ভিন ধর্মের বিয়েতে কোন রাজ্য শীর্ষে? বাংলার স্থান কোথায়? জানুন চমকপ্রদ পরিসংখ্যান

নিজস্ব প্রতিবেদন: একটি গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থার বিজ্ঞাপন নিয়ে হইচই! বিজ্ঞাপনে নাকি লাভ জিহাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে, হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষোভ। গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থার শোরুমে ‘হামলা’। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিতর্ক। প্রতিবাদী পোস্টের আঁচড়- কিন্তু কেন এই সব? একটি বিজ্ঞাপন যেখানে দেখানো হয়েছে, শ্বশুর বাড়িতে এক শাড়ি পরিহিতা পুত্রবধূর স্বাদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে পুত্রবধূ তাঁর সালওয়ার-কামিজ পরিহিতা […]

ভিন ধর্মের বিয়েতে কোন রাজ্য শীর্ষে? বাংলার স্থান কোথায়? জানুন চমকপ্রদ পরিসংখ্যান
ছবি- ফেসবুক
Follow Us:
| Updated on: Oct 16, 2020 | 11:45 AM

নিজস্ব প্রতিবেদন: একটি গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থার বিজ্ঞাপন নিয়ে হইচই! বিজ্ঞাপনে নাকি লাভ জিহাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে, হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষোভ। গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থার শোরুমে ‘হামলা’। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিতর্ক। প্রতিবাদী পোস্টের আঁচড়- কিন্তু কেন এই সব? একটি বিজ্ঞাপন যেখানে দেখানো হয়েছে, শ্বশুর বাড়িতে এক শাড়ি পরিহিতা পুত্রবধূর স্বাদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে পুত্রবধূ তাঁর সালওয়ার-কামিজ পরিহিতা শাশুড়িকে বলছেন, এই রীতি তো শ্বশুরবাড়ির রেওয়াজে নেই! এরপরই শাশুড়ির উত্তর, এটা তাঁরা তাঁদের মেয়ের জন্য করেছেন, একমাত্র তাঁর খুশির কথা ভেবেই!

এই বিজ্ঞাপনটিকে ঘিরেই চরমে উঠেছে বিতর্ক। গেরুয়া অভিমত, ‘লভ জিহাদ’কে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে। শেষমেশ অবশ্য ক্ষমা চেয়ে বিজ্ঞাপনটি তুলে নিয়েছে গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থাটি। কিন্তু তাতে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।

প্রশ্ন উঠছে, এ ক্ষেত্রে লভ জিহাদের প্রসঙ্গ এল কোথা থেকে? অন্যের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কিংবা ব্যক্তিগত পরিসরে পরস্পরের আনন্দকে ভাগ করে নেওয়া কি জিহাদ? এই নিয়ে অতীতেও বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের একটি গবেষণা রীতিমত উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরেছে। ‘ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভলপমেন্ট সার্ভে’ (আইএইচডিএস) ২০০৫ সালের প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইন্সস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্স’ একটি রিপোর্ট পেশ করে। তাতে ভিন জাতের বিয়ে নিয়ে একাধিক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, যা চাঞ্চল্যকর ও সাম্প্রতিককালের হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারার ভিন্ন মেরুতে অবস্থানকারী।

ছবি- সোশ্যাল মিডিয়া

প্রশ্ন ১. ভারতে কতগুলো ভিন ধর্মের বিয়ে (Interfaith Marriages) হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান কি লিপিবদ্ধ রয়েছে?

এখনও পর্যন্ত সরকারি খাতায় কোনও তথ্য লিপিবদ্ধ হয়নি। উপরন্তু, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে কোনও প্রতিনিধিও নিয়োগ করা হয়নি।

প্রশ্ন ২. ভিন ধর্মের বিয়ে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে?

‘দ্য ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভলপমেন্ট সার্ভে, ২০০৫’ ১৫০৩টি গ্রামের ৪১.৫৫৪টি পরিবার ও ৯৭১টি শহরের বাসিন্দার ওপর একটি পরীক্ষা করেছিল। সৌজন্যে ছিল ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপলায়েড ইকোনমিক রিসার্চ অর্থাত্ এনসিএইআর। এই গবেষণায় স্বামী-স্ত্রীর কাছে ভিন জাতের বিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও প্রশ্ন করেননি গবেষকরা। তবে তাঁদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্ক মত ব্যক্ত করতে বলা হয়েছিল। তাতে ধর্ম বৈবাহিক সম্পর্কে আদৌ কোনও প্রভাব ফেলতে পারে কিনা, তা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র ছিল।

গবেষণা বলছে, দেশের মোট বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে ২.২১ শতাংশ ১৫-৪৯ বছর বয়সী মহিলা, ভিন জাতে বিয়ে করেছেন। মূলত ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে ভিন জাতের সঙ্গীকে বিয়ে করার প্রবণতা বেশি, সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে তা ২.৮ শতাংশ। ২০-২৪ বছর বয়সী মহিলাদের ভিন জাতে বিয়ে করার পরিসংখ্যান কিছুটা কম, ২.৩ শতাংশ। ২৫-২৯ বছর বয়সী মহিলাদের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটি ২ শতাংশ আর তিরিশোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে তা ১.৯ শতাংশ।

আরও চমকপ্রদ একটি বিষয় হল, গ্রামের তুলনায় শহরের মহিলারা ভিন জাতে বিয়ে করার ক্ষেত্রে বেশি স্বচ্ছন্দ্য। শহরে এই সংখ্যা ২.৯ শতাংশ, গ্রামে তা ১.৮ শতাংশ।

প্রশ্ন ৩. ধর্ম অনুযায়ী ভিন-ধর্মের বিয়ের পরিসংখ্যানটা ঠিক কেমন?

গবেষণা বলছে, খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী মহিলাদের মধ্যেই এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। দেশের মোট ৩.৫ শতাংশ খ্রিষ্টান মহিলা ভিন ধর্মে বিয়ে করেছেন। শিখদের ক্ষেত্রে তা ৩.২ শতাংশ। হিন্দুদের ক্ষেত্রে ১.৫ শতাংশ আর মুসলিমদের সংখ্যা ০.৬ শতাংশ।

প্রশ্ন ৪. ভারতের কোন রাজ্যে ভিন ধর্মে বিয়ের সংখ্যা সর্বাধিক?

সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে, পঞ্জাব এক্ষেত্রে সবার উপরে। ৭.৮ শতাংশ ভিন জাতের বিয়ে রয়েছে সেই রাজ্যে। শিখ ও হিন্দুদের মধ্যে একাধিক বিয়ে হয়েছে পঞ্জাবে। ঝাড়খণ্ডে ৫.৭ শতাংশ, অন্ধ্রপ্রদেশে ৪.৯ শতাংশ ভিন ধর্মে বিয়ের তথ্য রয়েছে। ছত্তিশগড়ে ০.৬ শতাংশ, রাজস্থানে ০.৭ শতাংশ। তবে পশ্চিমবঙ্গে ভিন ধর্মে বিয়ের পরিসংখ্যান সব থেকে কম, ০.৩ শতাংশ।

সর্বশেষ প্রশ্নটি হল, এক প্রেমিক যুগল যদি ভিন ধর্মে বিয়ে করে, তাহলে তাঁদের সেই সম্পর্ক কি আদৌ সমাজের উপর কোনও প্রভাব ফেলে?

সমাজবিজ্ঞানীদের কিন্তু স্পষ্ট উত্তর, ‘না’। উল্টে তাঁরাই বলছেন, ভিন ধর্মের বিয়ে ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল ধর্মনিরপেক্ষ দেশের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে আরও সমৃদ্ধ করে। একটি আর্ন্তধর্মীয় বিয়েতে সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম হয়।

বিজ্ঞাপনটি তুলে নিয়েছে গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থাটি। অনেক নেটিজেনই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাঁদেরই একাংশের মত, এই বিজ্ঞাপনটি ছিল বহুমাত্রিক। অনেক উন্নত মানসিকতার পরিচায়ক। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি কেবল গয়নার বিজ্ঞাপন ছিল না, এই বিজ্ঞাপনে অনেক না বলা কথা ছিল।

তাঁদের মতে, গয়নার মতো আলগা হয়ে যেসব ধর্মীয় চিন্তাভাবনাগুলি ঝুলছে সমাজের শরীরে, সেসবের উর্ধ্বে উঠে অনেক না বলা কথা বলেছে এই বিজ্ঞাপনটি। নেটিজেনদের আফসোস, অনেক যত্নে বানানো একটি বিজ্ঞাপন, সম্পর্কের মূল্যবোধকে প্রকাশ করেছে। মন ভালো করা একটি বিজ্ঞাপন। সংস্থা তুলে নিয়েছে বটে, তবে টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টায় সেই বিজ্ঞাপনই এখন ভাইরাল। আর এটাই বোধহয় সপাটে চড় হিন্দুত্ববাদীদের গালে।