সারদা দেবীর অভাবী বাপের বাড়িতে হঠাত করে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়, কেন জানেন?
অভাবের তাড়নায় সারাবছর গতর খাটিয়ে মা কালীরপুজোর জন্য একটু একটু করে যে নৈবেদ্যর ডালা সে সাজিয়ে রেখেছিলেন তিনি, তা যদি বিফলে যায় কষ্ট তো হবেই। শ্যামাদেবী অপমান-গ্লানি আর একরাশ দুঃখ নিয়ে সারারাত কষ্টে কাঁদতে থাকেন।
‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দটি এক হিন্দু দেবীর নাম। শাস্ত্রের অক্ষর দিয়ে এই শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় যিনি জগৎ’কে ধারণ করেন, তিনিই জগদ্ধাত্রী। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের এই জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলনের ক্ষেত্রে সুবিশাল ইতিহাস কথিত আছে, সেসব ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা।
হুগলি জেলার আরও একটি দর্শনীয় স্থান জয়রামবাটী। জয়রামবাটী এলাকাটি সম্পর্কে পরিচিত সকলেই, কারণ হিন্দু দেবী মা-কালীর অন্যতম সাধক শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণের পত্নী মা সারদার বাপের বাড়ি অর্থাৎ জন্মস্থান হল জয়রামবাটী। কথিত আছে, সারদাদেবীর মা শ্যামাসুন্দরী দেবী অল্প বয়সেই স্বামীকে হারান। ফলত বিধবা শ্যামাসুন্দরী দেবীর একার পক্ষে সংসার চালানো, ছেলেমেয়ে মানুষ করা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। যে কারণে ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে শ্যামাসুন্দরী দেবী বাধ্য হয়ে গ্রামের এক আভিজাত্যপূর্ণ ব্রাহ্মণের বাড়িতে ধান ভানার কাজে ঢোকেন, যদিও তাঁর কন্যা মা সারদার তখন স্বয়ং রামকৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে মা সারদা দক্ষিণেশ্বর থেকে বাপের বাড়ি এলে মা শ্যামাসুন্দরীকে ধান ভানার কাজে সাহায্য করতেন। যাইহোক, এই ছিল শাম্যাসুন্দরী দেবীর সংসার পরিচালনা। কিন্তু হঠাৎ করে ওই অভাবের সংসারে শ্যামাসুন্দরী দেবী জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলিত করলেন কেন?
শোনা যায়, জয়রামবাটীতে কালীপুজোর সময় সে-গ্রামের ব্রাহ্মণ নব মুখুজ্জে রীতি অনুযায়ী প্রত্যেক গ্রামবাসীর ঘরে মা কালীর পুজোর জন্য চাল নৈবেদ্য নিতেন। হঠাৎ সে বছর কোন অজ্ঞাত কারণবশত নব মুখুজ্জে শ্যামাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চাল নৈবেদ্য নিতে অস্বীকার করেন। এ ঘটনায় সাংঘাতিক ভাবে মর্মাহত হন শ্যামাদেবী, মর্মাহত হওয়ারই কথা। অভাবের তাড়নায় সারাবছর গতর খাটিয়ে মা কালীরপুজোর জন্য একটু একটু করে যে নৈবেদ্যর ডালা সে সাজিয়ে রেখেছিলেন তিনি, তা যদি বিফলে যায় কষ্ট তো হবেই। শ্যামাদেবী অপমান-গ্লানি আর একরাশ দুঃখ নিয়ে সারারাত কষ্টে কাঁদতে থাকেন। হঠাৎ তিনি দেখেন তাঁর পাশে এক রক্তবর্ণা দেবী এসে তাকে বলছেন – ‘কাঁদছ কেন মেয়ে? তোমার নৈবেদ্য মা কালীর পুজোর জন্য নেয়নি তো কী হয়েছে, আমি তোমার নৈবেদ্য গ্রহণ করবো’ পরবর্তীকালে স্বয়ং শ্যামাদেবী জানতে পারেন উনি স্বয়ং দেবী জগদ্ধাত্রী। এবং সেই বছর জয়রামবাটীতে শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পুজো। পুজোতে দক্ষিণেশ্বর থেকে এসে অংশগ্রহণ করেন স্বয়ং সারদাদেবীও।
শ্যামাসুন্দরী দেবী ছিলেন একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একরোখা এক মহিলা, নব মুখুজ্জের সেদিনের ওই চরম অপমান তিনি সহ্য করতে পারেননি। ফলত একপ্রকার অহংকার ও জেদের বসেই তিনি কালীপুজোর পর মা জগদ্ধাত্রী পুজো করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। যা পরবর্তীতে মা সারদার হাত ধরে পূজিত হয়েছে। কথিত আছে, এই জগদ্ধাত্রী পুজোর পরই শ্যামাদেবীর সংসারে উন্নতি আসে। দারিদ্র ঘুচে যায়। সারদা দেবীও জীবনের শেষ বছর পর্যন্ত প্রত্যেকবার জয়রামবাটীতে গিয়ে পুজোর তত্ত্বাবধান করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও থামেনি সেই পুজো। আজও পালিত হয় মহাসমারোহে। এলাকাবাসীরাই বয়ে নিয়ে চলেছেন সেই ঐতিহ্য।
সৌজন্য- সকলের মা সারদা / নিমাইসাধন বসু