Black Softshell Turtle: দুই বাংলার মাজারে, মন্দিরে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের ‘বিরল’ গল্প
Black Softshell Turtle: মোহন—এক প্রজাতির কাছিমের ডাকনাম। ইংরেজিতে ‘ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল’। পিঠের দিকে চারটি গোলাকার দাগ আর লম্বা নাক এই কচ্ছপকে অন্য কচ্ছপদের থেকে আলাদা করে চেনায়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এই কাছিমদের গল্প অনেকটা ফিনিক্স পাখির মতো। শুনুন সেই গল্প।
নন্দন পাল
মোহন—এক প্রজাতির কাছিমের ডাকনাম। ইংরেজিতে ‘ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল’ (Black Softshell Turtle)। পিঠের দিকে চারটি গোলাকার দাগ আর লম্বা নাক এই কচ্ছপকে অন্য কচ্ছপদের থেকে আলাদা করে চেনায়। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের এই কাছিমদের গল্প অনেকটা ফিনিক্স পাখির মতো। শুনুন সেই গল্প। ২০০২-এ ইন্টারন্যাশানাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (International Union For Conservation of Nature) বা আইইউসিএন (IUCN) ‘বিলুপ্ত’ বা ‘Extinct’ বলে ঘোষণা করে ‘ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল’কে। প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যায় ‘ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল’। প্রকৃতিবিদরা বলে থাকেন, “আমরা যদি দুনিয়ার জীব জগতকে একটা চাদরের মতো বলে ভাবি, তাহলে প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদ সেই চাদরের এক-একটি সুতো। তা-ই একটি প্রজাতি—তা সে প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ যাই-ই হোক না কেন—সে যদি অবলুপ্তির পথে হাঁটে, তাহলে প্রকৃতিরূপী ওই চাদরে একটি স্থায়ী ছিদ্র তৈরি হয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া সেই প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার আর কোনও উপায়ও থাকে না।” এমনটাই হয়েছিল ‘মোহন’ বা ‘ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল’-এর ক্ষেত্রে। চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল তারা।
কিন্তু প্রকৃতি অনেক সময় এমন খেল দেখায় যা আমাদের সাধারণ বোধবুদ্ধি আর জ্ঞানকেও বোকা বানিয়ে দেয়। ২০০২-এ আইইউসিএন-এর সেই ঘোষণার পর ২০০৪-এ বাংলাদেশের (Bangladesh) চট্টগ্রামের (Chattagram) বাইজিদ বোস্তমি মাজার সংলগ্ন পুকুরে ৪০৮টি ‘মাজারি’ কাছিমের খোঁজ পান পরিবেশকর্মীরা। মাজারের পুকুরে বাসস্থান বলে স্থানীয়দের কাছে ‘মাজারি’ নামে পরিচিত ছিল এই কচ্ছপগুলি। কথিত আছে ১৮০০ সালে হজরত বাইজিদ বোস্তমি ইরান (Iran) থেকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসেন এই কাছিমের পূর্বপুরুষদের। ধর্মগুরুর নাম জড়িত থাকায় বাংলাদেশের সাধারণ জনমানসে এই কাছিমের গুরুত্বও ছিল। মাজার কর্তৃপক্ষের তদারকিতে ওই কাছিমদের প্রজনন হত চট্টগ্রামে। ২০০৭-এ ডিম ফুটে বের হয় ৯০টি ‘মাজারি’ কাছিমের ছানা। ২০০৮-এ ৭৪টি, ২০০৯-এ ৯৬টি, ২০১০-এ ২৮টি, ২০১২-এ ৪৫টি আর ২০১৪-এ ৪০টি কাছিম জন্মায়। পরিবেশকর্মীদের সন্দেহ হয়, চট্টগ্রামের বাইজিদ বোস্তমি মাজার সংলগ্ন পুকুরের কাছিমগুলি ‘ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল’। এ দিকে, ২০১৭-এ নাগাল্যান্ডের (Nagaland) ওকহা জেলার ওল্ড ওকুক গ্রামে বন্য পরিবেশে (Wild Condition) পাওয়া যায় একটিমাত্র ব্ল্যাক সফট সেল টার্টলকে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সেই কচ্ছপটির ডিএনএ (DNA)-র নমুনা সংগ্রহ করে পাঠান চট্টগ্রামের বাইজিদ বোস্তমি মাজারে। পরিবেশকর্মী ও বিজ্ঞানীদের সন্দেহ নির্ভুল প্রমাণিত হয়, মাজারের পুকুরের ‘মাজারি’ কাছিমগুলির ডিএনএ-র সঙ্গে হুবহু মিলে যায় নাগাল্যান্ডের কাছিমের ডিএনএ। নিঃসন্দেহ হন বিজ্ঞানীরা: ‘মাজারি’ কাছিম আসলে ব্ল্যাক সফট সেল টার্টলই।
নড়েচড়ে বসেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। আরও খোঁজ আসে আসাম থেকে। কাজিরাঙ্গা (Kaziranga National Park)-র জিয়াভরালি নদী আর ব্রহ্মপুত্র (Brahmaputra) নদের অববাহিকায় দু’টি ছোট্ট অঞ্চলে বন্য পরিবেশে অল্প সংখ্যক ব্ল্যাক সফট সেল টার্টলের খোঁজ পান পরিবেশকর্মীরা। ওপার বাংলার মতোই এপার বাংলাতেও এই একই কাছিমের সংরক্ষণে নীরবে ঘটে চলেছিল এক ঘটনা। বন্যপ্রাণের সংরক্ষণের নিরিখে যা কিছুটা বিরল। বলা যেতে পারে ‘রিলিজিয়াস কনজারভেশন’ (Religious Conservation)। ইসলাম (Islam) এবং হিন্দু (Hinduism) দুই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বিরল কাছিম বেঁচেবর্তে ছিল কাঁটাতারের দুই পারে।
রাস্তা পার হচ্ছে মোহন, সাহায্য করছেন পরিবেশপ্রেমী।
অসম (Assam)-এর হয়গ্রীবা মাধব মন্দিরের পুকুরে, ত্রিপুরা (Tripura)-র সুন্দরী মন্দির সংলগ্ন কল্যাণ সাগর পুকুরে আর পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal)-এর কোচবিহারের বানেশ্বর মন্দির সংলগ্ন শিবদিঘিতে আছে ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল। শিবদিঘির ওই কাছিমদের স্থানীয়রা আদর করে ডাকেন ‘মোহন’ বলে। হিন্দু ধর্মে বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার( Second Avtar of Lord Vishnu) কূর্ম। বিষ্ণুর অপর নাম ‘মোহন’। তাই ওদের এমন নামকরণ? ধর্মীয় বিশ্বাস যুক্ত হওয়ায় পুকুরগুলিতে নির্বিঘ্নেই ছিল কাছিমগুলি। আসলে মানুষের কারণেই ওদের অবলুপ্তির পথে হাঁটা। আর মানুষের কারণেই ওদের আবার ফিরে আসা।
কাজী নজরুল ইসলামের কথায়: “তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু। আমরা অবোধ, অন্ধ মায়ায় তাই তো কাঁদি প্রভু।। তোমার মতোই তোমার ভুবন চির পূর্ণ, হে নারায়ণ! দেখতে না পায় অন্ধ নয়ন তাই এ দুঃখ প্রভু।”
বহুদিন ধরে কোচবিহারের শিবদিঘির অন্যতম আকর্ষণ এবং বাণেশ্বর মন্দিরের খ্যাতির কারণ ব্ল্যাক সফট সেল টার্টল। এই পুকুরকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জীববৈচিত্র্য পর্ষদ (State Biodiversity Board) ‘হেরিটেজ সাইট’ (Heritage Site) ঘোষণা করেছে। অথচ দিঘির জলের মান, জলে অক্সিজেনের পরিমাণ এসব মাপার কোনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করছিলেন না মন্দির কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ, পুকুরের চারপাশ কংক্রিটে বাঁধাই করে দেওয়ার জেরে মারা যাচ্ছিল বিরল, আইইউসিএন-এর সংরক্ষণের নতুন মাপকাঠিতে ‘অতি বিপন্ন প্রজাতি’ (Critically Endangered Species)। ২০২২-এর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে কোচবিহারের বানেশ্বর মন্দিরের পুকুরে অস্বাভাবিকভাবে ভাসতে দেখা যায় তিনটি ‘মোহন’ কচ্ছপকে। পরিবেশ সংগঠন ‘আর্থ’ (EARTH) ও ‘বন’ (BAN)-এর সদস্যরা ওই তিনটি কাছিমকে উদ্ধার করে বন দপ্তরের (Forest Department) হাতে তুলে দেন। চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল ওই বিপন্ন প্রজাতির অসুস্থ মোহনদের। দু’টি মোহন চিকিৎসায় সাড়া দেয়। একটি ‘মোহন’ মারা যায়।
কোচবিহারের ওই অঞ্চলে মোহনদের সংখ্যার প্রাচুর্য। শিবদিঘি ছাড়াও নিকটবর্তী সাগরদিঘিতে রয়েছে বেশ কিছু ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল। শিবদিঘিতে কিছুটা সুরক্ষিত হলেও অন্যত্র মোহন চুরি চলছিল রাতের অন্ধকারে। মুখ বন্ধ-বস্তায় প্রতি রাত্রে ১৫-২০টা করে পাচার (Smuggle) হয়ে যাচ্ছিল বিরল প্রজাতির এই ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল।
বানেশ্বর মন্দিরের শিবদিঘিতে।
পাচার আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছাড়াও কোচবিহারে ব্ল্যাক সফটসেল টার্টলের সংখ্যা কমার অন্য একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল পথ দুর্ঘটনা। ২২ অক্টোবর পথ-দুর্ঘটনার বলি হয়েছে ১৬টি ‘মোহন’। ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল সক্রিয় হয় রাত্রে। রাস্তা পারাপারের সময় তারা ধীর গতিতে চলে এবং তাদের গায়ের রঙ কালো হওয়ায় কারণে গাড়ির চালকরা অনেক সময়েই বুঝতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, ওই অঞ্চলের রাস্তায় নেই কোনও নৈশালোক। তার ওপর রাস্তায় কোনও সাইনবোর্ড-ও ছিল না। এই অবস্থায় সক্রিয় হয়েছে স্থানীয় বন্যপ্রাণ সংগঠনগুলো। বাণেশ্বর মন্দির সংলগ্ন কোচবিহারের ‘মোহন রক্ষা কমিটি’র সদস্যরা এবং সহযোগী বন্যপ্রাণ সংগঠনগুলো পথে নেমেছে। পথ-দুর্ঘটনায় ‘মোহন’মৃত্যুর ঘটনায় সচেতনতাবৃদ্ধির জন্য একটি পথ অবরোধ করা হয়। মোমবাতি হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ‘মোহন রক্ষা কমিটি’র সদস্যরা গাড়ির চালক ও পথচলতি মানুষের মধ্যে মোহনের মতো একটি অতি বিরল প্রজাতির কাছিমের গুরুত্ব তুলে ধরেন। স্থানীয় বাজার ও মন্দির সংলগ্ন এলাকায় মোহন পাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে একজোট হবার ডাকও দেন তাঁরা।
এই বছর মোহন বাঁচানোর উদ্দেশে শিবদিঘিতে বন্ধ হয়েছে ছট পুজো। ‘মোহন রক্ষা কমিটি’র সভাপতি পরিমল বর্মণ TV9 বাংলাকে বলেছেন, “মন্দির ট্রাস্ট, বন দপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই ভুগছে ‘মোহন’। বাংলাদেশ এবং পাশের রাজ্য অসমে সরকারি তত্বাবধানে সংরক্ষণ হচ্ছে ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল। অথচ এই রাজ্যে নেই তেমন কোনও সরকারি পরিকল্পনা কিংবা উদ্যোগ।” তাই পরিমলবাবু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠিও লিখেছেন। অতি বিরল প্রজাতির এই ব্ল্যাক সফটসেল টার্টল বা ‘মোহন’ এর সংরক্ষণে পরিকল্পনা মাফিক সংরক্ষণের দাবিতে।
ছবি সৌজন্য: বন ফাউন্ডেশন।