‘স্বপ্নের নায়িকা যদি বাইকে বসেন, তাহলে…’
ববি হাকিমের (Firhad Hakim) বাইকে মমতাকে (Mamata Banerjee) চড়তে দেখে আজ স্মৃতিমেদুর বাংলারই আর এক নেতা। এক যুগ আগে মমতাকে বাইকে চড়িয়ে কঠিন রাস্তা পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মুখ থেকেই জেনে নিন সে দিনের গল্প।
সোমনাথ মিত্র: স্কুটারে চালকের আসনে ববি হাকিম (Firhad Hakim), পিছনের আসনে নীল পাড় সাদা শাড়ি, সাদা হাওয়াই চটি। পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ছক ভাঙা, স্বকীয় প্রতিবাদে শামিল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। ডিজিটাল যুগের ভাইরাল সংস্কৃতিতে এ খবর এখন তস্য বাসি। কিন্তু, এই বাসি ছবিই অস্ফুটে হাসি ফোটাচ্ছে কলকাতা থেকে ১৭৩ কিলোমিটার দূরে বসে থাকা এক প্রৌঢ়ের বলিরেখা প্রকট মুখে। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বহু আন্দোলন-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কুশীলব মমতা বিভিন্ন সময় মোটর বাইকে সওয়ার হয়েছেন। কিন্তু বৃহস্পতিবারের বার বেলায় ‘স্কুটারে সরকার’ দেখে লোক জনের লহমায় মনে পড়ে যাচ্ছে আর একটি বাইক সফরের কথাই। সালটা ২০০৯। প্রতিরোধের আগুনে গনগনে এলাকাটার নাম লালগড়। আজ যখন মমতার বাইক সফরের ভাইরাল ছবিতে বিভোর কাকদ্বীপ থেকে কার্সিয়াং, তখনই এক যুগ পিছিয়ে সেদিনের সেই বাইক চালকের ধুকপুকানির গ্রাফচিত্র রেকর্ড করার চেষ্টা করল TV9 বাংলা।
তৃণমূল তখনও ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। ২০০৯ সাল। উত্তপ্ত জঙ্গলমহল। মাওবাদীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে চলছে বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশি অভিযান। শুধু পুলিশই নয়, দোসর কেন্দ্রীয় বাহিনীও। পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির তৎকালীন অবিসংবাদী নেতা ছত্রধর মাহাতর মনে পড়ছে, “জনসাধারণ কমিটির সংগঠন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল সরকার। প্রত্যেক গ্রামে ক্যাম্প তৈরি করেছে হার্মাদ বাহিনী। এখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে রাজ্যবাসীর কাছে অরাজনৈতিকভাবে জঙ্গলমহলে আসার আহ্বান জানিয়েছিলাম আমরা। একজন সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে সাড়া দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।” তাঁর কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলাম, আপনি যদি আসেন, তাহলে আমার উপর আপনাকে ভরসা করতে হবে। আমি কীভাবে আপনাকে নিয়ে যাব, তা আমার উপরই ছেড়ে দিতে হবে।” ছত্রধরের কথায় সেদিন মমতা ভরসা রেখেছিলেন। প্রায় ৪০ কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে সেদিন রামগড়ে পৌঁছন ছত্রধর।
কেমন ছিল সেই বাইক সফর? ইউএপিএ মামলায় জামিনে থাকা ছত্রধর বলছেন, “পুরো রাস্তা আমার মোটর সাইকেলে যাননি মমতা। যে সব জায়গায় রাস্তা কেটে দেওয়া হয়েছিল (বাবিনীকে রুখতে জনগণের কমিটিই এইসব রাস্তা কেটেছিল তখন), ত্রাতা হিসাবে শুধু সেই জায়গাগুলোই মমতাকে পার করে দিয়েছিলাম আমি।” তিনি জানাচ্ছেন, গভীর অরণ্যের ভিতর যতই ঢুকেছেন, ততই আরও বিপদসঙ্কুল হয়েছে রাস্তা। সে সময় চালক হিসাবে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিলেন বলেও জানান ছত্রধর। তাঁর কথায়, “যে এলাকা দিয়ে মমতাকে নিয়ে গিয়েছি, সেখানকার প্রত্যেক মানুষ আমার সঙ্গে ছিলেন।” সেই মুহূর্তগুলোই আত্মবিশ্বাসী ছত্রধরকে আপ্লুত করে দিয়েছিল, অকপট জানাচ্ছেন তিনি। ঝাপসা চোখে তিনি বলে চলেছেন, “আর স্বপ্নের নায়িকা যদি আমার বাইকে চাপেন, স্বাভাবিকভাবেই অনুভূতি অন্যরকম হবে। ছাত্রাবস্থা থেকেই আমি মমতার ফ্যান। তাঁকে দেখেই রাজনীতিতে আসা। তিনি যদি আমার কাছাকাছি আসেন এবং তাঁকে ছুঁতে পারি, এ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না…”
আরও পড়ুন- কিষেণজী হত্যা তৃণমূল সরকারের ভুল ছিল: ছত্রধর
জীবন গিয়েছে চলে বারো-বারো বছরের পার। সেদিনের যে বিরোধী নেত্রী লালগড়ে প্রতিবাদীদের মাঝে গিয়েছিলেন বলে প্রতিরোধ আন্দোলন বিশেষ মাত্রা পেয়েছিল, তিনি বিগত দশ বছর রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান। বদল যে শুধু মমতার হয়েছে, তাই না। একদা জনসাধারণের কমিটির সেই রুক্ষ নেতাও দীর্ঘ কারা জীবন কাটিয়ে, কিষানজির হত্যার জন্য মমতাকেই দায়ী করে সময়ের স্রোতে ভেসে এখন তৃণমূলেরই সাধারণ সম্পাদক। বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। তবে যেটা বদলায়নি তা হল মুহূর্তের ক্ষমতা। আজ বাইক সওয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর ছবি লহমায় লালগড়ের সেই আগুনে সময়ে নিয়ে গেয়ে ফেলল ছত্রধরকে।