এক ধাক্কা অওর! ভূমিকম্পে ডুবে যাবে কলকাতা? এ কেমন শহর!

Earthquake: কোনও সতর্কতাই নেই কলকাতা শহরে। বাড়ি তথা বহুতল নির্মাণ করার ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম-নীতির ধার ধারে না কেউ। কসবা, রাজারহাট সহ একাধিক জায়গায় নীচু জমি বা জলাজমির ওপর তৈরি হয়েছে বাড়ি। এছাড়া দুটি বাড়ির মাঝে ফাঁক নেই, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

এক ধাক্কা অওর! ভূমিকম্পে ডুবে যাবে কলকাতা? এ কেমন শহর!
Image Credit source: GFX- TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Jan 07, 2025 | 8:01 PM

কলকাতা: শীতের লেপ মুড়ি দেওয়া সকাল। কেউ কেউ চোখ কচলে কুয়াশা পেরিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছেন। কেউ আবার মেপে নিচ্ছেন, আজ শীত কেমন। ব্য়স্ততা শুরু হয়নি তখনও। হঠাৎ যেন নড়ে উঠল পায়ের তলার মাটিটা। মাথা ঘুরছে নাকি! মুহূর্তের ভ্রম ভাঙতেই বোঝা গেল, ভূমিকম্প। মঙ্গলবার সকালে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ ধূপগুড়ি, শিলিগুড়ি, দুই দিনাজপুরে তো বটেই, দক্ষিণবঙ্গ অর্থাৎ কলকাতা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অনুভূত হয়েছে কম্পন। পরে জানা যায়, ভূমিকম্পের উৎসস্থল আসলে তিব্বত।

সিকিম থেকে ওই উৎসস্থলের দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার। আর সেই ভূমিকম্পেই কেঁপেগেল কলকাতার বহুতল। প্রশ্ন উঠছে, আর একটু কাছাকাছি হলে, সব ঠিক থাকবে তো!

কেন ভূমিকম্প?

হিমালয় ঘেঁষা এই অঞ্চল অর্থাৎ নেপাল বা তিব্বত বরাবরই ভূমিকম্প প্রবণ। আজ, ৭ জানুয়ারির সকাল অনেককেই সেই ২০১৫ সালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। নেপালে ৭.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে এভাবেই কেঁপে উঠেছিল কলকাতা। ক্ষতি হয়েছিল উত্তরবঙ্গে।

আসলে এই অংশে ভারতীয় প্লেটের সঙ্গে ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষ হয়েই চলেছে। ইউরেশীয় প্লেটের নীচে একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে ভারতীয় প্লেট।

প্রতি বছর ৪০ থেকে ৫০ মিটার করে সরছে ভারতীয় প্লেট। সংঘর্ষের ফলে প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে হিমালয়ের নীচে। যেন বারুদের ভাণ্ডার। মাঝে মধ্যে জমানো শক্তিই বেরিয়ে আসছে ভূমিকম্প রূপে। অতীতে নেপালের ভূমিকম্প, সিকিমের ভূমিকম্প তারই উদাহরণ।

কলকাতার অবস্থানটা ঠিক কেমন?

সিসমোলজিতে ‘সিসমিক জোন’ বা ‘সিসমিক বেল্ট’ বলতে বোঝায় বেশ খানিকটা অঞ্চল, যার চরিত্র একইরকম। এ ক্ষেত্রে সিসমিক জোন বলতে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাকে বোঝানো হয়। সেই জোনের মধ্যে আবার ভাগ রয়েছে। সেই হিসেবে কলকাতা রয়েছে সিসমিক জোন ৪-এ। আর নেপাল, ভুটান, সিকিম, উত্তরবঙ্গ রয়েছে সিসমিক জোন ৫-এ, যা অনেক বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। অর্থাৎ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার একেবারে কাছেই অবস্থান কলকাতার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেই হিসেবে কলকাতার খুব বেশি ঝুঁকি না থাকলেও বহুতলগুলির জন্য ঝুঁকি থাকে অনেকটাই। ভূমিকম্পের সময় মাটির নীচে যে তরঙ্গ তৈরি হয়, তা বহুতলগুলিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

কলকাতার নীচে কি কোনওদিন তৈরি হতে পারে ভূমিকম্পের উৎস?

যে সব জায়গায় মাটির নীচে প্লেট এভাবে সরছে, সেগুলিকেই ভূমিকম্প প্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। তবে, আশার কথা হল, কলকাতা ঠিক তেমনটা নয়। ভূতত্ত্ববিদ জ্ঞান রঞ্জন কয়াল উল্লেখ করেছেন, কলকাতার মাটির নীচে ভয় না থাকলেও চারপাশেই রয়েছে আতঙ্কের কারণ।

তিনি বর্ণণা করেছেন, কলকাতার উত্তরে রয়েছে সিকিম-দার্জিলিং অঞ্চল, যেখানে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা থাকে। পূর্বে রয়েছে শিলং প্লাটু, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে বাংলাদেশ ও কলকাতার মাঝে ভূপৃষ্ঠের নীচেও রয়েছে ‘সোর্স জোন’। অর্থাৎ সেখানেও ভূমিকম্পের উৎস তৈরি হতে পারে। প্লেট বাউন্ডারি থেকে দূরে থাকলেও কলকাতার আশপাশে অনেক সোর্স জোন রয়েছে। ফলে কম্পনের তীব্রতা হতে পারে আরও ভয়ঙ্কর।

জানেন কলকাতা ঠিক কতটা নড়বড়ে?

২০১৫ সালে কলকাতায় যে কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি হচ্ছে, উড়ালপুল আর মেট্রোর লাইনে জৌলুস বাড়ছে, তার সবটাই আসলে ফাঁপা! একটু ধাক্কা লাগলেই সব শেষ হয়ে যেতে পারে। না, কোনও অহেতুক আশঙ্কা নয়। রিপোর্ট বলছে এমনটাই।

২০১৫ সালে আইআইটি-র গবেষণায় উঠে আসে, কলকাতা শহরটা আসলে নড়বড়ে জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। রিপোর্ট বলছে, মাটি থেকে প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার গভীর পর্যন্ত রয়েছে, বালি-কাদা-পচা জিনিসের স্তর, যাকে পলিমাটিও বলা চলে।

পূর্বে রয়েছে কলকাতার ওয়েটল্যান্ড আর পশ্চিম দিকে বইছে হুগলি নদী। আইআইটি-র বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে নরম ওই মাটিতে চাপ পড়লেই জলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, আর তাতেই ডুবে যেতে পারে বহুতল।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক পার্থ প্রতীম বিশ্বাস বলছেন, “একসময় মনে করা হত কলকাতা খুব সুরক্ষিত। কিন্তু পরে দেখা গিয়েছে যথেষ্ট ঝুঁকির। পলিবাহিত নরম মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে কলকাতা। ভূমিকম্পের সময় ‘ভার্টিকাল’ কম্পন হলে অর্থাৎ মাটির নীচে তরঙ্গের আপ-ডাউন হলে জলের স্তর প্রবল চাপে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তেমনটা হলে বড় বিপর্যয় হতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, ব্রিজ থেকে শুরু করে বিল্ডিং, কলকাতায় সবটাই দাঁড়িয়ে আছে পলিমাটির ওপর।”

কতটা সাবধান তিলোত্তমা?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও সতর্কতাই নেই কলকাতা শহরে। বাড়ি তথা বহুতল নির্মাণ করার ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম-নীতির ধার ধারে না কেউ। কসবা, রাজারহাট সহ একাধিক জায়গায় নীচু জমি বা জলাজমির ওপর তৈরি হয়েছে বাড়ি। এছাড়া দুটি বাড়ির মাঝে ফাঁক নেই, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। ফলে কম্পন বেশি হলে ভিত আলগা হয়ে যেতে পারে। গায়ে গায়ে বাড়ি থাকলে ভিত দুর্বল হয়ে যায়। এছাড়া দার্জিলিং-এ বা শিলং-এ পাহাড়ের ঢালে বাড়ি তৈরি হচ্ছে, এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ বলেও উল্লেখ করছেন বিজ্ঞানীরা।

উল্লেখ্য, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার রেকর্ড বলছে, ১৯৩৪ সালে কলকাতায় ৮.১ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। সেই সবথেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মেটিয়াবুরুজ, বালিগঞ্জ, রবীন্দ্র সদন, শোভাবাজার। সুতরাং কলকাতার ঝুঁকি একেবারে নেই, সেটাই বা কে বলতে পারে।