গায়ে ডোরা কাটা দাগ, জ্বলজ্বল করছে চোখ; ‘বাঘের বাচ্চা’র ভয়ে ঘুম উড়েছে উত্তরপাড়াবাসীর

বাঘরোলেরই (Fishing Cat) সব দোষ। মানতে নারাজ এক দশকের বেশি সময় ধরে ফিশিং ক্যাট নিয়ে কাজ করা নারী শক্তি (২০১৬) সম্মানে ভূষিতা তিয়াষা আঢ্য।

গায়ে ডোরা কাটা দাগ, জ্বলজ্বল করছে চোখ; 'বাঘের বাচ্চা'র ভয়ে ঘুম উড়েছে উত্তরপাড়াবাসীর
ফাইল চিত্র।
Follow Us:
| Updated on: Jun 21, 2021 | 8:23 PM

হুগলি: বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবারও বাঘরোলের (Fishing Cat) আতঙ্ক গঙ্গাপাড়ের জেলা হুগলিতে। গত বছর কোন্নগরের পর এবার উত্তরপাড়া। পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডের মাখলার সারদাপল্লি, বজরংবলী মন্দির এলাকায় নাকি দেখা যাচ্ছে চার পেয়ে এই প্রাণীকে। অনেকে তো বাঘের বাচ্চা বলেও রটিয়ে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। ভয়ে কাঁটা এলাকার মানুষ। তবে সত্যিই কি বাঘরোলে ভয়ের কারণ রয়েছে? নাকি আমরা ওদের চিনি না বলেই এ ভাবে ত্রস্ত হয়ে থাকি?

গায়ে ডোরা কাটা দাগ, রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে চোখ জোড়া। ছোট্ট পায়ের থাবায় চাপ দিয়ে কখনও ছুটছে, কখনও আবার মন্থর গতি। গত বছর জানুয়ারিতে কোন্নগরের কানাইপুরে এই মেছো বিড়ালের ভয়ে তটস্থ হয়ে ছিলেন মানুষ। ভরা শীতের রাতে বাড়ির সামনে ছোট্ট এই প্রাণীর হানা ঘুম উড়িয়েছিল এলাকাবাসীর। আবারও সেই আতঙ্ক ফিরেছে উত্তরপাড়ায়। বিধিনিষেধের কড়াকড়িতে বাইরে লোক কম। তার উপর বাঘরোলের ভয়ে সন্ধ্যার পর বাড়িতে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন স্থানীয়রা।

ইতিমধ্যেই বন দফতরে জানানো হয়েছে। মাখলার পাশেই বন্ধ হিন্দমোটর কারখানার বিস্তীর্ণ এলাকা জঙ্গল হয়ে রয়েছে। সেখানেই এই বাঘরোল, ভাম, শিয়ালের দেখা মিলছে আজকাল। এলাকায় অনেক জলাশয় থাকায় মাঝে মধ্যেই বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাটের দেখা মেলে। বন দফতর জানিয়েছে অযথা আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কেউ যেন ওর কোনও ক্ষতি না করেন। কিন্তু ওদের সঙ্গে মানুষের পরিচিতিটা একেবারে নেই বলেই হয়ত কখনও কখনও নির্দয় হয়ে পড়েন মানুষ।

আমরা হয়ত অনেকেই জানি এই বাঘরোল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রাণী। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ন বা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (IUCN) এদের সংরক্ষণের লাল তালিকায় রেখেছে। এদের জন্য একটা গোটা মাস রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস আন্তর্জাতিক ভাবে ফিশিং ক্যাট ফেব্রুয়ারি হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। বাঘরোল বৃহৎ মার্জার গোষ্ঠীর একমাত্র প্রাণী যারা জলে ডুবে তার শিকার ধরে। বিড়াল জাতীয় প্রাণী সাধারণত জলে নামে না। অথচ এই বাঘরোলের বেঁচে থাকার অন্যতম শর্তই হল জল।

কিন্তু যে ভাবে জলা জমি, পুকুর বুজিয়ে ‘উন্নয়ন’ হয় তাতে বাঘরোলেরা বাসস্থান আর খাদ্যের সঙ্কটে পড়ছে। প্রতি বছর ৩০ শতাংশ হারে কমছে ওদের সংখ্যা। সারা পৃথিবীর বাঘরোলের উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে, ওদের বসবাসের ৯০ শতাংশই লোকালয় সংলগ্ন এলাকা। ওদের বাঁচিয়ে রাখতে গেলে মানুষের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।

এ রাজ্যে হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব-পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পাওয়া যায় ওদের। ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার জলাভূমি অঞ্চলে বাঘরোলের দেখা পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: তৃতীয় ঢেউ থেকে রক্ষা করতে হবে ছোট্ট কুঁড়িদের, শহরে চালু হচ্ছে শিশুদের প্রথম সেফ হোম

আমাদের দেশে জলাভূমিকে পতিত জমি হিসাবে ধরে শিল্পায়ন হচ্ছে। তার ফলে জলাভূমি হারাচ্ছে। বাঘরোলেরও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় আঘাত পড়ছে। যার জেরে ওরা ঢুকে পড়ছে জনবসতি এলাকায়। বাড়ছে মানুষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। বাঘরোলও পেটের তাগিদে তুলে নিয়ে যাচ্ছে মুরগি, হাঁস, ছাগল। আর এতেই জনরোষের শিকার হচ্ছে বেচারা বাঘরোলের দল। পিটিয়ে মারাও হচ্ছে ওদের।

তবে সবসময় যে ওদেরই দোষ থাকে তেমনটা মানতে নারাজ এক দশকের বেশি সময় ধরে বাঘরোল নিয়ে কাজ করা নারী শক্তি (২০১৬) সম্মানে ভূষিতা তিয়াষা আঢ্য। তাঁর কথায়, “অনেক সময় এমনও হয় এলাকার কেউ হয়ত রাতের অন্ধকারে অন্যের পুকুরে গিয়ে মাছ ধরে এনেছেন। সেটার দোষও বাঘরোলের উপরে গিয়ে পড়ে। কেউ হয়ত একদিন জাল ফেলে দেখলেন একটা মাছও নেই। কে খেয়েছে, ওই বাঘরোলই খেয়েছে। ওকে একদিন এলাকায় দেখা গিয়েছে। বাঘরোল মাছ খায় নিঃসন্দেহে। কিন্তু মানুষও যে এর মধ্যে জড়িত থাকতে পারেন তা কারও মাথায় আসে না। অনেকে ভাবে বাঘরোল ছাগল চুরি করেছে আমার বাচ্চা নিয়েও চলে যাবে। এসব এখনও মানুষের মনে কাজ করে।” তবে বাঘরোলকে ভয় না পেয়ে ওদের প্রতিও মানুষের সহানুভূতি থাকুক এমনটাই চান বাঘরোলপ্রেমীরা।