ভয় করো-না: একান্তবাসেও আপনি একা নন, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে নেট-নাগরিকরা

যে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর এতকাল দায় বর্তেছে ফেক খবরের। তথ্যের জন্য আজ যেন সেই ছাতার তলাতেই সকলে।

ভয় করো-না: একান্তবাসেও আপনি একা নন, দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে নেট-নাগরিকরা
গ্রাফিক্স: অভীক দেবনাথ।
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Apr 30, 2021 | 9:12 PM

কলকাতা: রিপোর্ট পজেটিভ। এই খবর শুনেই মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে ঋষভের (নাম পরিবর্তিত)। ছোট্ট একটি ঘর, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মা। তাঁদেরও পজেটিভ (COVID Positive) হওয়া সময়ের অপেক্ষা। ঋষভের মনে হতে লাগল, তাঁর পায়ের নীচের এক টুকরো জমি এ পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ততক্ষণে পাড়ার লোকরা জেনে গিয়েছে। বাড়ি থেকে না বেরনোর কিছু হুমকিও এসেছে ‘পাড়ার দাদাদের’ কাছ থেকে। একান্তবাস অপরিহার্য, ঋষভ জানে। কিন্তু প্রয়োজনীয় খাবার, ওষুধপত্র এমনকী যদি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় কীভাবে মিলবে? সে দিন তার কুল কিনারা করতে পারেনি ঋষভ। সমাজের মধ্যে এক ঘরে হয়ে পড়া ঋষভের কাছে একমাত্র পথ খোলা ছিল সোশ্যাল মিডিয়া। এই মহামারী আবহে ভার্চুয়াল জগতও বাস্তবের চাহিদা মেটাতে পারে, এ ক’দিন একান্তবাসে থেকে নিদারুণ ভাবে বুঝেছে ঋষভ। কারোর অক্সিজেন লাগবে, কোথায় পাওয়া যাবে ভেন্টিলেটর বেড, বি পজেটিভ প্লাজমা দরকার, এমন নানা আর্তির সমাধানে নেমেছেন নেট নাগরিকরা। ঋষভের মতো একান্তবাসে থাকা বহু মানুষের একাকীত্মের সঙ্গী হয়ে উঠেছেন তাঁরা। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ঋষভের ছোটো পাড়ার গণ্ডি পেরিয়ে এক বিশাল সমাজ তার পাশে দাঁড়িয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছেন অভিনেতা-সমাজকর্মী-রাজনীতিবিদরাও। যে যাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা। যে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর এতকাল দায় বর্তেছে ফেক খবরের। তথ্যের জন্য আজ যেন সেই ছাতার তলাতেই সকলে।

আরও পড়ুন: শুটিংয়ের ভবিষ্যৎ কী? কোভিড রুখতে কড়া নিয়ম আনার ভাবনায় ই-মেল ফেডারেশনের

বাঘাযতীনে অক্সিজেন লাগবে, বালির করোনা আক্রান্তের জন্য খাবার। রাষ্ট্র তার মতো করে কাজ করুক, যেন আড়াআড়ি আরেকটা পরিকাঠামো গড়ে তুলেছেন সাধারণ মানুষ। ধরুন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কথা। ফেসবুকে তাঁর শেষ পোস্টে সহজে করোনা পরীক্ষার একটি তথ্য তুলে ধরেছেন। আসা যাক জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্য়ায়ের ফেসবুক ওয়ালে, যতই স্ক্রল করা যায় দেখা যাবে শুধুই করোনা আক্রান্ত বা এই পরিস্থিতিতে যাঁরা অসহায় তাঁদের সাহায্যের চেষ্টা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে তাঁদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা। যদি রাজনীতিবিদদের ওয়াল দেখা যায় সেখানেও একই প্রতিফলন। বালির প্রার্থী দীপ্সিতা ধর ‘রেড ভলেয়িন্টার্সদের’ কর্মকাণ্ডের কথা লিখেছেন। সকলকে সাহায্য করার যথাসম্ভব চেষ্টা করে গিয়েছেন। শাসক দলের প্রার্থী রাজ চক্রবর্তীর ওয়ালেও কার্যত একই কথা। একই কথা বিজেপি সমর্থক অভিনেত্রী রূপা ভট্টাচার্যের ওয়ালেও। অর্থাৎ সকলে একযোগে চাইছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে তথ্য যত দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে। তাতে মানুষ উপকৃত হচ্ছেন আর বাঁচছে প্রাণ।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেক নিউজ ছড়ায়। সেই নিয়ে বিশাল তর্ক বাধে। সমালোচনা, মন্তব্যের কাটাছেঁড়া, নীতিপুলিশি সব হয়। মহামারী জানাল, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রয়োজনীয় তথ্যও ছড়ায়। যা মানুষের প্রাণ বাঁচায়। লাগাতার রেড ভলেন্টিয়ার্সদের কাজের প্রচার করছেন দীপ্সিতা, সৃজন, ঐশীরা। সোশ্যাল মিডিয়া তাঁদের কতটা কাজে লাগছে? আর সর্বোপরি সবে মিলে কাজ করে মানুষের কাছে কত তাড়াতাড়ি সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে? এ বিষয়ে জেনেইউর ছাত্রনেত্রী তথা জামুড়িয়ার সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী ঐশী ঘোষ অভিযোগ করেন সরকার নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তিনি বলেন, “পরশু থেকে হাজার হাজার কল পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কটাক্ষ করছেন কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। সরকারে থাকলে আমরা পরিকাঠামো দিতে পারতাম। এখন তথ্য দিতে পারছি। কোথায় বেড খালি হচ্ছে তা জানাতে পারছি। এতে উপকার হচ্ছে।”

একই কথা সিঙ্গুরের সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যেরও। তিনি বলেন, “যতই মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা করা হোক না কেন, সাধারণ মানুষ যেভাবে এগিয়ে আসছেন তা আশান্বিত হওয়ার মতোই। মানুষ যে এক হয়ে থাকতে চায় এবং সঙ্কটে হাত বাড়িয়ে দিতে চায়, তারই প্রতিফলন এটি।”

দীপ্সিতা ধরের কথায়, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, কিন্তু তাতে লড়াইটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সেখানে সরকারি হস্তক্ষেপ না থাকলে লড়াইটা আরও কঠিন হয়ে যাবে। রাজনীতির রঙ দূরে সরিয়ে রেখে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা বিজেপি সমর্থক অভিনেত্রী রূপা ভট্টাচার্যেরও গলায়।

তিনি বলেন, “এই খারাপ অবস্থাতে সবচেয়ে ভাল খবর হল মানুষ আবার মানুষ হয়েছে। এই প্রথম পরিচিত অপরিচিত নির্বিশেষে মানুষ আবার মানুষ হল। প্রত্যেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর চেষ্টা করছেন।

” তৃণমূলের প্রার্থী পরিচালক রাজ চক্রবর্তীও ফেসবুকের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন। তিনি আগেই জানিয়েছেন, মানুষকে যথাসম্ভব উপকার করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অভিনয় জগতের ব্যক্তিত্বরাও মিনিটে মিনিটে সোশ্যাল মিডিয়ায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এই নিয়ে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাফ জানান, এই কৃতিত্ব সাধারণ মানুষের। তারাই লড়াইটা লড়ছেন।

অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীরও একই মত। তিনি বলেন, “এটাই তো কাম্য। এই পরিস্থিতিতে সবাই সবার পাশে থাকবে। এগিয়ে আসবে। আমি যেখান থেকে যা পেয়েছি শেয়ার করছি। যদি কিছু মানুষ উপকৃত হন। এর চেয়ে ভাল তো কিছু হতে পারে না। যাঁদের এই সময় পাশে থাকার কথা তাঁরা যদি না থাকেন সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসছেন।”

অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “রক্ত, প্লাজমা, অক্সিজেন, খাবার এইসব মিলিয়ে অগণিতদের আমাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে উপকার করা গিয়েছে। প্রথম দিনই ৩ ঘণ্টায় আমরা ৪০ জনকে উপকার করতে পেরেছি। গত বছরও প্রথম ঢেউয়ে যখন মানুষের অর্থের অভাব হয়েছিল তখনও ফেসবুকের মাধ্যমে অর্থ জোগাতে হয়েছিল। তবে এখান থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে কেন্দ্র ও রাজ্যের যে স্বাস্থ্য দফতর তা ভেঙে চুরমার হয়ে মাটির নীচে ঢুকে গিয়েছে। কোনও দলের কোনও হেল্পলাইন নেই, তাই অসহায় হয়ে সাধারণ মানুষ চেষ্টা করছে।”