কিষেণজী হত্যা তৃণমূল সরকারের ভুল ছিল: ছত্রধর

আমার সন্তানরা হোস্টেলে ছিল। বেশি দিন থাকতে পারল না। হার্মাদরা সেই হোস্টেল দখল করে ক্যাম্প তৈরি করল। শিক্ষকরাও বললেন, ছত্রধরের ছেলে, এখানে রাখা রিস্ক হয়ে যাবে। বড়টা তখন মাধ্যমিক দেবে।

কিষেণজী হত্যা তৃণমূল সরকারের ভুল ছিল: ছত্রধর
অলঙ্করণ: অভিক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: Dec 08, 2020 | 10:04 PM

এক দশক পর এখন বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছেন আমলিয়া গ্রামের বাতাসে। এই বাতাস এক সময় গুমট হয়ে থাকত মাও-আতঙ্কে। ভেসে বেড়াত আধা সেনার ভারী বুটের আওয়াজ। প্রতিধ্বনিত হত জনজাতির চাপা কান্না। সেই বাতাস এক দশক পর এখন অনেকটাই ফুরফুরে। ডিসেম্বরের শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাসে ঝড়ে পড়া পাতায় মর্মরিত হচ্ছে জঙ্গলমহলের সেই হাড়হিম করা গল্প। দাওয়ায় বসে সে সবেরই স্মৃতিচারণা করলেন একদা লালগড় আন্দোলনের ‘পোস্টার বয়’ ছত্রধর মাহাতো। ‘মাওবাদী’ তকমা থেকে অধুনা তৃণমূলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। একুশের ভোটের আগে রাজনৈতিক জমি ফিরে পাওয়া থেকে এনআইএ প্রসঙ্গ- সবকিছু নিয়ে TV9 বাংলা ডিজিটালের মুখোমুখি ছত্রধর মাহাতো।

(সবেমাত্র মাঠ থেকে ফিরেছেন। প্রশস্ত কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঘন ঘন প্রশ্বাস পড়ছে পৌঢ় ছত্রধরের। চলনে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। সেই সোনালি ফ্রেমের ট্রেডমার্ক চশমাটি নেই। সাংবাদিককে দু’একবার সময় দিয়েও ‘খেলাপ’ হয়ে যাওয়ায় কিছুটা কুণ্ঠিত তিনি। সহাস্যে ক্ষমাও চেয়ে নিলেন। কথা শুরু হতেই আবহ সুর হিসাবে অবিরাম ডেকে চলল একটি মোরগ।)

শরীর কেমন আছে আগে বলুন। সদ্য করোনা জয় করেছেন তো…

(তখনও হাঁপাচ্ছেন। একটু থেমে বললেন) ভাল আছি। প্রায় দু’মাস হয়ে গেল করোনা থেকে সুস্থ হয়েছি। এখনও একটা দুর্বল ভাব রয়েছে।

দেখছি, ওজন বেড়ে গিয়েছে, সেই ছিপছিপে ছত্রধর আর নেই!

(একটু হাসলেন) জেল থেকে বেরনোর সময় ওজন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। বদ্ধ জায়গায় ছিলাম তো। তবে, ফের পরিশ্রম করছি। ৬-৭ কিলো ওজন কমেছে।

ভোটের আগে জঙ্গলমহলে তৃণমূলের গুরু দায়িত্ব পাওয়া ছত্রধরের রোজকার রুটিন এখন কী?

এই ধরুন, সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি। ফ্রেশ-টেশ হয়ে চাষের কাজে চলে যাই। ন’টা-সাড়ে ন’টা অবধি ব্যস্ত থাকি জমিতে। এরপর ১০টা থেকে একটা পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য সময় দিই। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন আসেন। আবার বিকেল ৪টে থেকে রাত্রি ৮টা পর্যন্ত ওদের জন্য বসি। এটাই এখন ডেইলি রুটিন হয়ে গিয়েছে। খুব একটা বাইরে বেরচ্ছি না।

কী মনে হয়, করোনার হাত থেকে তো নিস্তার পেলেন, কিন্তু এনআইএ (NIA)?

(প্রশ্ন শেষ না হতেই হেসে ওঠেন ছত্রধর) বলতে তো দ্বিধা নেই। এটা পরিষ্কার। দশ বছর আগে যে ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছিল, আবার নতুন নতুন ধারা চাপানো হচ্ছে। দেখুন, আমি আইনের ছাত্র নই। অভিজ্ঞতায় যতটুকু বুঝেছি, এনআইয়ের যখন জন্ম হয়নি, সে সময়ের কেসের ভার নিচ্ছে তারা। এখানে বিজেপির পরিষ্কার হাত রয়েছে। (কিছুটা উত্তেজিত হয়ে) শুনুন, পঞ্চায়েত ও লোকসভায় বিজেপি যে রেজাল্ট করেছিল, যে ভাবে প্রচারে বাজিমাত করেছিল, সেটা সৎ পথে নয়। সাদাসিধে আদাবাসী জনজাতিকে সহজে প্রলোভন দেখিয়ে, বিভিন্নভাবে নিজেদের দিকে নিয়ে আসে। এখানে দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদ লাগানোর চেষ্টা করেছে। সাঁওতাল ও কুড়মিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে লোকসভায় বাজিমাত করে বিজেপি। আমি আসার পর তাদের রাজনৈতিক মাটি পায়ের তলা থেকে সরে গিয়েছে। বিজেপিতে যারা চলে গিয়েছিল, তারা কাতারে কাতারে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছে। জঙ্গলমহলে তিনটি জেলায় প্রচারে গিয়েছি। প্রচুর মানুষের ভিড় চোখে পড়েছে। সেই ভিড় থেকে পরিষ্কার, বিজেপির সাংগঠনিক পরিকাঠামো দুর্বল হয়ে গিয়েছে। জেনে রাখবেন, লোকসভায় বিজেপিকে যারা ভোট দিয়েছিল, তারা কোনও ভাবধারায় বিশ্বাস করে বিজেপিতে যায়নি। বিজেপি এমন একটি দল, যারা জনজাতির পক্ষে দাঁড়াবে না। এটা তারাও জানে।

তাহলে মানুষ বিজেপি-তে গেল কেন বা উল্টে বললে তৃণমূলের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল কেন?

মানুষ বিমুখ হয়েছে, তবে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যায়নি। আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ জমেছিল। স্থানীয় স্তরে দুর্নীতি করেছে তারা। আদিবাসীদের সেভাবে সম্মান দেয়নি। এটাই বিরাগভাজন হওয়ার কারণ। তৃণমূলের প্রতি ঘৃণা ছিল না কিন্তু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভে বিজেপিতে চলে গিয়েছিল মানুষ।

কী করে বুঝলেন ক্ষোভে বিজেপিতে চলে গিয়েছে মানুষ?

ফেব্রুয়ারি পর থেকে আমি রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ নিয়ে গিয়ে প্রচুর মানুষের সাড়া পেয়েছি। বিজেপির দখলে থাকা পঞ্চায়েতে গিয়েও দেখেছি, প্রচুর মানুষ তৃণমূলে যোগদান করেছেন। বিজেপি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে, জঙ্গলমহলের মাটি আর তাদের পায়ের তলায় নেই।

তার মানে, ছত্রধরকে দলীয় দায়িত্ব দেওয়াটাই কি তৃণমূলের মাস্টারস্ট্রোক?

জঙ্গলমহলে এসেই দেখুন না। এখানে বিজেপির বক্তব্য তৃণমূল পার্টির বিরুদ্ধে নয়, আমার বিরুদ্ধে। আমাকে টার্গেট করাই বিজেপির এখন আসল কাজ। অনেক জাতীয় নেতা এসেছেন এখানে। মুকুল রায় তো এখন জাতীয় নেতা। মুকুল রায়, কৈলাস বিজয়বর্গীয়র বক্তব্য টেপে শুনেছি। ছত্রধরই একমাত্র টার্গেট ওদের। ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছে।

‘টার্গেট’, ‘ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছে’ এসবের মানে কী? আপনি কি কোনও আশঙ্কা করছেন?

আশঙ্কা তো হচ্ছে। তবে, আইন ও বিচার ব্যবস্থার উপর আমার আস্থা রয়েছে। আমাকে তারা এত সহজে গ্রেফতার হতে দেবে না। দেখুন, এতদিনের একটা পুরনো কেসকে সামনে নিয়ে এসে তদন্ত করছে। যে কোনও মানুষের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারে। যে সব ধারা দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করছে, এর কি যুক্তি আছে? দশ বছর জেলে ছিলাম। তখন কি ওরা ঘুমাচ্ছিল? তখন তদন্তে আসল না, এখনই হঠাৎ উদয় হল! রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা না করতে পারায়, এনআইএ দিয়ে চাপে রাখার চেষ্টা করছে বিজেপি।

এক দশক বন্দিদশায় ‘লালগড় আন্দোলনের পোস্টার বয়ের’ জীবন কতটা বদলালো?

(গলাটা খাদে নেমে আসে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললেন) যখন আমি জেলে আসি আমার বয়স ৪৭। যখন বেরচ্ছি তখন ৫৭। এই দশটা বছর আমার মূল্যবান সময়। আমার দুই ছেলের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার সময়। তা আমি গড়ে দিতে পারিনি। পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত তারা। আমার দুর্ভাগ্য সেটুকু সুযোগ করে দিতে পারিনি।

নিজেকে অপরাধী মনে হয়?

হ্যাঁ, অপরাধী লাগে। সন্তানদের স্বপ্ন-সখ কোনওটাই পূরণ করতে পারিনি। আমার বাবা-মার ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমার বাবা যদি আজ বেঁচে থাকতেন, ভীষণ আনন্দিত হতেন। এত দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। হার্মাদ বাহিনীর অত্যাচারে কত দিন তিনি ঘরছাড়া। আপনি শুনলে অবাক হবেন, ওই সময় আমার বাবা রোজ হামার্দদের রান্না করে দিত।

কিন্তু আপনার দুই ছেলে তো রাজ্য সরকারের দেওয়া চাকরি করছেন। স্ত্রী, নিয়তী দেবী রাজ্য সমাজ কল্যাণ দফতরে নিযুক্ত। আপনার পাকা বাড়ি। বাড়ির সামনে পিচের রাস্তা। ছত্রধরের সহযোদ্ধারা মোটেই এতকিছু পাননি। তাঁদের অভিযোগ, আপনি শাসক ঘনিষ্ঠ বলেই এত সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন। কী বলবেন?

এটা সমালোচকরা বলতেই পারেন। আমরা যে সুবিধা পেয়েছি, অস্বীকার করছি না। এটাও ঠিক আমি কারও কাছে চাইতে যাইনি। আমার ছেলেকে চাকরি দিতে হবে, তবেই রাজনীতি করব, এ কথা কোনও দিনই বলিনি। আমি মনে করি, তাদের মৌলিক অধিকার রয়েছে চাকরি পাওয়ার। আর বাড়ি করা নিয়ে যদি বলেন, আমার দুই ছেলে কাজ পেয়েছে, তারা কিছু লোনের ব্যবস্থা করেছে। আমার স্ত্রী যে গোষ্ঠীতে কাজ করে, সেখান থেকে ৫-৭ লক্ষ টাকা লোন পেয়েছে। সেই লোনে আমরা বাড়ি করি, প্রত্যেকে এরকম বাড়ি করতে পারে। এটা তো ভেতরের কথা। এ তো সবাই জানবে না, কীভাবে বাড়িটা করল, তাই বোধ হয় প্রশ্ন জাগে।

চাকরি পাওয়ার অধিকার নিশ্চই আপনার স্ত্রী-সন্তানদের রয়েছে। কিন্তু, সেই অধিকার তো অন্যান্যদেরও রয়েছে। তাঁদের অধিকার কি রক্ষিত হচ্ছে?

এগুলো সমালোচনার জায়গা নয়। তবে এটা ঠিক আমার মতো জঙ্গলমহলের অনেক মানুষ বিভিন্ন কেসে জড়িয়ে রয়েছে। কারও কারও চাকরি হয়নি। যাদের চাকরি হয়নি অথচ মামলা চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের জন্য আমি ব্যথিত। একটাই কথা বলব, আমরা সবাই একত্রিত হয়ে রাজ্য সরকারের কাছে দাবি রাখতে পারি। আমার মনে হয়, এর একটা সুফল পাব। আমরা তো চাকরি চাইছি না। বাম ফ্রন্ট সরকারের সময় দিদি বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে সবার কেস তুলে নেওয়া হবে। রাজ্য সরকারের কাছে শুধুমাত্র মামলা তুলে নেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। এরপর যদি পুনর্বাসন দেওয়া যায়, তাহলে আরও ভাল। তাদের পাশে থেকে সব সময় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।

আচ্ছা, একটু আগে বলছিলেন যে আপনার বাবা হার্মাদদের জন্য রান্না করতেন। ব্যাপারটা ঠিক কী?

যৌথ বাহিনী জঙ্গলমহলে ঢুকে জনসাধারণের কমিটির সমস্ত সংগঠন ভেঙে দিয়ে এলাকা দখল করেছিল। তখন প্রত্যেকটা গ্রামে ক্যাম্প তৈরি করেছে হার্মাদ বাহিনী। অর্থাৎ সিপিএম-এর সামরিক বাহিনী। ২০-২৫ জন এক একটা বাহিনীতে থাকত। বন্দুক নিয়ে ওই সব এলাকায় ডমিনেট করত ওরা। আমার গ্রামের লোকেরা পাশের গ্রামে যেত হার্মাদ বাহিনীর জন্য রান্নাবান্না করে দিতে। এমন অবস্থাতেও দিন কেটেছে আমাদের।

আমার সন্তানরা হোস্টেলে ছিল। বেশি দিন থাকতে পারল না। হার্মাদরা সেই হোস্টেল দখল করে ক্যাম্প তৈরি করল। শিক্ষকরাও বললেন, ছত্রধরের ছেলে, এখানে রাখা রিস্ক হয়ে যাবে। বড়টা তখন মাধ্যমিক দেবে। মেদিনীপুর শহরে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু সেখানেও যখন জানল, তারা ছত্রধরের ছেলে, বাড়িওয়ালা বলে দিল, তাদের থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। যাই হোক বিগত দিনের কথা বললে অনেক সমস্যা চলে আসবে…

 দীর্ঘ জেল জীবনে এমন কোনও স্মৃতি আছে যা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আপনাকে?

আট-নয় সালে (২০০৮-২০০৯) যাঁরা আমার সহকর্মী ছিল, তাঁদের অন্যতম লালমোহন টুডু। তাঁকে এনকাউন্টার করে মেরে দিল ওরা..এই ঘটনা এখনও ভাবায় আমাকে। সত্যি কথা বলতে, লালমোহন টুডু এমন একজন ব্যক্তি, যিনি সমাজের জন্যই ভাবতেন। নিজের জন্য কোনওদিনই ভাবেননি। আজ যদি তিনি থাকতেন, এই সমাজকে তাঁর চোখ দিয়ে কীভাবে দেখতেন, তা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে…

কোন ঘটনা আপনাকে সব থেকে নাড়া দিয়ে গিয়েছে?

(কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর বললেন) সবচেয়ে বড় দুঃখ পেয়েছি, যখন আমার ভাই (শশধর মাহাতো) আমার কাছ থেকে চলে যায়। ও গড়বেতাতে লেখাপড়া করেছিল। পাশের গ্রামের হাইস্কুলে ডেপুটেশনে একটি ভ্যাকেন্সি হয়। সে সময় স্কুল কমিশন ছিল না। ম্যানেজিং কমিটি বিজ্ঞাপন দিত। সেই ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া হতো তখন। আমার ভাই চাকরির আবেদন করে।

সালটা কত?

(একটু ভেবে) ওই নব্বই-বিরানব্বই হবে। চাকরি পেতে গেলে ডোনেট করতে হতো ৬ হাজার টাকা। জায়গা জমি বিক্রি করে ৫ হাজার টাকা মতো ডোনেট করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার ভাই সুযোগ পেল না। টাকাটাও মার গেল। তা দেখে ভাই রাগে-ক্ষোভে আমার সামনে তার সব সার্টিফিকেট জ্বালিয়ে দেয়। তারপর সেই যে বেরল আর ফিরে আসেনি। এটা আমাকে আজও ভাবায়।

 শশধরের মাওবাদী কার্যকলাপের জন্য ২০০২ সালে আপনকে জেরা করা হয়েছিল?

হ্যাঁ। তখন একবার অ্যারেস্টও হয়েছিলাম। আমি ও আমার ভাই ৩ মাস জেলে ছিলাম।

ভাইয়ের মৃত্যুর খবর কীভাবে পেলেন?

সালটা ২০১০। মৃত্যুর খবর পেলাম রেডিয়োতে। তৎকালীন পুলিস সুপারকে অনুরোধ করি আমার ভাইকে দেখতে দেওয়ার জন্য। উনি খুব সহযোগিতা করেছিলেন। ঝাড়গ্রাম মর্গে গিয়ে তাকে সেই শেষ দেখা দেখি। যতটুকু শুনেছি ও গ্রামে ঢুকতেই কিছু লোক পুলিসে খবর দেয়। ওকে ধরে তৎক্ষণাৎ মেরে দেওয়া হয় (গলা ধরে আসে ছত্রধরের)

কিষেণজীর মৃত্যুকে আপনি কীভাবে দেখেন?

কোনও মৃত্যুই বাঞ্ছনীয় নয়। কোনও ব্যক্তি বা নেতাকে মেরে তার রাজনীতি শেষ করে দেওয়া যায় না। আমি মনে করি, সেই রাজনীতি শেষ করতে হলে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। গুলি, বন্দুক দিয়ে আমার বিপক্ষে যিনি আছেন, তাঁকে মেরে ফেলব! এতে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় না।

কিষেণজীর মত্যুর জন্য একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করেছিলেন আপনি। আজ কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

একইভাবে বলব। শুনুন, সাদাকে সাদা বলতে হয়, কালোকে কালো। আমার চোখে যেটাকে সাদা মনে করি, সেটাকে সাদাই বলবো। (অত্যন্ত প্রত্যয়ের সুরে) হ্যাঁ, এটা ভুল ছিল। আমি মনে করি এটা ভুল ছিল। এনকাউন্টার করে মানুষকে মেরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পরিস্থিতি বরং আরও অশান্তই হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আমার হাতে, তা দিয়ে জনগণকে আমার পায়ের তলায় নিয়ে আসব, এটা কখনও সম্ভব নয়। কেউ পারে না। (একটু থেমে) ইতিহাস তো তাই বলে।

আচ্ছা, কিষেণজীই কি আপনাকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়াতে বলেছিলেন?

না না। আমার নিজেরই জঙ্গলমহলে যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ওটা মিথ্যে প্রচার। বরং কিষেণজী তো ভোটের বিরোধিতা করেছিল। জনসাধারণের কমিটির মুখপাত্র জয়দেব মাহাতো লিফলেট ছাপিয়ে প্রচার করে, ছত্রধর মাহাতোকে ভোট দেবেন না।

তার মানে, কিষেণজী চাইনি যে আপনি মমতার বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ান…

হ্যাঁ, কিষেণজী চায়নি।

এখন মমতার আস্থাভাজন নেতা হিসাবে কি ২০১১ সালে তৃণমূলভোটে দাঁড়ানোর পর্বটা নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেন?

ভোটে দাঁড়ানোর একটাই উদ্দেশ্য ছিল। আমাকে যেভাবে মাওবাদী তকমা দেওয়া হয়, তার প্রতিবাদ করতেই ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম। আমি কারও বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। আমি জানি, জেলের ভিতর থেকে জেতা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাকে রাষ্ট্র মাওবাদী সাজাতে চায়, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্যই আদালতের কাছে ভোটে দাঁড়ানোর অনুমতি চেয়েছিলাম। আদালতও সেই অনুমতি দেয়।

বিজেপি তো এখনও বলছে, ছত্রধর ছিল ‘মাওবাদী মুখ’। তৃণমূলে যোগদান করে ‘তৃণমূলের মাওবাদী মুখ’ হয়ে গিয়েছেন। কী বলবেন?

বিগত দিনের কথা চিন্তা করুন, ছয়-সাত সালে বিভিন্ন এলাকায় বামফ্রন্ট সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে মানুষ। ভূমি রক্ষা কমিটিই হোক বা তৃণমূল ব্যানারেই হোক, প্রত্যেককে দমন করার পথেই হেঁটেছে প্রশাসন। কাউকে মাওবাদী, কাউকে জনযুদ্ধ ইত্যাদি নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যখন রাজনৈতিকভাবে পারেনি, তখনই এই তকমা দিয়েছে।

আপনি দেখুন গড়বেতা আন্দোলন, কেশপুর, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, লালগড়- প্রত্যেক জায়গায় কীভাবে মানুষের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। যখন সে অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি, তখনই তারা একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সেই প্রতিরোধের বিরুদ্ধে সরকার যখন দমন পীড়ন চালিয়েছে, তখনই সন্ত্রাসের ছাপ্পা লাগিয়েছে। না হলে যে দমন করতে পারে না।

ঠিক তেমনই আজকের বিজেপিও। লোকসভায় যে আসন পেয়েছিল তা দেখে বিজেপি এখন দিবাস্বপ্ন দেখছে, রাজ্য তাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু জঙ্গলমহলে মিটিং- মিছিলে করে বুঝেছে পুরোটাই উল্টো! অর্থাৎ তারা মানুষকে ধরে রাখতে পারছে না। তৃণমূলের ছত্রছায়ায় যাচ্ছে। তখন বিজেপি সেই সন্ত্রাসের ধ্বজাটা সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

উত্তর প্রদেশের সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার চলছে, নাবালিকাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, সে সব কথা না বলে জঙ্গলমহলে ছত্রধর নামক এক মানুষ এসেছে, সে মাওবাদী প্রচার করছে, সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি অভিযোগ। জঙ্গলমহলে ফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জাহির করে এখানকার মানুষের উপর অত্যাচার করছে। যেমন ২০০৮-৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার করেছিল।

জঙ্গলমহলে কি এখন মাওবাদীদের উপস্থিতি আছে?

মাওবাদী আছে কিনা সবাই দেখছে। দেখুন, কোনও রাজনীতিই একেবারে শেষ করা যায় না। তা যে কোনও রূপেই হোক থাকে। জঙ্গলমহলের সঙ্গে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার বর্ডার রয়েছে। ঝাড়খণ্ডে একটু আধটু মাওবাদী তো আছে। তবে পশ্চিমবঙ্গে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। বিভিন্নভাবে বঞ্চিত, নীপিড়িতরা যে বিক্ষোভ দেখাবে, সে অবস্থা আজ আর নেই। কারণ, তাঁরা বস্ত্র পেয়েছে, অন্ন পেয়েছে, শিক্ষা পেয়েছে, স্বাস্থ্য পেয়েছে। তাই বিক্ষোভও নেই। বিরোধী রাজনীতির অস্তিত্বও নেই।

বাংলায় আজও মাওবাদীরা থেকে থাকলে সংসদীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছত্রধর তাঁদের উদ্দেশে কী বার্তা দেবেন?

জঙ্গলমহলে তাঁদের প্রাসঙ্গিকতা নেই। তবু যদি এখনও কেউ থেকে থাকেন, মূলস্রোতে আসুক। এই উন্নয়নে শামিল হোক। জনগণের সেবায় ব্রতী হোক।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে বিজেপির জয় এবং ভোট বাড়িয়ে নিতে পেরেছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। অন্য দিকে তৃণমূলের ভোট কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। এটা কীভাবে সম্ভব হল?

আপনারা ভালভাবে জানেন, জঙ্গলমহলে একটা জাতিসত্ত্বা কাজ করে। দুটো বড় সম্প্রদায় আছে। সাঁওতাল ও কুড়মি আদাবাসী। আমি কুড়মি আদিবাসীর অন্তর্গত। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপি বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। সেই জায়গা থেকে ওরা ফায়দা তোলে। কুড়মি সম্প্রদায় পুরোপুরি বিজেপির দিকে চলে যায়। ৩২-৩৪ শতাংশ ভোট সরাসরি বিজেপির দিকে চলে যায়।

আর একটা কারণ আগেই বলেছি, জঙ্গলমহলের অধিকাংশ মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ছিল না। কিছু নেতৃত্বের ঔদ্ধত্যও কাজ করেছে। তারা বলেছে, সাড়ে ৩ লক্ষ ভোটের লিড আছি, দু’লক্ষ যাবে তাতে কী আছে। এই যে মনোভাব। বড়বড় মিছিল করেছে, কিন্তু মানুষের কাছে যায়নি।

সেই কারণেই কি উদ্ধত নেতাদের ছেড়ে কুড়মি ছত্রধরকেই ঝাড়গ্রাম পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

(প্রশ্ন শুনেই ‘কৌশলী’ ছত্রধর বাধা দিয়ে বলেন) না না শুধু আমাকে নয়, এটা সংগঠনের ব্যাপার। সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। আমার বিশ্বাস, আমার আস্থা আছে অবশ্যই জঙ্গলমহল পুনরুদ্ধার হবে। আমি প্রমাণ করে দিতে পারি। এই ক’দিনে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছি, জঙ্গলমহল থেকে বিজেপির পাততাড়ি গোটানোর সময় এসে গিয়েছে। মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

mamata

আপনার তিনটে অভিজ্ঞতা জানতে চাইব। তিন সময়ের তিন অভিজ্ঞতা-

প্রথম, ২০০৯, ৪ ফেব্রুয়ারি: আপনার বাইকে চড়ে লালগড়ে খাসজঙ্গলে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় বললেন, “ছত্রধর আমাদের দলের কর্মী। ওঁর আন্দোলনের প্রতি সমর্থন রয়েছে।” কেমন লেগেছিল সে সময়?

সে সময়ে তিনি বিরোধী নেত্রী। গণ আন্দোলনের মুখ। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম গণআন্দোলনের নেত্রী। এত বড় মাপের নেত্রী আমার আন্দোলনকে সমর্থন করছে, স্বাভাবিকভাবেই আমি আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার আন্দোলন সার্থকতা পেয়েছিল।

 দ্বিতীয়, ২০১৫, ১২ মে: রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় ছত্রধরের যাবজ্জীবন। ঘটনাক্রমে সে দিনই ঝাড়গ্রামে উপস্থিত মমতা। কিন্তু চুপ ছিলেন তিনি। কেমন লেগেছিল সে সময়? আপনাকে একটু ধরিয়ে দিই, আপনি মুখ খুলেছিলেন এবং বলেছিলেন, “জঙ্গলমহলের মানুষ এর জবাব দেবে।”

আমার মনে হয়, আদালতের বিষয় বলেই উনি সংযমী ছিলেন। কোনও উত্তর দেননি। যেহেতু তাঁকে প্রশাসন চালাতে হয়। সর্বোচ্চ জায়গায় বসে থাকলেই, সব কিছু তাঁর উপর নির্ভর করে না। অনেক আমলা রয়েছে, ক্ষমতা বলে প্রভাবিত করার চেষ্ট করে ওঁরা। সেটাই হয়েছে। আমার মনে আছে, পশ্চিম মেদিনীপুরে অনেক আমলা আমার বিরুদ্ধে ছিল। তাঁরা চেয়েছিলেন আমি যেন না বেরতে পারি। আজকে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন কোর্টকে প্রভাবিত করেছিল। এটাও ঠিক, একটা জেলা কোর্ট আমলাদের উপর নির্ভরশীল। আপনি মানবেন কি মানেবন না, আমার অভিজ্ঞতা বলছে, জেলা আদালত জেলার আমলাদের দ্বারা অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়।

তৃতীয়, ২০১৯, ১৪ অগস্ট: হাইকোর্ট আপনার যাবজ্জীবনের সাজা কমিয়ে দশ বছর করে। সে সময় সংবাদ মাধ্যমে আপনি বলেছিলেন, একুশে মমতাকেই মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চান। আর এখন সেই মমতার দলের সাধারণ সম্পাদক। অভিজ্ঞতা কেমন?

এটা শুধু আমি চাইছি না, পশ্চিমবঙ্গের জনগণ চাইছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর দ্বিতীয় নাম আসবে না। বর্তমানে ওনার বিকল্পও নেই।

ডেপুটি স্পিকার সুকুমার হাঁসদার মৃত্যুর পর ঝাড়গ্রাম বিধানসভার পদ আপাতত ফাঁকা। প্রার্থী নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে তৃণমূলের মধ্যে। একদা জেলার ভারপ্রাপ্ত নেতা শুভেন্দু অধিকারীও অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তাহলে আগামী নির্বাচনে ছাতা ধরবে কি ছত্রধর?

এটা এখনই বলা যাবে না। সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ঠিক করবে। আমার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে না।

 আপনি কি ভোটে দাঁড়াতে আগ্রহী?

নিশ্চয়ই, আমাকে দায়িত্ব দিলে আমি মাথা পেতে নেবে…