা যাক। সাদা কুর্তা-পাজামা পরে, নতুন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী করমর্দন করছেন নবনির্বাচিত লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লার সঙ্গে। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। রাজনীতিতে পা রাখার দুই দশকেরও পর, ২০২৪ সালে এসে বিরোধীদের একেবারে সামনের বেঞ্চে আসতে পেরেছেন রাহুল গান্ধী। এখন তিনি শ্যাডো প্রাইম মিনিস্টার। ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদ মর্যাদা পেয়েছেন। সংসদ ভবনে সুসজ্জিত অফিস। ব্যক্তিগত সচিব-সহ ব্যক্তিগত কর্মীদের একটি দল। লোক পাল, সিবিআই ডিরেক্টর, ভিজিল্যান্স কমিশনার, তথ্য কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের নির্বাচনকারী অসংখ্য বিধিবদ্ধ প্যানেলের সদস্য হয়েছেন। সংসদে যে কোনও বিতর্ক শুরু করার এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার জবাব দেওয়ার বিশেষ সুযোগ রয়েছে তাঁর। যে রাহুলকে মনে করা হত দায়িত্ব নিতে অনুচ্ছুক। তিনিই এবার বিরোধী দলনেতার পদ গ্রহণ করেছেন বুক বাড়িয়ে।
শুধু সাংবিধানিক পদ পাওয়াই নয়, রাহুল গান্ধী সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টে গিয়েছে সংবাদমাধ্যমেরও। ২০২৩ ও ২০২৪-এ দু-দুটি ভারত জোড়ো যাত্রা করেছিলেন রাহুল। তার খুব অল্প অংশই সংবাদমাধ্যমে জায়গা পেয়েছিল। আর এখন আদালতের বাইরে জুতো সাড়াইয়ের দোকানেও তিনি গেলে, তা নিয়ে প্রাইম টাইম শো হচ্ছে। ভারত জোড়ো যাত্রা যেন শেষ হয়েও হয়নি। কখনও জুতো সাড়াইয়ের দোকানে যাচ্ছেন, কখনও ছুতোরদের সঙ্গে টেবিল তৈরি করছেন, কখনও রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে সিঁড়ি ঢালাই করছেন। কী বদলে গেল এই ৫ বছরে? নিজেকে কতটা বদলালেন রাহুল?
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-সহ অনেকেই বলেছেন ভারত জোড়ো যাত্রার কথা। একটি ছিল ২০২৩ সালে, কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত। পরেরটি, একেবারে লোকসভা নির্বাচনের মুখে। সেটি ছিল মণিপুর থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত। এই দুই যাত্রা, রাহুল গান্ধীর ভারত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই বদলে দিয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মবিশ্বাস অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। রাহুল গান্ধী নিজেও এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ভারত জোড়ো যাত্রা শুরুর সময়, তিনি অনেক বেশি কথা বলতেন। মনে করেছিলেন, তিনি মানুষের কাছে যাবেন। তাঁদের নিজের কথা বলবেন। কিন্তু, কয়েকদিন যেতে না যেতেই, তিনি দেখেছিলেন প্রচুর মানুষ এগিয়ে এসে তাঁদের কথা বলছেন। তাঁদের দুর্দশা তুলে ধরছেন। রাহুল জানিয়েছেন, সেই সময় থেকে তিনি নিজে কথা বলা বন্ধ করে, মানুষের কথা বেশি বেশি করে শোনা শুরু করেছিলেন।
বস্তুত, জন্মের পর থেকে রাহুল মানুষের সঙ্গে মেশার তেমন সুযোগ পেয়েছেন কই? তাঁর শৈশব কেটেছিল গান্ধী-নেহরু পরিবারের অরাজনৈতিক অংশে। তিনি যখন ছোট ছিলেন, বাবা রাজীব বা মা সনিয়ার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ ছিল না। ১৯৯১ সালে খুন করা হয়েছিল রাজীব গান্ধীকে। তার দুই বছর আগে, স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করতে রাহুল ভর্তি হয়েছিলেন দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজে। সিবিএসই-তে মাত্র ৬১ শতাংশ নম্বর পেলেও, স্পোর্টস কোটায় সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে, জাতীয় শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় চতুর্থ হয়েছিলেন তিনি। রাজীব গান্ধীর হত্যার পর, নিরাপত্তার কারণে সেন্ট স্টিফেনস ছেড়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চলে যান রাহুল। নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ কাটেনি। এরপর তাঁকে ফ্লোরিডার রোলিন্স কলেজে স্থানান্তরিত হতে হয়। তারপর কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ। বাবার হত্যার পর থেকে, তাঁকে সবসময়ই কাটাতে হয়েছে নিরাপত্তার চাদরের নীচে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগই পাননি।
ভারত জোড়ো যাত্রাই বলা যেতে পারে, রাহুলকে প্রথমবার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার রাস্তা তিনি হেঁটেছেন, মানুষের কথা শুনেছেন। সীমিত ক্ষমতায় তাঁদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলি শুরুতে অবজ্ঞা করেছিল এই যাত্রাকে। কিন্তু, যত দিন গিয়েছে, এই যাত্রাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস ক্রমেই বেড়েছে। জায়গায় জায়গায় তাঁকে একবার দেখার জন্য, একবার ছোঁয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন সাধারণ মানুষ। কখনও কেরলে বাইচ প্রতিযোগিতায় নৌকো বাইতে দেখা গিয়েছে রাহুলকে। কখনও মাইসোরে ঝমঝমিয়ে পড়া বৃষ্টির মধ্যেও বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছেন, সঙ্গ দিয়েছেন সাধারণ মানুষ। মধ্য প্রদেশে বিজেপি সমর্থকদের মোদী মোদী স্লোগান শুনে যাত্রা থেকে তাঁদের দিকে উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দিয়েছেন। যাত্রার মধ্যে কখনও মা সনিয়ার জুতো বেঁধে দিয়েছেন, কখনও বোন প্রিয়াঙ্কাকে আদর করেছেন। সমবরা ভাস্কর, কমল হাসানের মতো অভিনেতারা যোগ দিয়েছেন যাত্রায়। যোগ দিয়েছেন আরবিআই-এর প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। মহাকাল মন্দিরে গিয়ে শিবের মাথায় দুধ ঢেলেছেন রাহুল। আর কাশ্মীরে প্রবল তুষারপাতের মধ্যেও তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার ছবি তো ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম যাত্রার পর ছুটে গিয়েছিলেন মণিপুরে। সেখানকার দাঙ্গা বিধ্বস্ত জনগণের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর সেখান থেকেই শুরু করেছেন দ্বিতীয় যাত্রা। মুম্বইয়ে যাত্রার শেষ দিনে, উদ্ধব ঠাকরেদের পাশে নিয়ে করেছিলেন বিশাল সভা। এখন তো বিরোধী দলনেতা হিসেবে তিনি কখনও কৃষক, কখনও অগ্নিবীর, কখনও ছাত্রছাত্রীদের কথা তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন। জনগণের সঙ্গে মেলামেশার এই সুযোগ যে তাঁকে অনেকটা বদলে দিয়েছে, তা রাহুল নিজেই স্পষ্ট করেছিলেন। প্রথম, ভারত জোড়ো যাত্রা শেষ করার ঠিক পরের সাংবাদিক সম্মেলন। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় বড় বড় কাঁচা-পাকা চুল। পরনে ট্রেডমার্ক সাদা টি-শার্ট। চোখে এক অদ্ভূত ঔজ্জ্বল্য। ওই দিন রাহুল বলেছিলেন, “আপনারা যে রাহুলকে চিনতেন, তাকে আমি মেরে ফেলেছি। সে মরে গিয়েছে।”
সত্যিই কি রাহুলের মধ্যে বড় বদল ঘটে গিয়েছে? রাহুলকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের মতে রাহুল আগেও এই রকমই ছিলেন। একসময় সংবাদ সংস্থা এএনআই-তে কাজ করতেন কংগ্রেসের বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া প্রধান, সুপ্রিয়া শ্রীনাতে। এই প্রতিবেদকের এক সাংবাদিক দাদা, সেই সময় সুপ্রিয়াকে রাহুল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। সুপ্রিয়া তাঁকে জানিয়েছিলেন, রাহুল অন্যান্য ভারতীয় রাজনীতিবিদদের থেকে অনেকটাই আলাদা। তিনি ভিআইপি সংস্কৃতি এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করেন। মাঝেমাঝেই তাঁকে দেখা যায়, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে দিল্লির বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় আচমকা ঢুঁ মারতে। সঙ্গে বিশেষ নিরাপত্তা থাকে না। থাকলেও, তা সাধারণের চোখে ধরা পড়ে না। নরেন্দ্র মোদীকে দেখা যায়, স্থানীয় পোশাক পরে, কিংবা স্থানীয় ভাষা বলে কোনও জায়গায় মানুষের সঙ্গে সংযোগ করতে। এই কায়দা ব্যবহার করতেন ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীরাও। কিন্তু, রাহুল এই পদ্ধতিতে বিশ্বাসী নন। তাঁকে এই পন্থা অবলম্বন করতে অনুরোধও করেছিলেন দলের নেতারা। তিনি নাকি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই সব তিনি করতে পারবেন না। তিনি যেমন, সব জায়গায় তেমনই থাকবেন।
তবে, তাঁর পরিবর্তন একটা এসেছে। আগে নিজের ধ্যান-ধারণা তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারতেন না। নিজেকে প্রকাশ করতে কোথাও তাঁর দ্বিধা ছিল। হয়তো, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না বলেই, নিজের বিশ্বাসের জোরটা ছিল না তাঁর। কিন্তু, সংসদে পরপর দুটি অধিবেশনে তাঁর দুটি বক্তৃতায় তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন, নিজেকে প্রকাশ করতে আর ভয় পান না তিনি। হিন্দুত্বকে কেন্দ্র করেই বিজেপির রাজনীতি আবর্তিত হয়। সেই বিজেপিকেই তিনি ‘আপনারা হিন্দু নন’ বলে আক্রমণ করেছেন। জোর গলায় বলেছেন, “নরেন্দ্র মোদী পুরো হিন্দু সমাজ নয়। বিজেপি পুরো হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি নয়।” যেভাবে তিনি সংসদের অন্দরে ভগবান শিবের ছবি দেখিয়েছেন, তা সম্ভবত কংগ্রেসও আশা করেনি। তাঁর বক্তৃতায় আসছে ভগবান শিবের কথা, চক্রব্যূহের কথা। অর্থাৎ, বিজেপির রাজনৈতিক দর্শনের মূলেই আঘাত করেছেন তিনি। হিন্দু ধর্মকে হাতিয়ার করে তাঁর এই আক্রমণ বিজেপির ঘুম উড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, রাহুল গান্ধীর এই সকল মন্তব্য নিয়ে চর্চা চলছে সাদারণ মানুষের মধ্যে। লোকে রিলস দেখছে, ইউটিউব শর্টস দেখছে, রাহুল গান্ধীর বক্তৃতা শুনছে।
সেই সঙ্গে, বিজেপির পক্ষ থেকে তাঁকে যেভাবে একটানা আক্রমণ করা হয়েছে, সেটাও তাঁর ফিরে আসার কাহিনী তৈরির করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে। ভারতের মানুষ দুর্বলের জয়ের কাহিনী ভালবাসে। বিজেপি যেভাবে রাহুল গান্ধীকে একটানা আক্রমণ করে গিয়েছে, তাও তাঁর পক্ষেই গিয়েছে। রাহুল গান্ধীর পাপ্পু ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। তাঁকে সাংসদ হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। দিল্লিতে তাঁর সরকারি বাসভবন ছেড়ে দিতে হয়। কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর আগে, সাধারণ মানুষের মধ্যে রাহুল গান্ধীর একটা শাহজাদা ভাবমূর্তি ছিল। ক্রমাগত সাধারণ মানুষের মধ্যে গিয়ে গিয়ে সেই তকমাটা ঝেড়ে ফেলেছেন তিনি। আর তারপরই, মানুষের মনে তাঁর প্রতি একটা সহানুভূতির জায়গা তৈরি হয়েছে। সবকিছু হারিয়েও, ফের লড়াইয়ের জন্য উঠে দাঁড়ানো এক নেতার ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে রাহুল গান্ধীর। মানুষ তাঁকে দেখেছে, সর্বস্ব খোয়ানো এক বীর হিসেবে। তিনি যেন, নকআউট হতে হতেও লড়াই না ছাড়া এক বক্সার। তাই তিনি পাপ্পু থেকে হয়ে উঠেছেন পিপলস লিডার বা জনগণের নেতা। প্রমাণ করে দিয়েছেন এভাবেও ফিরে আসা যায়।
তাহলে কি পাস করে গেল পাপ্পু? বলা যেতে পারে শুধুমাত্র পাশ মার্ক পেয়েছেন, লেটার পাননি। তাঁর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে, বিরোধী দলনেতা হিসেবে সকল দলকে নিয়ে চলতে হবে তাঁকে। শুরুতেই, লোকসভার অধ্যক্ষ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে মতানৈক্য তৈরি হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে, তিনি শিক্ষা নিতে পারেন মা সনিয়ার থেকে। শরদ পওয়ারের মতো এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে দূরত্ব মিটিয়েই কিন্তু ২০০৪-এ ইউপিএ সরকার তৈরি করতে পেরেছিলেন সনিয়া। ১০ বছর জোট সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। চ্যালেঞ্জ রয়েছে কংগ্রেসকে ৯৯ থেকে সরকার গঠনের মতো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার। কাজটা বড় সহজ নয়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, কেরল, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের বৃদ্ধির পথে কাঁটা হতে পারে তাদের শরিকরাই। আর সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ এখনও নরেন্দ্র মোদী। মোদীর ক্যারিশণা কতটা ফিকে করতে পারবেন, তার উপরই রাহুল গান্ধীর লেটার মার্ক পাওয়া নির্ভর করছে।