EXPLAINED: শুধুই কি মতের অমিল? কোন দিকে গড়াচ্ছে তৃণমূলের অন্দরের ‘দ্বন্দ্বের’ জল?
TMC: ফের কি তৃণমূলে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব? চব্বিশের লোকসভা ও একাধিক বিধানসভা উপনির্বাচনে ভাল ফলের পর কি শাসকদলের অন্দরে চাপানউতোর বেড়েছে? তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্যের জবাবে দলের সুপ্রিমোর কথা উল্লেখ করছেন নেতারা। কী চলছে তৃণমূলের অন্দরে? পড়ুন টিভি৯ বাংলার বিশেষ প্রতিবেদন...
কলকাতা: তারা রাজ্যের শাসকদল। ২০১১ সাল থেকে বাংলায় ক্ষমতায় রয়েছে। উনিশের তুলনায় চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে বেড়েছে আসন। আরজি কর কাণ্ডের আবহেও রাজ্যে ৬ বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনে ‘ছক্কা’ হাঁকিয়েছে। আর বছর দেড়েকের মধ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে সংখ্যার দিক থেকে স্বস্তিতে থাকার কথা। সেই জায়গায় কি দলের অন্দরেই চাপানউতোরে অস্বস্তি বাড়ছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের? ফের কি মাথাচাড়া দিয়েছে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বের? তৃণমূল নেতাদের বিভিন্ন মন্তব্যে বাড়ছে গুঞ্জন। কী বলছেন তাঁরা? তৃণমূলের অন্দরের ‘দ্বন্দ্ব’ নিয়ে কী বলছে বিরোধীরা?
লোকসভা নির্বাচনের আগে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব –
তৃণমূলের অন্দরে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্যে আসে লোকসভা নির্বাচনের আগে। রাজনীতিতে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা থাকার কথা বলে সেই বিতর্ক প্রথম উসকে দেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কী বলেছিলেন তিনি? তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, “দলে প্রবীণদের প্রয়োজন। তবে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা থাকা দরকার।” ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, যে পরিশ্রম একজন ৪০ বছরের মানুষ করতে পারেন, সেটা বয়স বাড়লে আর করা সম্ভব নয়।
এই খবরটিও পড়ুন
দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের মন্তব্য নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয় তৃণমূলে। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতারা আর টিকিট পাবেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এদিকে, বয়সের ঊর্ধ্বসীমা নিয়ে অভিষেকের মন্তব্যকে সমর্থন করেন কুণাল ঘোষ, মদন মিত্রের মতো নেতারা। আর বর্ষীয়ান নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত এবং অভিমত মেনে চলি। যদি দল এরকম কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে দলের সকলকেই মেনে চলতে হবে।”
নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে তৃণমূলে যখন আলোচনা ক্রমশ বাড়ছে, তখন পরোক্ষে বয়স নিয়ে নিজের বক্তব্য বুঝিয়ে দেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “আমি মনে করি যতক্ষণ সুস্থ থাকব, সেটাই আমার বয়স। সুস্থতা মানুষকে কাজ করতে শেখায়।” এরপর তৃণমূলে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব আর মাথাচাড়া দেয়নি। লোকসভা নির্বাচনে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়ের মতো প্রবীণ নেতারা টিকিট পান। ফের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা।
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে ‘রাত দখল’-কে সমর্থন অভিষেকের-
লোকসভা নির্বাচনে উনিশের চেয়ে এবার ভাল ফল করেছে তৃণমূল। উনিশে তারা পেয়েছিল ২২টি আসন। এবার পেয়েছে ২৯টি আসন। লোকসভার ফলের জন্য মমতার পাশাপাশি ‘সেনাপতি’ অভিষেকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন তৃণমূল নেতারা।
লোকসভা নির্বাচনের মাস দুয়েক পর আরজি কর মেডিক্যালের সেমিনার হল থেকে এক জুনিয়র ডাক্তারের দেহ উদ্ধার হয়। ‘তিলোত্তমা’-কে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন সাধারণ মানুষ। গত ১৪ অগস্ট ‘রাত দখল’-র ডাক দেওয়া হয়। সেই ‘রাত দখল’-র ডাককে সমর্থন জানান অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি, অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনে নামলে, সেই আন্দোলনকেও সমর্থন জানান তিনি। তবে চিকিৎসা পরিষেবা চালু রেখে আন্দোলনের বার্তা দেন তিনি।
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, আরজি কর কাণ্ডে রাজ্যের শাসকদল অস্বস্তিতে পড়েছে। চিকিৎসা পরিষেবা চালু রাখার কথা বললেও তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বুঝিয়ে দেন, ডাক্তারদের আন্দোলনে তাঁর সমর্থন রয়েছে।
আরজি কর কাণ্ডে আন্দোলনকারী শিল্পীদের নিয়ে কুণালের মন্তব্যে বিতর্ক-
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন শিল্পীরা। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মিছিলে পা মেলান। দোষীদের শাস্তির দাবিতে সরব হন। আর আন্দোলনকারী একাংশ শিল্পীদের নিয়েই তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুণাল ঘোষের মন্তব্যে বিতর্ক বেড়েছে।
কী বলেছেন কুণাল?
তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদকের বক্তব্য, “আরজি করের নিন্দা করেছে বলে বাদ একদম নয়। একশো শতাংশ নিন্দা করবেন। কেন করবেন না? যাঁরা এই স্লোগান দিয়েছেন, অমুকের গালে জুতো মারো। তালে-তালে কখনও বলছেন, বাংলাদেশের মতো পালাতে হবে। মিথ্যা বিকৃত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট নিয়ে নাটক করেছেন। আমাদের দলের আয়োজিত কোনও অনুষ্ঠানে যেন তাঁদের দেখা না যায়। তৃণমূল কর্মীদের আবেগে আঘাত লাগছে।”
তৃণমূলের অনুষ্ঠানে কাদের যেন দেখা না যায়, সেকথা স্পষ্ট করে দেন কুণাল। বলেন, “যাঁদের মতাদর্শ তৃণমূলের সঙ্গে মেলে না তাঁদের কাজের অধিকার আছে। তবে যে কয়েকজন ইচ্ছাকৃত ভাবে, পরিকল্পিত ভাবে নিজেদের ধান্দায় আন্দোলন করেছেন, তাঁদের বয়কট করুন।” কিন্তু, এভাবে কি শিল্পীদের বয়কটের ডাক দেওয়া যায়? উঠছে প্রশ্ন।
কুণালের মন্তব্য নিয়ে কী বলেছেন অভিষেক?
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে যোগ দেওয়া শিল্পীদের বয়কটের ডাক নিয়ে কুণালের মন্তব্যকে সমর্থন করেননি অভিষেক। বরং তিনি বলেন, “১৪ অগস্ট যাঁরা রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন, কেউ সমর্থন করুক বা না করুক, আমি সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। আমি আজও একই কথা বলছি। কারও ভাল লাগতে পারে বা খারাপ লাগতে পারে।” অনুষ্ঠানে ডাকা নিয়ে তিনি বলেন, “কোথায় কাকে নিয়ে গান গাওয়াবে, কখন গাওয়াবে, কে গান গাইবে, আমি জোর করে কারও মাথায় চাপাতে চাই না। আমি কোথা দিয়ে হাঁটব-চলব এটা আমার সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা সকলের আছে। উনি বলতে পারেন। পার্টির তরফে কেউ বলেছে? কোনও নোটিস দেখেছেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা আমি জেনারেল সেক্রেটারি কিছু বলেছি?” কুণালের বক্তব্যকে যে তিনি সমর্থন করছেন না, তা স্পষ্ট করে দেন।
অভিষেকের মন্তব্যের জবাব কুণালের-
তৃণমূলে তিনি অভিষেকপন্থী হিসেবেই পরিচিত। মমতার পর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে একাধিকবার বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। কিন্তু, শিল্পীদের বয়কটের ডাক নিয়ে অভিষেকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন না কুণাল ঘোষ। তাৎপর্যপূর্ণভাবে টেনে আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
অভিষেকের মন্তব্য নিয়ে কী বললেন কুণাল?
তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বলেন, “কোনও শিল্পীর স্বাধীনতায় হাত পড়ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বোচ্চ নেত্রী। তিনি শেষ কথা বলবেন। আরজি করের সময় তিনি কুৎসা-চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। উনি যা বলবেন মেনে নেব। আমি দলের সৈনিক হিসাবে বলছি, যাঁরা এই নোংরা কথা বলেছেন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা তাঁদের অনুষ্ঠানে ডাকতে পারেন না। এটা দলের একাধিক গ্রুপে পোস্ট করা হয়েছে। এই সার্কুলার আমি দেখেছি। কোথাও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”
এরপরই তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, “যেহেতু আরজি করের সময় উনি (অভিষেক) বাইরে ছিলেন। গোটা বিষয়টির মধ্যে ছিলেন না। এই কুৎসা-চক্রান্ত যাঁরা আমরা সামলেছি আমাদের জিজ্ঞাসা করুন। আমরা বলে দেব।”
কুণালের মতো মমতাকে টানলেন ব্রাত্যও-
শুধু কুণাল নন, শিল্পীদের বয়কটের ডাক নিয়ে অভিষেকের মন্তব্য নিয়ে মুখ খুলেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তিনি বলেন, “আমি দলের সদস্য হিসাবে বলব, নেত্রী যা বলবেন, সেটাই আমার কাছে চূড়ান্ত। পরিষ্কার তো দেখতে পারছেন, দলে দুরকমের মত রয়েছে।” কেন তারও ব্যাখ্যা দেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমাদের পার্টি তো রেজিমেন্টেড পার্টি নয়, খোলামেলা পার্টি। সেখানে এক-এক জনের এক-একরকমের মত থাকতে পারে। পদমর্যাদায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার উঁচুতে। তাঁর মত কিংবা কুণাল ঘোষের মত ঠিক না ভুল, তা উত্তর দিতে পারি না। কেবল বলতে পারি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতই আমার মত।”
শিল্পীদের বয়কটের ডাক নিয়ে বিতর্কের মাঝেই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য ফিরহাদের-
আরজি কর কাণ্ডে আন্দোলনে যোগ দেওয়া শিল্পীদের বয়কটের ডাক নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে যখন চাপানউতোর চলছে, তখন দলের নেতাদের নিয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করলেন মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। কারও নাম নিলেন না। তবে ১ জানুয়ারি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবসে তিনি বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেস মানে কেবল ক্ষমতায় থাকা নয়। এর পিছনে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের আত্মত্যাগ। পুলিশ স্যালুট দিচ্ছে, গাড়ি নিয়ে মন্ত্রীরা ঘুরছেন, পদাধিকারীদের পিছনে ১০০ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটা কিন্তু তৃণমূল নয়।”
কারও নাম না নিলেও কাদের উদ্দেশে একথা বলেছেন ফিরহাদ? জল্পনার মধ্যেই শাসকদলকে কটাক্ষ করেন বিজেপি নেতা সজল ঘোষ। তিনি বলেন, “খই ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তেমনি টাকা ছড়িয়ে একশো বেকার ছেলে জোগাড় করে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা কার উদ্দেশে আজ বললেন? পুলিশের স্যালুট পাওয়া, ১০০ জন লোক নিয়ে চলা, নতুন প্রজন্ম, আজকে যারা তৃণমূল করে খাচ্ছে, তাদের উদ্দেশে বলছেন?”
তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবসে অভিষেকের বার্তায় জল্পনা-
তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবসে শুভেচ্ছাবার্তা দিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, সেই শুভেচ্ছাবার্তার ছবি নিয়েই শুরু হয় জল্পনা। ২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের অভিষেকের শুভেচ্ছাবার্তায় তাঁর ও মমতার ছবি দেখা গিয়েছে। এবারের শুভেচ্ছাবার্তায় মমতার ছবি ছিল না। যা নিয়ে গুঞ্জন বেড়েছে।
আরজি কর কাণ্ডে আন্দোলনকারী একাংশ শিল্পীকে বয়কটের ডাক নিয়ে দলের অন্দরে চাপানউতোর বাড়লেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিয়ে এখনও কোনও মন্তব্য করেননি। কুণাল, ব্রাত্যরা বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলবেন, মেনে নেবেন। প্রশ্ন উঠছে, তৃণমূলে ফের কি নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে? আর বছর দেড়েকের মধ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। চতুর্থবার সরকার গড়ার জন্য লড়বে তৃণমূল। তার আগে এই ‘দ্বন্দ্বের’ জল কতদূর গড়ায়, সেটাই দেখার।