Mahalaya 2022: ‘দাদুর পুরনো মারফি রেডিওটাকে সারিয়ে দিলে রেখে দিতাম আজও…’, মহালয়ায় স্মৃতিচারণ আরজে-অভিনেতা সোমকের
Mahalaya 2022: মহালয়ায় স্মৃতিচারণ আরজে-অভিনেতা সোমকের। হলুদ রঙের মারফি রেডিয়ো, ডিজিটাল যুগ, নস্টালজিয়া... টিভিনাইন বাংলা সাক্ষী থাকল এ সবের।
সোমক ঘোষ
আজকালকার টিনএজাররা ‘মারফি’ রেডিও চিনতে পারবে কিনা আমি জানি না, তবে এমন এক ‘মারফি রেডিও’ আমি দেখেছি। আমার মামাবাড়ি সোনারপুর। আরও বিশদে বললে, সোনারপুরের রাজপুর এলাকায়। আমার মায়ের মেজজেঠুর এক ‘মারফি রেডিও’ ছিল। মোটামুটি এক টিভির আয়তনের হলুদ রঙের রেডিয়ো। হাতেগুণে দু’ থেকে তিনটে স্টেশন শোনা যেত ওই রেডিয়ো থেকে। তবে রেডিয়োটার একটা ইতিহাস ছিল। চিন যুদ্ধের খবর থেকে শুরু করে নানা খবরের সাক্ষী ওই রেডিয়ো। সে যাই-ই হোক, ছোটবেলার এক আবছা হয়ে যাওয়া স্মৃতিই লিখতে এলাম। আবছা হলেও এখনও মনে আছে। তবে সত্যি বলতে কতদিন মনে থাকবে, তা জানি না।
মহালয়ার আগের দিন পৌঁছে যেতাম মামাবাড়ি। মহালয়ার ঠিক আগের দিন আমার ওই মেজদাদু রেডিয়োটাকে একটু রোদেটোদে দিয়ে, নিজেই স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে রেডিয়োটাকে খুলে কী সব যেন করে ওই ‘আকাশবাণী’ স্টেশনটাকে নিয়ে আসতেন। ভোরবেলা মেজদাদুর ঘরে বসে মহালয়া শোনা হতো। তখন গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের এতটা দাপট ছিল না—তাই মহালয়ার ভোরে একটু হলেও ঠান্ডা লাগত। রেডিয়ো বাজত, আর আমরা রেডিয়ো ঘিরে বসে থাকতাম। আমরা বলতে আমি আর আমার তিন জন কাজ়িন (তুতো ভাই-বোন)। চোখে ঘুম, ভাইবোনেরা প্রায় ঢুলে পড়ছি। ওইদিকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুরু হচ্ছে। প্রথম দশ মিনিটের পর মাঝেমাঝেই চোখ লেগে যাচ্ছে। মা ঠেলা দিচ্ছে, উঠতে বলছে। প্রথম এক ঘণ্টা কোনওভাবে জেগে থেকে তারপর ঘুমিয়েই পড়তাম। কসবায় যে বাড়িতে আমি বড় হয়েছি, সেখানে ট্রান্সজ়িস্টার রেডিয়ো প্রথম আসে সম্ভবত ১৯৯৬ সালে। তিন-চারটে অনুষ্ঠান মা শুনতেন। তখন থেকেই ভোর ৪টের সময় অ্যালার্ম দিয়ে শোনা হতো মহালয়া। বয়স তখন খুবই কম। বাবা-মায়ের সঙ্গেই শুতাম। আর সেই রেডিয়োটা রাখা থাকত বিছানার ঠিক পাশেই। তারপর এই ট্র্যাডিশন চলল বহু বছর।
তারপর একদিন জানতে পারলাম, সালটা বোধহয় ২০০৬ অথবা ২০০৭—স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে গিয়েছি—জানতে পারলাম, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র নাকি সিডি বের হচ্ছে। খুব উত্তেজিত হয়ে ছুটলাম গোলপার্কের খুব বিখ্যাত এক মিউজিক স্টোরে—স্টোরটা এখন নেই। কিনে আনলাম দু’ ভলিউম সিডি। সিডি আনার পর একটা ব্যাপার হল। মনে হল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনার জন্য আর ভোর চারটের অপেক্ষা করতে হবে না। নিজের সময় মতো, নিজের ইচ্ছে মতো যখন ইচ্ছে সিডি চালিয়েই শুনতে পারব। তবে এটা করতে গিয়ে যেটা দেখলাম ওই যে… চারটের সময় ওঠার যে একটা রীতি ছিল, রীতিমতো একটা দায়িত্ব ছিল, সেইটা না কোথাও গিয়ে হালকা হয়ে গেল। এরপর তো এল ইউটিউবের জমানা… বাকিটা তো আমরা সকলেই জানি। এখন যখন তখন যেখানে-সেখানে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনা যায়। অনেক প্যান্ডেলে বা অনেক সিগন্যালে তা বাজানোও হয়। সেটা ভাল বা খারাপ সে বিতর্কে যাচ্ছি না। তবে জিনিসটার যে একটা স্যাংটিটি (শুচিতা) ছিল, যা নাকি মহালয়ার সকালে ৪টের সময়েই শোনা যাবে, সেটা হয়তো হালকা হয়ে গিয়েছে এই ডিজিটাল যুগের দৌলতে। পাশাপাশি এটাও ঠিক এখন বহু মানুষ, অ্যালার্ম দিয়ে ভোরবেলা উঠবেন—সেটা শুনে দিন শুরু করবেন। আসলে মহালয়ার দিন মানুষের রেডিয়ো প্রেমটা আরও বেশি করে জেগে ওঠে। আমার খুবই একটা গর্বের বিষয় আমি সেই মাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে আছি, যে মাধ্যমটার হাত ধরে বছরের পর বছর বাঙালির কাছে পুজো আসে। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০-র মধ্যে আমরা যারা জন্মেছি, তাদেরকে ‘আর্লি মিলেনিয়াল’ বলা যায়—আমরা টেকনোলজির পরিবর্তনটা দেখেছি। আমি যেমন এক দাদুর বাড়িতে গ্রামোফোনও দেখেছি, আবার এখন দেখছি এমন এক ডিভাইস যে ভয়েস কমান্ড-এর মাধ্যমে গান বাজিয়ে দিতে পারে। তবে এখনও মনে হয়, ওই সেই হলুদ রঙের পুরনো ‘মারফি রেডিও’টা যদি আমায় আজও কেউ সারিয়ে দিত, তাহলে সেটাকে আমি সযত্নে বাড়িতে রাখতাম। গাছ ততটাই বড় হবে, যার শিকড় যতটা গভীর হবে। আর মেজদাদুর ওই ‘মারফি রেডিও’টা আমার সেই শিকড়।