প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাস, বারবার ঝড়ের তোড়ে দুয়ার ভেঙেছে বাংলার
রবীন্দ্রনাথ থেকে মোহিতলাল মজুমদার কিংবা অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের আখ্যানে ঝড়ের নানা বর্ণনা, কখনও সে রোমান্টিক কখনও ভয়াল।
সৌরভ গুহ: ‘ঝড় কে আমি করবো মিতে, ডরবো না তার ভ্রুকুটি তে।’ বহু বার শোনা এই রবীন্দ্রসঙ্গীতই সহজে বুঝিয়ে দিতে পারে ঝড় (Cyclone) নিয়ে বাঙালির রোমান্টিসিজ়মের অন্ত নেই। ‘কাল বোশেখী ঝড়’কে জয়ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানানোর আহ্বান রাখা সেই রবীন্দ্রনাথই আবার ঝড়ের এক ভয়াল ছবিই এঁকেছেন তাঁর ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায়। ‘চারিদিকে ক্ষিপ্তন্মত্ত জল / আপনার রুদ্র নৃত্যে দেয় করতালি লক্ষ লক্ষ হাতে।’ ঝড় নিয়ে এই দুই বিপরীত ছবিই বাংলার প্রকৃত বাস্তবতা। একদিকে বিধ্বংসী, লক্ষ মৃত্যুর কারণ অন্য প্রান্তে চমকপ্রদ। তবে বাংলার ঝড়ের সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে ভয়াল ঝড়ের দৃষ্টান্ত একের পর এক রয়েছে দুই বঙ্গ জুড়েই । রবীন্দ্রনাথ থেকে মোহিতলাল মজুমদার কিংবা অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের আখ্যানে ঝড়ের নানা বর্ণনা, কখনও সে রোমান্টিক কখনও ভয়াল।
বাংলার ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতি ঝড়ের ইতিহাস খুঁজতে গেলে প্রথমেই নাম আসে ১৭৩৭ সালের ভয়ঙ্কর হুগলি রিভার সাইক্লোন বা ক্যালকাটা সাইক্লোনের। এই সাইক্লোনের ধ্বংসলীলা ছিল ভয়াবহ। শহর কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। প্রায় তিন লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান এই ঝড়ে। শুধু কলকাতাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেনন ৩ হাজার মানুষ। ২০০টি জাহাজ-নৌকা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর ১৭৮৭, ১৭৮৯,১৮২২, ১৮৩৩ সালে গাঙ্গেয় বঙ্গে বারবার হানা দেয় প্রাণঘাতি ঝড়। দশ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এই সব ঝড়ে ।
এরপর বাংলায় ঝড়ের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতি হয় ১৮৭৬ সালের দ্য গ্রেট বেঙ্গল সাইক্লোন বা কুখ্যাত বাকেরগঞ্জ সাইক্লোন। এই ঝড়ের তাণ্ডবে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ মারা যান। বাংলাদেশের সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়া এই ঝড়ের ধ্বংসলীলার জেরে ঢাকা শহরে লোক সমাগম এক ধাক্কায় লাফিয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এই সাইক্লোন মোকাবিলায় ইংরেজ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে পরবর্তী সময়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে ।
বাকেরগঞ্জের ওই ঝড়ের পর আসে ১৯৭০ সালের বহু আলোচিত ভোলা সাইক্লোন। পূর্ব পাকিস্তানের ওই ঝড়ের জেরে মারা যান প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ । নদী নালা খাল বিল অধ্যুষিত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এর আগে এবং পরে ও ঝড়ের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের স্বাক্ষী থেকেছেন সেখানকার মানুষ । ঘূর্ণিঝড়ে বাড়ির টিনের চাল উড়ে যাওয়ার ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ফেরে ।
পশ্চিমবঙ্গে বারংবার ঝড়ের তাণ্ডবের সাক্ষী থেকেছে সুন্দরবন , দিঘা-সহ বাংলা-ওড়িশা সীমান্ত। তবে একটা পরিসংখ্যান বলছে বঙ্গোপসাগর থেকেই বারংবার প্রাণঘাতী সাইক্লোন জন্ম নিয়েছে। এ বিষয়ে বঙ্গোপসাগরের রীতিমতো দুর্নাম আছে গোটা পূর্ব ভারতে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঝড় হয় ২০১০ সালে। নাম তার আয়লা। এই ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবনের নদীবাঁধ । ধ্বংস হয় চাষের জমি। সঙ্কট দেখা দেয় পানীয় জলের। এই সাইক্লোনের পর একে একে ফনি , বুলবুল , হুদহুদ ধেয়ে আসে । আয়লার দশ বছরের মাথায় ২০২০ সালে ব্যাপক আকার ধারণ করে সাইক্লোন আমফান ।
সাধারণত বাড়ির ছাদে কিংবা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ঝড়ের মেঘ ও তার রোমান্টিকতা উপভোগ করা কলকাতাবাসী বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে দিনের পর দিন কাটাতে বাধ্য হয় । গাছ উপড়ে খোদ শহর কলকাতাকে মনে হয় সুন্দরবন। বাংলা সাহিত্যে ঝড় নানা উপমায় নানা উপলব্ধিতে উঠে এসেছে । তবে আমফানের তুলনা টানতে গিয়ে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘পূজার ভুত’ গল্পের সেই বিখ্যাত উপমাটি মনে পড়ে যায়, ‘যখনই রাত্রিকালে বাদলা ও দুর্যোগ হয়, বাহির বাড়িতে কে যেন প্রাণপণে বেহালা বাজায়।’ আমফানের ঘূর্ণিঝড় সেদিন যখন কলকাতার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল এই তীব্র বেহালার সুর কে না শুনেছে ।
আরও পড়ুন: আমফানের এই সব ভয়াল স্মৃতি যেন ফিরিয়ে না আনে ইয়াস!