যে পাঁচ কারণে প্রিয়াঙ্কা… ‘বাংলার মেয়ের’ বিপক্ষে ‘ভবানীপুরের মেয়ের’ উপর আস্থা বিজেপির

Priyanka Tibrewal: মাত্র ৪১ বছর বয়সেই তাঁর মধ্যে সেই 'এক্স ফ্যাক্টর' খুঁজে পেয়েছেন শীর্ষ নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা।

যে পাঁচ কারণে প্রিয়াঙ্কা... 'বাংলার মেয়ের' বিপক্ষে 'ভবানীপুরের মেয়ের' উপর আস্থা বিজেপির
ভবানীপুর উপনির্বাচন ঘিরে চড়ছে বঙ্গ রাজনীতির পারদ। নিজস্ব চিত্র।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Sep 10, 2021 | 10:56 PM

কলকাতা: প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল (Priyanka Tibrewal)। শুক্রবারের আগে রাজনৈতিক মহল ব্যতীত এই নামটি সঙ্গে পরিচয় খুব বেশি মানুষের ছিল না। কিন্তু গত ৮-১০ ঘণ্টায় সেই প্রিয়াঙ্কাই হয়ে উঠেছেন বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয়। কারণ, ভবানীপুর উপনির্বাচনে (Bhawanipur Bypolls) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁকেই প্রার্থী করেছে বিজেপি। সম্ভাব্য তালিকায় অবশ্য অনেকগুলি নাম ছিল। কিন্তু সবাইকে পিছনে ফেলে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন পেশায় ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা। মাত্র ৪১ বছর বয়সেই তাঁর মধ্যে সেই ‘এক্স ফ্যাক্টর’ খুঁজে পেয়েছেন শীর্ষ নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা।

কিন্তু কোন মন্ত্রবলে সোজা তৃণমূল সুপ্রিমোর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে গেলেন তিনি? কোনও জাদুকাঠির স্পর্শে, নাকি অদৃশ্য কোনও ক্ষমতার জোরে? না, সেসব কিছুই নয়। বরং এর আগে দু-দু’বার নির্বাচনে নেমেও গো-হারা হেরে যাওয়া প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে বেশ কিছু কারণের কথা মাথায় রেখেই এমন রণক্ষেত্রে নামিয়েছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় এবং বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্ব সূত্রে যা খবর, তাতে মূলত ৫ টি কারণের কথা মাথায় রেখে তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে। এই কারণগুলিই বাকিদের থেকে প্রিয়াঙ্কাকে কয়েক যোজন এগিয়ে দিয়েছে।

প্রথমত: ভোট পরবর্তী হিংসার মামলায় প্রিয়াঙ্কার ভূমিকা

বিধানসভা ভোট মেটার পরের কথা। রাজ্যে রোজই একাধিক রাজনৈতিক হিংসা, মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বেশিরভাগই ঘটনাই ঘটছে বিজেপি কর্মীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগের তির থাকছিল তৃণমূলের দিকে। লক্ষাধিক বিজেপি কর্মী ঘরছাড়া বলেও অভিযোগ ওঠে। সেই পরিস্থিতিতে যখন বিজেপির নবাগত বড়, মেজো, ছোট নেতারা ঘরে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন, তখন মাঠে-ময়দানে নেমে বুক চিতিয়ে লড়ে যান প্রিয়াঙ্কা। যা নজর টেনেছে কেন্দ্রীয় নেতাদের।

ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করাই যেন তাঁর রাজনৈতিক মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আদালত যা রায় দেয়, তাকে বিজেপি নিজের বড় জয় হিসেবেই দেখে। যার কৃতিত্ব পুরোটা না হলেও, অধিকাংশ যে প্রিয়াঙ্কার প্রাপ্য, সেটা রাজ্য থেকে কেন্দ্রের বিজেপি নেতারাও একলপ্তে স্বীকার করেছেন। কারণ বিজেপির আইনজীবী সেলের অন্যান্য সদস্যরা আদালতে এই মামলা লড়লেও এই অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেন প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল নিজে। এই বিষয়টি প্রিয়াঙ্কাকে প্রার্থী করার পিছনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। আর এই হিংসাকে ইস্যু করেই উপনির্বাচনে নামছে বিজেপি।

দ্বিতীয়ত: ‘বাংলার মেয়ে’ বনাম ‘ভবানীপুরের মেয়ে’

‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’, ‘বহিরাগত’; এই দু’টি শব্দবন্ধ একুশের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের পক্ষে অন্যতম নির্ণায়ক ফ্যাক্টর হয়ে ধরা দিয়েছিল। তবে এ বার এই দুই স্লোগানই কার্যত অচল। কারণ এই নির্বাচন বাংলার নয়, এবং প্রিয়াঙ্কা ‘বহিরাগত’ নন। তাঁর জন্মভূমি ও কর্মভূমি, দুই-ই কলকাতা। ভবানীপুর এলাকায় বড় হয়েছেন, আইনজীবী হিসেবে যথেষ্ট নামডাক ও সুখ্যাতিও অর্জন করেছেন। ফলে একুশের নির্বাচন জয়ে তৃণমূলের এই দুই প্রধান হাতিয়ার এখানে অকেজো।

প্রিয়াঙ্কার বয়স বর্তমানে ৪১, মমতার ৬৬। তৃণমূল সুপ্রিমোর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞার সঙ্গে প্রিয়াঙ্কার তুলনা করার কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, তৃণমূল ও বিজেপি উভয়ের প্রার্থীই মহিলা। তাই মহিলা হওয়ার কারণে যে প্রিয়াঙ্কা বাকিদের অনেক সহজেই পিছনে ফেলেছেন, তা আলাদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তো খোদ মমতার উদাহরণ টেনেই প্রিয়াঙ্কার সমর্থনে সুর তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য, মমতা যদি কম বয়সে সে সময়ের প্রবাদপ্রতিম বাম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ভোটে হারাতে পারেন, তাহলে প্রিয়াঙ্কাও একই ভাবে মমতাকে হারাতে পারবেন না কেন!

অলংকরণ-অভিজিৎ বিশ্বাস

তৃতীয়ত: প্রিয়াঙ্কার মাতৃভাষা এবং ভবানীপুরে পঞ্জাবি, গুজরাটি ও হিন্দিভাষীদের সমীকরণ

জন্ম-কর্ম কলকাতায়, ফলে ঝরঝরে তাই মাতৃভাষা হিন্দি হলেও ঝরঝরে বাংলায় কথা বলতে সমস্যা হয় না প্রিয়াঙ্কার। কিন্তু তাঁর মাতৃভাষা ভবানীপুরের মতো আসনে রাজনৈতিক ফায়দা এনে দিতে পারে, প্রার্থী বাছাইয়ের সময় সে কথাও মাথায় রেখেছে বিজেপি। ভবানীপুর এমন একটি বিধানসভা কেন্দ্র, যেখানে বাঙালিদের পাশাপাশি পঞ্জাবি, গুজরাটি ও হিন্দিভাষীদের ভাল রকমের আধিপত্য রয়েছে।

ঠিক সেই কথা মাথায় রেখেই প্রিয়াঙ্কার হয়ে প্রচার করতেও ভবানীপুরে আনা হচ্ছে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম হরদীপ সিং পুরী, নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিদের। স্মৃতি আবার গুজরাটি, হিন্দি ও বাংলা; তিনটেই অনর্গল বলে যেতে পারেন। ফলে প্রিয়াঙ্কাকে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মাতৃভাষা এবং ভবানীপুরের জনগণের ভাষার বিভেদের অঙ্কও যে মাথায় রাখা হয়েছে, সেটা পরিষ্কার।

চতুর্থত: হারানোর কিছুই নেই, সঙ্গে কম বয়সি হওয়ার অ্যাডভান্টেজ  

মমতার বিরুদ্ধে কাকে প্রার্থী করা যায়, সেই নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে দফায় দফায় বৈঠক করেছে বিজেপি। আলোচনায় বেশ কয়েকটি নামই উঠে এসেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কার নামই চূড়ান্ত হল। কোন যুক্তিতে? দেখা যাচ্ছে, আলোচনায় ছিল তথাগত রায়ের নাম। যিনি গত কয়েক মাসে দলের বিরুদ্ধেই একের পর এক মন্তব্য করে গিয়েছেন। ফলে তাঁর যে কোনও সুযোগ ছিল না তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। দ্বিতীয় নামটি ছিল রুদ্রনীল ঘোষের। যিনি একুশের নির্বাচনে ভবানীপুর থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না।

এ বাদেও ভোট পরবর্তী হিংসায় নিহত বেলেঘাটার অভিজিৎ সরকারের দাদা বিশ্বজিৎ সরকারের নাম নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বঙ্গ বিজেপির অন্দরে। আলোচনা ছিল দেবশ্রী চৌধুরী, অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম। কিন্তু রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একজন মহিলা প্রার্থীই দিতে চেয়েছিল বিজেপি। তাই বিশ্বজিৎ, অনির্বাণ এঁরা বাদ পড়ে যান। দেবশ্রী লড়াই করে যদি জিতেও যেতেন, তবে তাঁকে হয় সাংসদ, নয়তো বিধায়ক পদ ছাড়তে হতো। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার হারানোর কিছু ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁর নামেই সিলমোহর দেওয়া হয়।

পঞ্চমত: নির্ভেজাল কেরিয়ার, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, ইস্যু পাবে না তৃণমূল

প্রিয়াঙ্কার পেশাগত কেরিয়ারে কোনও দাগ নেই। ভাবমূর্তিও স্বচ্ছ। তাই ব্যক্তি প্রিয়াঙ্কার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে গিয়ে ইস্যু খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হতে পারে তৃণমূলকে। তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে রাজনীতি এবং আইন অনুশীলন করেন। তৃণমূল তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে আক্রমণ করবে, এমন ইস্যুও শাসকদলের হাতে খুব বেশি নেই। বিজেপির আগে কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তিনি যুক্তও ছিলেন না। ফলে সবদিক দেখেই বলা যায়, বিজেপি ঠেকে শিখে গিয়েছে। তাই একুশের ভোটে যে ভুল তারা করেছিল, এ বার সেই পুনরাবৃত্তি করা হয়নি।

আপাতভাবে যখন এ রাজ্যে কেউ বিজেপি করতেন না, তখন যারা গেরুয়া ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রেখেছিলেন, ভোটের আগে যেন তাঁদেরকেই ব্রাত্য করে দেওয়া হয়। তাঁদের জায়গা নেন তৃণমূল এবং অন্যান্য দল থেকে আগত নেতারা। পাশাপাশি বাম বা ঘাসফুলপন্থী সেলেবের বাজারদর তুঙ্গে ওঠে গেরুয়া শিবিরে। টিকিট বণ্টনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় দলবদলু ও সেলেবদের। যার ফল কী হয়েছিল, তা আগামী বহু বছর মনে রাখবে রাজ্যবাসী। বস্তুত, সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই এবার বিজেপি এমন একজনকে প্রার্থী করেছে, যিনি চটকদার কেউ নন। ভাবমূর্তিতে এখনও কালির ছিটে লাগেনি।