Motorcycle Ride: মোটরসাইকেল ডায়েরিজ: পর্ব ৪৫–কলকাতা থেকে ভারতের সুইজ়ারল্যান্ডের উদ্দেশে, সঙ্গে রয়েছে মহাদেব
Uttarakhand: আমার যাত্রা শুরু হয় আগস্ট মাসের শেষের দিকে তার কারণ এই সময় ফুল এবং উপত্যকাগুলোকে বেশ সুন্দর লাগে এবং রাস্তা আর আবহাওয়া এই সময় বেশ অনুকুল থাকে। প্রবল বর্ষায় উত্তরাখণ্ডের বেশ কিছু রাস্তা বন্ধ থাকে ধস নামার কারণ। তাই যখনই এখানের প্ল্যান করবেন একটু আবহাওয়ার খবর নিয়ে নেবেন।
সারা বসন্ত জুড়ে পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার অনেক ছোট ছোট গন্তব্য স্থানে ঘুরে আসা হল। এবার চলুন কলকাতা থেকে একটু দূরে, হাতে ১৪ দিন সময় নিয়ে বেরিয়ে পড়া যাক উত্তরাখণ্ডের সবচেয়ে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় স্থানে। যেখানে গেলে আপনার মনে হবে কাশ্মীরের মতো সুন্দর একটি উপত্যকায় চলে এসেছি। রয়েছে সবচেয়ে উঁচু শিব মন্দির থেকে ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ। এরই সঙ্গে রয়েছে পঞ্চকেদারের মধ্যে দুটি কেদার ভ্রমণের দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতা (অবশ্যই বাইক নিয়ে)। রয়েছে সুন্দর একটি উপত্যকা যেখানে শুধু ফুল দিয়ে ঘেরা এখানে আসলেই আপনার মনে হবে যেন স্বর্গ এখান থেকেই শুরু হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শুধু ভক্তি আর ব্রহ্ম কমলের সন্ধানে সারাদিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। আর সেই ব্রহ্ম কমল নিয়ে চার ধামের একটি ধামে দেবতার চরণে অর্পণ। এছাড়াও রয়েছে পাহাড়, ঝর্ণা, বরফ আর ভারতবর্ষের প্রথম গ্রামে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তার সঙ্গে রয়েছে একটি পাস, আর অনেক অনেক নতুন জায়গা এবং নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে আজকের এবং আগামী বেশ কিছু পর্বে রয়েছে তারই অভিজ্ঞতা। তাই চলুন মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি এইসব প্রকৃতির সন্ধানে। আর বিশ্বাস করুন ১৪ দিনের এই ভ্রমণে গাড়ির তেল এবং ট্রেনের খরচ বাদ দিলে অন্যান্য খরচ হয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। তাই আমি বলি ঘোরার জন্য টাকাপয়সা দরকার হয় না দরকার হয় ভ্রমণের মানসিকতা।
এই ১৪ দিনের মোটরসাইকেল ভ্রমণে কীবে লাগেজ প্যাক করবেন এবং বাইকের কী-কী সরঞ্জাম নেবেন তা বিস্তারিত বিবরণ আছে মোটরসাইকেল ডায়েরির ১২ নম্বর পর্বে। তাই আর এইসব কথা না বলে চলুন বাইক কীভাবে ট্রেনে নিয়ে যাবেন তারই বিস্তারিত বলা যাক। আমাদের মতন বাইক প্রেমিকরা বারবার একই পথে হাজার থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার যাত্রা খুব একটা পছন্দ নয় তাই বেশ কিছু রাইডাররা বাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য পন্থা অবলম্বন করে। এতে সময়, বাইক এবং রাইডারের এনার্জিও বাঁচে।
দুটি উপায় আপনি ট্রনে করে বাইক নিয়ে যেতে পারেন। একটি লাগেজ হিসেবে আরেকটি পার্সেল হিসাবে। লাগেজ হিসেবে বাইক নিয়ে গেলে, যেদিন আপনার ট্রেনের যাত্রা তার একদিন আগে বাইকের চালান কাটতে হবে এবং লাগেজ হিসেবে বুক করতে হবে। এর জন্য লাগবে আপনার আধার কার্ড, আপনার গাড়ির স্মার্ট কার্ড আর ট্রেনের টিকিটের জেরক্স। গাড়ির ওজন এবং ভ্যালুয়েশনের উপর একটি মূল্য (সরকারি রেটে) দিতে হয়। যদি আপনি কলকাতা থেকে অমৃতসর যাত্রা করেন তাহলে সব মিলিয়ে মোটামুটি একটি বাইকের পিছু চার হাজার টাকা খরচ হবে। পরের দিন ট্রেন ছাড়ার এক ঘণ্টা আগে এসে নিজের গাড়ি দায়িত্ব সহকারে ভালভাবে তুলে রাখুন। ট্রেনের লোক তো থাকবেই তাও তাদের সঙ্গে নিজেও একটু সাহায্য করবেন, না হলে আপনার বাইকের উপর ওরা অন্য লাগেজ চাপিয়ে দেওয়ার ফলে গাড়ির ক্ষতি হতে পারে। যেটা প্রায়ই ঘটে থাকে। আর অন্যটি পার্সেল হিসেবে বুকিং করলে খরচা একটু কম লাগে ঠিকই, কিন্তু গাড়ি পৌঁছানোর সঠিক দিন থাকে না, কখনও আগেও হতে পারে আবার কখনও ওই নির্দিষ্ট জায়গায় পরের স্টেশনেও পৌঁছাতে পারে। আমি এভাবে গাড়ি লাগেজ হিসেবে বুকিং করে বহুবার যাত্রা শুরু করেছি। তাও বলে রাখি এই যাত্রাপথে অসুবিধা হলে আপনি রেল মিনিস্টারকে টুইট করতে পারেন তারা আপনাকে সঠিকভাবে সাহায্য করবে।
আমার যাত্রা শুরু হয় আগস্ট মাসের শেষের দিকে তার কারণ এই সময় ফুল এবং উপত্যকাগুলোকে বেশ সুন্দর লাগে এবং রাস্তা আর আবহাওয়া এই সময় বেশ অনুকুল থাকে। প্রবল বর্ষায় উত্তরাখণ্ডের বেশ কিছু রাস্তা বন্ধ থাকে ধস নামার কারণ। তাই যখনই এখানের প্ল্যান করবেন একটু আবহাওয়ার খবর নিয়ে নেবেন। আমার ট্রেনের যাত্রা ছিল হরিদ্বার পর্যন্ত। হরিদ্বারে বাইক রিসিভ করে লাগেজপত্র বেঁধে রাস্তা ঠিক উল্টোদিকের পেট্রোল পাম্পে গিয়ে তেল ভর্তি করে আজকের রাত কাটানোর জন্য ধর্মশালা খুঁজে নিলাম। তারপর লাগেজপত্র রেখে ভালো করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম সন্ধ্যারতি দেখার জন্য। সন্ধ্যারতি দেখে দাদা-বৌদির আসল হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে ধর্মশালায় পৌঁছে গেলাম।
পরের দিন সকালের গন্তব্যস্থান উত্তরাখণ্ডের চোপ্তা ভ্যালি। যাকে মিনি সুইজারল্যান্ডও বলা হয়। হরিদ্বার থেকে চোপ্তা ভ্যালির দূরত্ব ২৩০ কিলোমিটার, যা পৌঁছাতে আপনার ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা সময় লাগবে। এর মাঝে আছে বেশ কিছু দেখার মতো স্থান। তাই সকাল ছটার মধ্যে বাইকের লাগেজপত্র বেঁধে, ভাল করে ব্রেকফাস্ট না করেই বেরিয়ে পড়লাম ঋষিকেশের উদ্দেশ্যে। সকালে হোটেল ছাড়ার আগে প্রতিদিনের জলখাবারের মধ্যে একটি খাবর হল ব্যাগে থাকা ছাতু , যা বেশ ভাল করে জলের মাধ্যমে খাওয়া যার ফলে সময় এবং শরীর দুটোই ভাল থাকে।
সকালে বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া থাকার দরুন আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন রামঝুলা। এরপর পরবর্তী স্থান লাক্সমান ঝুলা। এরপর সোজা চলে আসুন দেবপ্রয়াগে, যেখানে অলকানন্দা এবং ভাগীরথী নদী মিশে গঙ্গা নদীর সৃষ্টি করে। এটি একটি সঙ্গমস্থান। এখানে পূর্ণ স্নানের জন্য বহু মানুষ এসে থাকেন। এছাড়াও সঙ্গমস্থানে গড়ে উঠেছে ভগবানের মন্দির এবং এটি দেখতে ভালো বেশ ভাল লাগে। দুটি নদীর আলাদা রঙ মিশে এখানে এক হয়ে গেছে।
এরপর ভাগীরতি নদী ক্রস করে ডান দিকে ধরে সোজা চলে আসুন রুদ্রপ্রয়াগে। এটি আরেকটি সঙ্গমস্থান। এখানে অলকানন্দা নদীর সঙ্গে মন্দাকিনী নদী মিশে অলকানন্দ নদী নামে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর উখীমঠ থেকে ডান দিকে নিয়ে সোজা চলে আসুন চোপ্তা ভ্যালিতে। এখানে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে যাবে। এই চোপ্তা ভ্যালিকে মিনি সুইজারল্যান্ড বলার কারণ হল এখানকার ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, চিরসবুজের মাঝে উঁচু উঁচু পাহাড় এবং সুন্দর উপত্যকা এছাড়াও রয়েছে লেক আর বড় বড় গাছ। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখানের ভৌগোলিক রূপেরও পরিবর্তন হয়। শীতকালে এখানে বরফ পরে, বর্ষাকালে আবার চিরসবুজে ঢেকে যায় এবং শীতের পরে এই ঘাসগুলো আবার সোনালী বর্ণ ধারণ করে। এত সুন্দর এবং বিস্তীর্ণ উপত্যকা আপনি খুব কমই দেখতে পাবেন ভারতবর্ষে অন্য একটি জায়গায় এরকম উপত্যকা দেখা যায় সেটির নাম কাশ্মীর।
আজকের রাত কাটানোর স্থান হলো তুঙ্গনাথ মন্দিরের বেস ক্যাম্প। যেটি রাস্তা থেকে ৬ কিলোমিটারের হাঁটার রাস্তা। নিচে রাস্তার একটি হোটেলে লাগেজপত্র রেখে একদিনের কিছু দরকারী কিছু জিনিসপত্র নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। সুন্দর প্রকৃতির মাঝে চারিপাশের ভূপ্রকৃতি এবং বৈচিত্র দেখে এই ৬ কিলোমিটারের রাস্তায় একটু কষ্ট আপনার মনে হবে না। বেস ক্যাম্পে পৌঁছানোর প্রায় ৫০০ মিটার আগে শুরু হলো অঝরে বৃষ্টি। প্রায় এক ঘণ্টা একটি দোকানে কোনওরকম মাথা গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পরে সরকারি হোটেল খুঁজে আগে একটু চা খেয়ে গা গরম করলাম। বৃষ্টি হওয়ার কারণে তাপমাত্রা নেমে যাওয়ার দরুন বেশ ঠান্ডা অনুভব করলাম। সন্ধ্যার সময় তুঙ্গনাথ মন্দিরে শুরু হল সন্ধ্যা আরতি। আমি আর দু-তিনজন মিলে সন্ধ্যা আরতি উপভোগ করে হোটেলে প্রবেশ করলাম। সন্ধে হয়ে যাওয়ার দরুণ আজ চন্দ্রশীলা যাওয়া সম্ভব হল না। তাই ঠিক করলাম পরের দিন সকালে সূর্যোদয় চন্দ্রশিলা থেকেই দেখব। এই তুঙ্গনাথ মন্দির, কেদারনাথের থেকেও উঁচুতে অবস্থিত এবং এর ভৌগলিক বৈচিত্র কেদারনাথের থেকেও সুন্দর। আমার মনে হয় এখানেই ভগবানকে সবথেকে কাছে পাওয়া যায় কারণ এখানে নেই কোনও ভিড়, আপনি যত খুশি এবং অনেক সময় ধরে তার দর্শন করতে পারেন।
উত্তরাখণ্ড ডায়েরির পরবর্তী অংশ রয়েছে আগামী পর্বে।