‘অ্যাপ’-ই এখন পরম বন্ধু, নজর কেবল নোটিফিকেশনে, বিপদ বাড়ছে না তো?

তাহলে কি হোমো সেপিয়েন্স এ বার হোমো অ্যাপিয়েন্সে পরিণত হল?

'অ্যাপ'-ই এখন পরম বন্ধু, নজর কেবল নোটিফিকেশনে, বিপদ বাড়ছে না তো?
এ বছর অতিমারী করোনার আবহে আরও বেড়েছে অ্যাপের ব্যবহার।
Follow Us:
| Updated on: Dec 11, 2020 | 10:56 AM

একুশ শতকে স্মার্টফোন এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। নবীন হোন বা প্রবীণ প্রজন্ম অত্যাধুনিক মুঠোফোনে আজকাল প্রায় সবাই সড়গড়। প্রায় প্রতি মাসেই দেশে লঞ্চ হচ্ছে নিত্যনতুন ফিচার যুক্ত চোখ ধাঁধানো সব স্মার্টফোন। আর এতেই লুকিয়ে রয়েছে হাজার হাজার অ্যাপস। যার সাহায্যে এক ক্লিকে আপনার দোরগোড়ায় হাজির হচ্ছে পছন্দের সবকিছু।

আজ ১১ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ‘অ্যাপ ডে’। ২০১০ সালে আমেরিকান ডায়ালেক্ট সোসাইটি প্রথম ‘অ্যাপ’ শব্দটিকে শব্দ তালিকায় স্থান দিয়েছিল। এর আগে ২০০৭ সালে বাজারে আসে অ্যাপেলের আইফোন। পরের বছর ২০০৮ সালে অ্যাপেল ওএস ২.০ লঞ্চ করেছিল। এর মধ্যে ছিল অন্তত ৫০০ অ্যাপ। সেই সঙ্গে থার্ড পার্টি অ্যাপ জেনারেশনকেও নতুন অ্যাপ বানানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

হালফিলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে এইসবই অ্যাপ পরম বন্ধু। চার দেওয়ালের ভিতর হোক বা চৌকাঠের বাইরের জীবন, সব জায়গাতেই আজকাল এইসব অত্যাধুনিক অ্যাপই দোসর। এক ক্লিকেই হচ্ছে মুশকিল আসান। মুদি দোকানের জিনিস, ট্রেন্ডি স্টাইলের জামাকাপড়, মেকআপ-গয়না-অ্যাকসেসরিজ, কাঁচা বাজার থেকে নানা রকমের মাছ, এমনকি শীতের স্পেশ্যাল নলেন গুড় কিংবা জিভে জল আনা সব মিষ্টি, এইসবই আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে অ্যাপের সাহায্যে। শুধু তাই নয়, আজকাল যাতায়াত ব্যবস্থাতেও আমজনতা অ্যাপেরই সহায় হন।

এ বছর অতিমারী করোনার আবহে আরও বেড়েছে অ্যাপের ব্যবহার। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাড়ির বাইরে বেরোননি সাধারণ মানুষ। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকেনি। তাই অ্যাপের সাহায্যেই বাড়িতে এসেছে ওষুধ, বাজার, রোজকার জীবনের প্রয়োজনীয় সব জিনিস। বর্তমানে অবস্থা এমন যে অনেকেই হয়তো বলছেন, ‘অ্যাপ কি খাতির কুছ ভি করেঙ্গে’। স্মার্টফোনে দ্রুত গতিতে চলেছে বিভিন্ন অ্যাপের ডাউনলোড প্রক্রিয়া। টাকাপয়সার লেনদেন থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কের কাজকর্মও আজকাল হয়ে যায় অ্যাপের মাধ্যমেই। এছাড়াও ছবি কিংবা ভিডিও এডিটিং অথবা পছন্দের সিনেমা-গান ডাউনলোড, সবেতেই হাত রয়েছে অ্যাপের।

স্বভাবতই অ্যাপ নির্ভর সমাজের ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন আজকাল ঘুরেফিরে বারবার উঠছে। তাহলে কি হোমো সেপিয়েন্স এ বার হোমো অ্যাপিয়েন্সে পরিণত হল? বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, এখনও সমাজ পুরোপুরি অ্যাপ নির্ভর হয়ে না পড়লেও, এমন দিন আসতে বেশি দেরি নেই। বিভিন্ন অ্যাপের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় মানুষ আজকাল সামাজিকতা ভুলেছে। দোকান-বাজার ঘুরে বেছে জিনিস কেনার প্রবণতা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধীরে ধীরে কমছে। দরাদরি করে জিনিস কেনার বদলে তাদের চোখ ৬ ইঞ্চির স্ক্রিনে। সবসময় খেয়াল রাখতে হচ্ছে কোন অ্যাপ কত ছাড় দিল। অফার মিস মানেই দারুণ সব সুযোগ হাতছাড়া। আর তেমনটা কোনও ভাবেই হতে দেওয়া যায় না।

সারাক্ষণ একগুচ্ছ অ্যাপের অফারের হদিশ রাখতে গিয়ে মস্তিষ্কে চাপ পড়ছে সকলেরই। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যেই ‘টুং’ শব্দে ফোন বাজলেই নজর যাচ্ছে সেদিকে। ফোন না দেখেই বোঝা যাচ্ছে অ্যাপের নোটিফিকেশন এসেছে। যতক্ষণ না হাতে ফোন নিয়ে সেসব দেখতে পাচ্ছেন ততক্ষণ শান্তি নেই। হাজার গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও নোটিফিকেশন এলেই ফোন দেখা চাই। নয়তো না জানি কী মহার্ঘ হাতছাড়া হয়ে যাবে। ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা বলছে, একটি কাজের মাঝে নোটিফিকেশন এলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন ঘাঁটতে শুরু করলে ফের কাজে ফিরতে একজন মানুষের অন্তত ২৩ মিনিট সময় লাগে। অনেক সমীক্ষায় আবার এটাও দেখা গিয়েছে যে শুধু নোটিফিকেশন আসায় একজন মানুষ দিনে হয়তো ১৫০ বার নিজের ফোন চেক করেন। সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম, অসংখ্য অ্যাপ, খবর—-সবই আজকাল ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নোটিফিকেশন হিসেবে।

আর এই নোটিফিকেশনেই মজেছে আমজনতা। এর প্রভাবে ব্যাঘাত ঘটেছে জরুরি কাজে। অনেকক্ষেত্রেই দরকারি কাজ ফেলে ফোন ঘাঁটতে বসে যাচ্ছেন অনেকেই। কাজের মাঝে বারবার ফোনের দিকে নজর যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে একাগ্রতা এবং মনযোগ নিয়েও। নোটিফিকেশনের ‘টুংটাং’ শব্দ আর অ্যাপের প্রলোভনের হাতিছানি ক্রমশ একজনকে অমনযোগী করে দিতে পারে। তাই সময় থাকতে সতর্ক হোন। জীবনে কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেবেন সেটা অবশ্যই বেছে নিন।