বিশ্লেষণ: আমজনতাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে ‘হাড় জ্বালানি’ তেল? কোন পথে সমাধান?
TV9 Bangla Explained: করোনা মহামারীর জেরে কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। সংসারের একমাত্র রোজগেরের বেতন হয়ে গিয়েছে অর্ধেক। তার উপর করোনা চিকিৎসায় কার্যত সর্বস্বান্ত। এর মাঝে জ্বালানি তেল (Petrol and Diesel) কীভাবে মধ্যবিত্তের সংসারে হিসেব নিকেশ পাল্টে দিয়েছে, জানুন
কলকাতা: শুধুই শহর সেঞ্চুরি করবে এটা কাজের কথা নয়। জেলাও যে পারে, চলতি সপ্তাহ থেকে দলে দলে তা দেখিয়ে দিল। কলকাতা থেকে কোচবিহার, সর্বত্র পেট্রোল ছুঁয়েছে ১০০। ডিজেলও পিচ কামড়ে পড়ে রয়েছে। মতলব যেন, লোপ্পা বল পেলেই ছক্কা হাঁকিয়ে সেঞ্চুরি করবে। কিন্তু তাদের এই সেঞ্চুরির দৌড়ে হাঁসফাঁস করছে গ্যালারিতে বসে থাকা আমজনতা। টুকটাক করে মোবাইলে নোটিফেকিশেন ঢুকছে হেডলাইন। লিটার প্রতি দু’টাকা দাম বাড়াল আমূল। আজ পঞ্চাশ পূর্ণ করল পেঁয়াজ। আগামিকাল থেকে ন্যূনতম বাসভাড়া ১৫ টাকা। শুধু হেডলাইনে নেই লকডাউনে বেতন অর্ধেক হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের জীবনযাপন। পেট্রোল একশো টাকা যতটা না চিন্তার বিষয়, নীরবে ডিজেলের (Petrol and Diesel) দাম বৃদ্ধি আরও বেশি অসহনীয় হয়ে উঠেছে মানুষের জীবনযাত্রায়। কীভাবে তা এক সমীক্ষার মাধ্যমে বোঝানো যাক।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্বয়ং ঈশ্বরী পাটনীও এমন বরদান চাইবেন না। আমূল লিটার প্রতি আরও দুই টাকা দাম বাড়িয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় দুগ্ধ উৎপাদন সংস্থা গুজরাট কোঅপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর এস সোধী জানিয়েছেন, এই দাম বাড়ানোর পিছনে পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি অন্যতম কারণ। ডিজেলের দর যে হারে ক্রমবর্ধমান আমূলের পাশাপাশি অন্যান্য দুগ্ধ সংস্থাও দাম বাড়ানোর পক্ষপাতী। শুধুই যে পরিবহণ খরচ এর জন্য দায়ী তা নয়, দুগ্ধ চাষিদের ন্যূনতম আয় বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সংস্থা। তাদের দাবি, ফ্যাট উৎপাদনে গত বছরের তুলনায় ৬ শতাংশ আয় বাড়ানো হয়েছে চাষিদের। সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির জেরে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা। আবার এই মূল্যবৃ্দ্ধি পরোক্ষভাবে নির্ভর করছে জ্বালানি তেলের দরের উপর। যাদের হাতে ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে, বর্ধিত দুধের দামের প্রভাব সেভাবে নাও পড়তে পারে। কিন্তু দিন আনা দিন খাওয়া ঈশ্বরী পাটনীদের মতো পরিবারের সন্তানরা আদৌ দুধে-ভাতে থাকবে কিনা প্রশ্ন থাকছে।
কী বলছে সমীক্ষা?
করোনা মহামারীর জেরে কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। সংসারের একমাত্র রোজগেরের বেতন হয়ে গিয়েছে অর্ধেক। তার উপর করোনা চিকিৎসায় কার্যত সর্বস্বান্ত। এর মাঝে জ্বালানি তেল কীভাবে মধ্যবিত্তের সংসারে হিসেব নিকেশ পাল্টে দিয়েছে ‘লোকালসার্কেল’ নামে এক জরিপ সংস্থার তথ্যে প্রমাণ। ওই সংস্থা গত ফেব্রুয়ারিতে ২৯১ জেলায় ২২ হাজার মানুষের মতামত নিয়ে জানাচ্ছে, শুধুমাত্র জ্বালানি তেলের দামের জন্য ৫১ শতাংশ মানুষ সংসারের ব্যয় কমিয়েছেন। ২১ শতাংশ মানুষ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসই সেভাবে কিনছেন না। আর জমানো সঞ্চয় ভেঙে জীবনধারণ করছেন ১৪ শতাংশ মানুষ। অন্য দিকে, লকডাউনের জেরে আরও একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। ওই সংস্থার সমীক্ষা বলছে, কারখানা-অফিস বন্ধ থাকায় ৪৩ শতাংশ মানুষের মাসিক জ্বালানি তেলের খরচ কম গিয়েছে। তবে, ডিজেলের দাম বৃদ্ধি জেরে পরোক্ষ ভাবে সমাজের সবস্তরের মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়েছে। আরও পড়ুন- বিশ্লেষণ: সরষের ভেতরেই ভূত! ১ বছরে রান্নার তেলের দাম বাড়ল ৬৩ টাকা, কীভাবে?
গত মার্চে ২৫ শতাংশ ফ্রেট রেট বাড়িয়েছে অল ইন্ডিয়া ট্রান্সপোর্টার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির জেরেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে বলে দাবি এআইটিডব্লিউএ-র। ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান প্রদীপ সিঙ্ঘল জানিয়েছেন, ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ডিজেলের দাম বেড়েছে। যার ফলে পরিবহণ খরচও বৃদ্ধি হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে একটা বড় সময়ের চুক্তি হয়ে থাকে। কিন্তু যে হারে ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে সবথেকে বেশি ব্যাহত হচ্ছে লজিস্টিক পরিষেবা। বাধ্য হয়েই ফ্রেট রেট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এআইটিডব্লিউএ-র দাবি, অভিন্ন ডিজেলের দাম হওয়া উচিত দেশে। বিভিন্ন রাজ্যে ডিজেলের দাম নানা রকম হওয়ায় পরিবহণ খরচ বেড়ে যায়। এই ফ্রেট রেট বৃদ্ধির জেরে আরও চড়া হয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। আরও পড়ুন- বিশ্লেষণ: ভেনেজুয়েলায় ১ টাকায় পেট্রোল, ভারতে ১০২! নেপথ্যে কার কারসাজি?
কোন পথে লাগাম?
বিশ্ববাজারের উপর পেট্রোল-ডিজেলের দাম নির্ভর করলেও, কেন্দ্র ও রাজ্যের মোটা অঙ্কের কর আদায়ের ফলে লাগামছাড়া জ্বালানি তেল। এ কথা মানলেও পরস্পরে কোর্টে বল ঠেলাঠেলি করছে কেন্দ্র ও রাজ্য। প্রাক্তন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান তো জানিয়ে দেন, জ্বালানি তেলের উপর যে কর নেওয়া হচ্ছে, তার অধিকাংশটাই মহামারীর ক্ষত মেটাতে। দেশহিতে কাজে লাগানো হচ্ছে এই কর। তাতে আমজনতার আদৌ কোনও সুরাহা হচ্ছে না বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাহলে কীভাবে লাগাম টানা যায়?
১) কেন্দ্র ও রাজ্যের আলোচনা- করোনা মহামারীতে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা একধাক্কায় কমেছে। পেট্রোপণ্যের শুল্কে ছাড় দিয়ে আমজনতাকে রেহাই দিতে পারে সরকার। রাজ্য ও কেন্দ্রের আলোচনা সাপেক্ষে কর ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মত বিশেষজ্ঞদের। উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ জ্বালানি তেলে এক টাকা সেস কমিয়ে কেন্দ্রকে কর কমানোর দাবি জানায়। এই কর থেকে রাজ্যই বেশি আয় করে বলে পাল্টা তোপ দাগে কেন্দ্র। কেন্দ্র ও রাজ্যের এই দড়ি টানাটানিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। বর্তমান পরিস্থিতির কথা ভেবে কেন্দ্র ও রাজ্যের আলোচনা জরুরি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
২) বিকল্প শক্তি- বৈদ্যুতিন গাড়ি কেনার উপর জোর দিতে পারে সরকার। রাস্তায় আরও নামাতে হবে সিএনজি (কমপ্রেসড নেচারাল গ্যাস) চালিত গাড়ি। গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থাকে নানা রকম ছাড় দিয়ে সিএনজি গাড়িতে উৎসাহ বাড়ানো প্রয়োজন। সৌর ও অপ্রচলিত শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুতের ঘাটতি কমানো যেতে পারে। কিন্তু বিকল্প শক্তির উপর কেন্দ্র জোর দিলেও কতদিনে চাহিদা মেটানো সম্ভব তাতে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।
৩) যান-যন্ত্রণা- দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরু ও কলকাতা এই চার শহরে যানজটের জেরে যা জ্বালানি খরচ হয়, একটা গোটা রেল বাজেট হয়ে যেতে পারে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। শুধুমাত্র দিল্লিতে ৯৬০ কোটি ডলার জ্বালানি খরচ হয়ে যানজটের পাকেচক্রে। যা জিডিপির প্রায় ১২ শতাংশ। মুম্বইয়ে ৪৮০ কোটি ডলার, বেঙ্গালুরুতে ৫৯২ কোটি ডলার এবং কলকাতায় ১৯৭ ডলার জ্বালানি খরচ হয়।
এছাড়া আমজনতাকে স্বস্তি দিতে আয়কর, জিএসটি-র মতো প্রত্যক্ষ করে কেন্দ্রের আরও জোর দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী একটি নির্দিষ্ট স্তরের মানুষের থেকে রাজস্ব আদায় করে সরকার। কিন্তু পরোক্ষ করে সার্বিকভাবে মানুষের উপর প্রভাব পড়ে। লকডাউন জেরে কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। আয়কর দেওয়ার মতো স্তরে না থাকলেও বিভিন্ন ভাবে পরোক্ষ কর দিতে হচ্ছে তাদের। একে করোনা, দোসর মূলবৃদ্ধি। অভূতপূর্ব এই পরিস্থিতিতে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আমজনতা। খাদের কিনারা থেকে আমজনতাকে মূলস্রোতে ফেরাতে অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের প্রয়োজন এখন সরকারের।