‘একটু সাহায্য করবেন’, হাসপাতাল করতে বিয়েবাড়ির সামনেও ভিক্ষা করেছেন R G Kar

Dr. R G Kar and his hospital: এক জঘন্য ঘটনার জন্য, দেশ-বিদেশের মানুষের চোখ এখন আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের দিকে। অথচ, অনেকেই ভুলে গিয়েছেন কে এই আরজি কর। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য কিন্তু তিনি বহু ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, করতে হয়েছিল বহু সংগ্রাম।

'একটু সাহায্য করবেন', হাসপাতাল করতে বিয়েবাড়ির সামনেও ভিক্ষা করেছেন R G Kar
বহু কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল তৈরি করেছিলেন ডা. রাধাগোবন্দ করImage Credit source: আরজি কর এক্স স্টুডেন্ট ডট কম
Follow Us:
| Updated on: Aug 13, 2024 | 6:21 PM

কলকাতা: সালটা ১৯০৪ কিংবা ১৯০৫। এক বড়লোক বিয়েবাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন দুই ব্যক্তি। বিয়েবাড়ি থেকে অতিথিরা বের হলেই তাঁরা ভিক্ষা চাইছেন, “একটু সাহায্য করবেন, একটা হাসপাতাল বানাব”। দেখলে ভিখারি মনে হয় না। পোশাক-আশাক ভদ্রলোকের মতো। কেউ কেউ ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিচ্ছেন অবজ্ঞায়। আবার কেউ কেউ চিনতে পেরে বলছেন, “একি ডাক্তারবাবু আপনি!” হ্যাঁ, ওই দুই ব্যক্তির একজন ছিলেন বিলেত ফেরত চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর বা আরজি কর। আর অপরজন তাঁরই বন্ধু, ডাক্তার শৈলেন গুপ্ত। এভাবেই ইংরেজদের তৈরি হাসপাতালের বাইরে, কলকাতায় একটা দেশি হাসপাতাল তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। তৈরি হয়েছিল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। এক জঘন্য ঘটনার জন্য, দেশ-বিদেশের মানুষের চোখ এখন যে হাসপাতালে। অথচ, এই হাসপাতাল তৈরির পিছনে ছিল এর প্রাণপুরুষ ডা.আরজি কর এবং আরও বেশ কয়েকজন কৃতী মানুষের অদম্য জেদ ও অনেক অনেক ত্যাগ।

হাওড়া জেলার রামরাজাতলা স্টেশন থেকে মিনিট পনেরো হাঁটাপথ দূরেই অবস্থিত বেতড়ের বিখ্যাত কর বাড়ি। ১৮৫০ সালের ২৩ অগস্ট এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছিল রাধাগোবিন্দ করের। বাবা দুর্গাদাস করও ছিলেন এক কৃতী পুরুষ, জড়িয়েছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গেই। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ভার্নাকুলার বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা ভাষায় চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছু বইও রচনা করেছিলেন। সেই সঙ্গে, ঢাকায় মিডফোর্ড হাসপাতাল নামে এক হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাও করেছিলেন তিনি। প্রথমে কলকাতার হেয়ার স্কুল, তারপর হিন্দু স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন রাধাগোবিন্দ। তারপর, তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে যেন চিকিৎসক হয়। প্রায় জোর করেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসান রাধাগোবিন্দকে। পাশ করে ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিলেন তিনি। বাবা দুর্গাদাস তাঁর সুবিধার জন্য শ্যামবাজারে একটি নতুন বাড়িও তৈরি করেছিলেন।

আরজি করের পুরোনো কলেজ ভবন

তবে, উত্তর কলকাতায় তখন থিয়েটারের রমরমা। আর কর বাড়ির সঙ্গে থিয়েটারেরও ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। প্রখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন বাবা দুর্গাদাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর লেখা থিয়েটারে মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতেন রাধাগোবিন্দ করের দাদা, রাধামাধব। ডাক্তারি পড়তে ঢুকে তাই রাধাগোবিন্দর মাথাতেও থিয়েটারের ভূত চেপেছিল। থিয়েটারের নেশায় ডাক্তারি পড়া উঠেছিল মাথায়। এর মধ্যে বিয়েও করেছিলেন তিনি। স্ত্রী মারাও যান। এরপর প্রায় এক দশক পর তিনি আবার ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিলেন এবং তিন বছর পর ডাক্তারি পাশ করে পাড়ি দেন স্কটল্যান্ডে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডাক্তারি ডিপ্লোমা করে, ১৮৮৬ সালে ফিরে এসেছিলেন দেশে। নেমে পড়েছিলেন আর্তের সেবায়।

তবে, নিজে ডাক্তারি পড়ার সময়ই ডা. আরজি কর অনুভব করেছিলেন মাতৃভাষায় চিকিৎসা শিক্ষার প্রয়োজন। উনিশ শতকে ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থেই দেশিয় চিকিৎসক বাহিনী তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু, প্রধান বাধা ছিল ভাষা। হিন্দু কলেজ থেকে পাশ করা হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রই ইংরেজি জানত। ডা. আরজি কর দেখতেন, তাঁর সহপাঠীরা ইংরেজি ভাষার জন্য ডাক্তারি পড়তে সমস্যায় পড়ছে। তাই ডাক্তারি পাশ করার আগে থেকেই, বাবা দূর্গাদাসের মতো বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই লেখা শুরু করেছিলেন আরজি কর। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম বই ‘ভিষগবন্ধু’। এছাড়া, ‘সংক্ষিপ্ত শারীরতত্ত্ব’, ‘রোগী পরিচর্য্যা’, ‘ভিষক সুহৃদ’, ‘প্লেগ’, ‘স্ত্রীরোগের চিত্রাবলী ও সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব’-র মতো আরও অনেক বাংলায় চিকিৎসাশাস্ত্রর বই লিখেছিলেন তিনি। তবে, বিলেত থেকে ফিরে তিনি বুঝেছিলেন শুধু বাংলায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইই যথেষ্ট নয়। দেশিয় মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজের প্রয়োজন। বীজ বোনা শুরু হয়েছিল আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের।

ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের আবক্ষ মূর্তি

১৬১ নম্বর পুরনো বৈঠকখানা বাজারের এক বাড়িতে, কলকাতার সেই সময়ের সেরা বাঙালি চিকিৎসকদের ডেকেছিলেন ডা. আরজি কর। মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, বিপিন মিত্র, কুমুদ ভট্টাচার্যদের মতো চিকিৎসকদের নিয়ে তিনি এক সমিতি স্থাপন করেছিলেন। এই সমিতিতেই এশিয়ার প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল তৈরির প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৮৮৬ সালে শুরু হয় ‘ক্যালকাটা স্কুল অব মেডিসিন’-এর পথ চলা। প্রথমে দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হত। পরের বছর থেকে শুরু হয় অ্যালোপ্যাথি বিভাগ। স্কুলের নাম বদলে হয় ‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল’। পরে এই স্কুলবাড়ি বৈঠকখানা বাজার থেকে উঠে যায় বৌবাজার স্ট্রিটে। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ সরকার সেই স্কুলে শব ব্যবচ্ছেদের অনুমতি দিয়েছিল। এই মেডিক্যাল স্কুলে সমস্ত বিভাগেই পড়ানো হত বাংলায় লেখা বই। রাধাগোবিন্দ করের লেখা বইগুলির পাশাপাশি, মধুসূদন গুপ্তের লেখা বইও ছিল পাঠ্যক্রমে।

এরপর, আবার ঠিকানা বদলে ২৯৮, আপার সার্কুলার রোডে চলে গিয়েছিল স্কুলবাড়ি। মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ১৪ শয্যার এক হাসপাতাল। এরপর, বেলগাছিয়ায় ১২ বিঘে জমি কিনেছিল ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল। প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টরের ভারত ভ্রমণের তহবিল থেকে আঠারো হাজার টাকা সাহায্য পেয়েছিল তারা। সেই প্রথম তৈরি হয়েছিল মেডিক্যাল স্কুলের নিজস্ব বাড়ি। ১৮৯৯ সালে সেই স্কুল সংলগ্ন হাসপাতাল তৈরি হয়। সেই হাসপাতালের উদ্বোধন করেছিলেন সেই সময়ের বাংলার গভর্নর, জন উডবার্ন। প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টরের নামানুসারে হাসপাতালের নাম রাখা হয় ‘অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল’।

অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল

রাধাগোবিন্দ কর এই বেসরকারি মেডিক্যাল স্কুল স্থাপনের কয়েক বছর পরই, ১৮৯৫ সালে কলকাতায় তৈরি হয়েছিল আরও এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ‘কলেজ অব ফিজ়িশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স অব বেঙ্গল’। ১৯০৪ সালে রাধাগোবিন্দ করের তৈরি ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজ অব ফিজ়িশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স অব বেঙ্গল এক সঙ্গে মিশে যায়। ১৯১৪ সালের ডিসেম্বরে, এই যৌথ প্রতিষ্ঠানকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলার প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় প্রথমে প্রাথমিক ডিগ্রি তারপর চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্থায়ী ডিগ্রি দেওয়া শুরু হয়। দেশিয় বেসরকারি হাসপাতাল তৈরির স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল ডা. আরজি করের। ১৯১৬ সালে বেলগাছিয়া মেডিকেল কলেজ নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল। সেই সময় নতুন করে এই মেডিক্যাল কলজের উদ্বোধন করেছিলেন বাংলার তৎকালীন গভর্নর, টমাস গিবসন-কারমাইকেল।

দুই বছর টমাস গিবসন-কারমাইকেলের নামে এই মেডিক্যাল কলেজের নাম বদলে রাখা হয়েছিল কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত সেই নামেই পরিচিত ছিল আরজি কর কলেজ। ওই বছর বাংলার আরেক কিংবদন্তি চিকিৎসক, ডা. বিধানচন্দ্র রায় এই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নাম, ডা. আরজি করের নামে রাখার প্রস্তাব করেছিলেন। শোনা যায় সেই সময় অর্থাভাবে ভুগছিল হাসপাতাল। কলকাতার এক ধনী ব্যক্তি লগ্নি করতে চেয়েছিলেন। তবে শর্ত ছিল, হাসপাতালের নাম তাঁর কোনও এক আত্মীয়ের নামে দিতে হবে। ডা. বিধান রায় সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ডা. আরজি করই এই হাসপাতালের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর নামেই হবে হাসপাতালের নামকরণ। ১৯৫৮ সালের মে মাসে কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

তবে, নিজের নামে হাসপাতালের নামকরণ দেখে যেতে পারেনি ডা. রাধাগোবিন্দ কর। ১৯১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন রাধাগোবিন্দ কর। নিজের সর্বস্ব দান করেছিলেন তিনি এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায়। শুধু স্বপ্ন দেখেননি, তা সাকার করে ছেড়েছিলেন রাধাগোবিন্দ।

আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)