শহরে দাঁড়িয়ে বিপজ্জনক পুরনো বাড়ি, শরিকি ঝামেলাই গলার ফাঁস
এই মুহূর্তে শহরে প্রায় ৩ হাজার বিপজ্জনক বাড়ির মধ্যে ৪০০টির অবস্থা খুব খারাপ। সেই সব বাড়ির বাসিন্দাদের বার বার নোটিস দিয়েও কাজ হয়নি। কোথাও মালিক-ভাড়াটে, কোথাও শরিকি বিবাদে বাড়িগুলির সংস্কার হচ্ছে না।
কলকাতা: শরিকি বিবাদের জেরেই শহরের সিংহভাগ জরাজীর্ণ বাড়ি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যা বিপদ বাড়াচ্ছে আশপাশের লোকজনদের। শনিবার টক টু কর্পোরেশনে এক নাগরিকের অভিযোগের ভিত্তিতে বলতে গিয়ে এমনই দাবি করলেন কলকাতা পুরসভার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিম।
এদিন এন্টালি এলাকার এক বাসিন্দা ফোন করে প্রশাসককে বলেন, তাঁর বাড়ির পাশে বিপজ্জনক ভাবে একটি বাড়ি রয়েছে। সেটির মালিকরা নিজেদের ব্যক্তিগত ঝামেলার জন্য মেরামত করছে না। ফলে তাঁদেরও চিন্তায় থাকতে হচ্ছে। এরপরই ফিরহাদ হাকিম বলেন, শহরের এমন অনেক বাড়ি রয়েছে, যেগুলির মালিকরা পুরসভা কে ব্যবস্থা নিতে দেন না, নিজেরাও নেন না। ফলে প্রাণ হাতে করে থাকতে হয় পড়শিদের। বিপজ্জনক বাড়ি সংক্রান্ত পুরসভার আইনে সংশোধন এনেও তেমন কোনও সুবিধা হয়নি বলেই মত পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিকদের। রাজনৈতিক এবং মামলা মোকদ্দমার কারণে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে বলেই দাবি তাঁদের।
পুরসভার রেকর্ডে শহরে বিপজ্জনক বাড়ির সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। কিন্তু বিপজ্জনক অংশ না ভাঙার ফলে যে ঝুঁকির আশঙ্কা, তাতে পুরসভার ভুমিকা কী? প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনিক মহলে। সরকারি হিসেবে ৩ হাজার বলা হলেও বেসরকারি হিসেব অন্যই বলছেন বিল্ডিং বিভাগের কর্মীরা। তাঁদের কথায়, শহরে এমন ক’টা বাড়ি রয়েছে, তার তথ্যও নেই পুরসভার কাছে। কেউ অভিযোগ করলে তখন পুরসভা জানতে পারে যে সংশ্লিষ্ট নির্মাণটি বেআইনি। বরোভিত্তিক দল থাকলেও পুরকর্মীর অভাবে অনেক সময়েই বেআইনি নির্মাণের উপর নজরদারির কাজটা ঠিক ভাবে করা যায় না বলে পুরসভা সূত্রের খবর।
আরও পড়ুন: পরিবহণ দফতরে ৭২৫ কোটির ‘কেলেঙ্কারি’, বিস্ফোরক অখিলের নিশানায় শুভেন্দু
কিন্তু বেআইনি নির্মাণের ‘রোগ’ এত পুরনো হওয়া সত্ত্বেও কেন সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য নেই পুরসভার কাছে? এই প্রশ্ন উঠেছে পুর প্রশাসনের একাংশের মধ্যে। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘নির্দিষ্ট করে সংখ্যা বলা মুশকিল। ক’টা ভাঙার অর্ডার রয়েছে, সেটা বলা সম্ভব। তবে বেশির ভাগ বেআইনি নির্মাণই পুরসভা ভেঙে দেয়। কয়েকটি জায়গায় হয়তো অসুবিধায় পড়তে হয়।’’
বেআইনি এবং বিপজ্জনক এই দুই রোগে এতটাই আক্রান্ত শহর, যার চিকিৎসা করা এত সহজ নয় বলেই মনে করেন খোদ প্রশাসক। তাঁর কথায়, “বেআইনি বাড়ি প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারদের বিরুদ্ধেও কড়া পদক্ষেপের কথা জানিয়েছি। কিন্তু বিপজ্জনক বাড়ির ক্ষেত্রে কতটা কী করা যাবে, কিছুই বুঝতে পারছি না। এভাবে বিপজ্জনক বাড়িগুলো ভাঙতে থাকলে প্রাণহানির আশঙ্কা থাকবে। তাতে তো মানুষেরই ক্ষতি হবে।”
আরও পড়ুন: শিল্প না হলে জমি চাই, মুখ্যমন্ত্রীর সামনে বিক্ষোভ দেখানোর হুঁশিয়ারি কৃষকদের
পুরসভার কমিশনার বিনোদ কুমারের টেবিলে জমা পড়া সাম্প্রতিককালের রিপোর্ট ও পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে শহরে প্রায় ৩ হাজার বিপজ্জনক বাড়ির মধ্যে ৪০০টির অবস্থা খুব খারাপ। সেই সব বাড়ির বাসিন্দাদের বার বার নোটিস দিয়েও কাজ হয়নি। আমপানের পরে সেই বাড়িগুলি আরও দুর্বল হয়েছে। ওই আধিকারিকের কথায়, “কোথাও মালিক-ভাড়াটে, কোথাও শরিকি বিবাদে বাড়িগুলির সংস্কার হচ্ছে না।”
সংস্কার না হওয়ায় ২০১৬ সালে ৪২ নম্বর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে মৃত্যু হয় দু’জনের। তখন এ নিয়ে শোরগোলের পর পাশ হয় পুর আইনের ৪১২(এ) ধারা। এতে বিপজ্জনক বাড়ি জানিয়ে পাঠানো নোটিসকে ‘কনডেম্ড’ নোটিসও ধরা হয়। এই ধারায় বিপজ্জনক বাড়ির মালিককে বাড়িটি ভেঙে ফের নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তার বদলে ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিয়ো’ বা এফএআরের ক্ষেত্রে ছাড় মিলবে। কিন্তু বাড়ি মালিক সেই কাজ না করলে ভাড়াটেদেরও সুযোগ দেবে পুরসভা। তারাও সংস্কার করতে না পারলে পুরসভাই ওই কাজে নামবে। আদতে এফএআরের ছাড় বা কনডেমড নোটিস ধরিয়েও কাজ হয়নি বহু জায়গায়। পুরসভার হিসেব অনুযায়ী, এখনও প্রায় ১২ হাজার শহরবাসী মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে আঁকড়ে রয়েছেন বিপজ্জনক বাড়িকেই।
বর্ষাকালে বিপজ্জনক বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। কারণ, বৃষ্টির জল শুষে ইট-পলেস্তরা দিয়ে তৈরি কাঠামো ফুলে ওঠে। ফলে সেগুলি খসে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। টানা বৃষ্টি হলে তাই শহরের বহু জায়গায় এ ভাবে বাড়ি ভেঙেও পড়ে। পুরসভার বিল্ডিং দফতরের এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, ‘‘সারা শহরেই বৃষ্টির মরসুমে বাড়তি চিন্তা থাকে। বেশির ভাগ বাড়ি ভাঙার ঘটনা এ সময়টাতেই ঘটে।’’ সে কারণে বরোভিত্তিক বিপজ্জনক বাড়ির তালিকাও রাখে পুরসভা। যদিও পুর আধিকারিকদের অনেকেই জানাচ্ছেন, বিপজ্জনক জেনেও বাড়িগুলিতে লোকজন বসবাস করায় অনেক সময়ই তা ভাঙার কাজ সুষ্ঠু ভাবে করা যায় না। কারণ, নোটিস দেওয়ার পরেও অনেকেই সেখান থেকে সরতে চান না। ফলে ভাঙতে গিয়ে অনেক জায়গায় পুরকর্মীদেরই প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়।