Exclusive: ‘পাশে বসে অপুকে কাঁদতে দেখেছি…’, কেন বললেন শাশ্বতর স্ত্রী মহুয়া?
Mahua Chatterjee: অবসরে কি কখনও শাশ্বতর এই লড়াই তাঁকে কাঁদায় না? TV9 বাংলার কাছে মনের কথা উজার করে দিলেন অভিনেতার স্ত্রী মহুয়া চট্টোপাধ্যায় (তিনিই কলকাতায় অভিনেতার কাজের সমস্ত বিষয়টা দেখেন)।
জয়িতা চন্দ্র
সাল ১৯৯৬, সমরেশ মজুমদারের ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসের অবলম্বনে তৈরি ধারাবাহিকের হাত ধরে প্রথম পর্দায় পা রেখেছিলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। তবে ভাগ্য খুলেছিল সন্দীপ রায়ের তোপসের চরিত্রে। টলিউড আবিষ্কার করেছিল এক নতুন অভিনেতাকে। মধ্যবিত্ত বাঙালির ছাপ তাঁর চোখে মুখে। স্বপ্নের নায়ক তিনি ছিলেন না কোনওদিনই। তিনি জাত অভিনেতা। তবে তাঁর মান কি যথা সময় দিয়ে উঠতে পেড়েছে টলিউড? কল্কি 2898 AD-তে শাশ্বতর দাপট দেখে কখনও কি মনের কোণে এ প্রশ্ন উঁকি দেয় না? না, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এই নিয়ে খুব একটা আক্ষেপ করেন না। কিন্তু তাঁর সহধর্মিণী? যিনি দীর্ঘদিন ধরে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের এই লড়াইয়ের সাক্ষী-সঙ্গী, তিনি? অবসরে কি কখনও শাশ্বতর এই লড়াই তাঁকে কাঁদায় না? TV9 বাংলার কাছে মনের কথা উজার করে দিলেন অভিনেতার স্ত্রী মহুয়া চট্টোপাধ্যায় (তিনিই কলকাতায় অভিনেতার কাজের সমস্ত বিষয়টা দেখেন)।
মাত্র তিন দিনেই ৫০০ কোটির ব্যবসা, কেমন লাগল কল্কি?
কল্কি তো একটা বিশাল মানের প্রজেক্ট। খুব ভাল লেগেছে। এমন একটা ভারতীয় ছবিও যে হতে পারে তা আমরা ভাবতেও পারি না। আমি আর আমার মেয়ে ওর (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) কাছে সব থেকে বড় সমালোচক। আমরা ছবি দেখে এসে একেবারে সত্যিটাই তুলে ধরি। ‘এই লুকটা আমাদের ভাল লাগেনি’, ‘এই ছবির প্রথমটা এমন হয়েছে’, ‘এই জায়গাটা এমন হতে পারত’, যেটা ঠিক সেটাই বলি। আবার যেটা খুব ভাললাগে, সেটাও মন খুলে বলি, দারুণ-দারুণ-দারুণ। যেমন কল্কি, অনবদ্য।
বাংলা থেকে দক্ষিণে, বলিউডে কাজ হয়তো অনেকেই করছেন, তবে হাতে গোনা কয়েকটি প্রজেক্টে এতটা কাজ দেখানোর সুযোগ পেয়ে থাকেন অভিনেতারা…ক’জন জানতেন ‘মানস’ এত বড় প্রজেক্ট?
আমরাও খুব অবাক হয়েছিলাম। আমার কাছেই মূলত ওর কাজের ফোনগুলো আসে। একদিন হঠাৎ আমি ফোন পাই। উল্টোদিক থেকে বলা হল ‘আমরা বৈজন্তী মুভিস’, তাঁরা যে এক বড় প্রযোজনা সংস্থা আমার কোনও ধারণাই ছিল না। ফোনের ওপার থেকে বলা হল, ‘প্রজেক্ট কে’ ছবির একটি বিশেষ চরিত্রের জন্যে পরিচালক শাশ্বতকে চাইছেন। আমি তখনই সেটা শাশ্বতর মুম্বইয়ের ম্যানেজারের কাছে পাঠাই। নাগ অশ্বিনের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা হয়। অপুরও (শাশ্বত-র ডাক নাম) চরিত্রটা বেশ পছন্দ হওয়ায়, কাজ শুরু হয়। নাগ অশ্বিন নাকি অপুর অনেক কাজ দেখেছেন। ছবিতে ‘মানস’ চরিত্র, যে কামাল হাসানের ডান হাত, সেই চরিত্রে অপুকে চায়। আমরা তখন ভাবি ‘দক্ষিণের একটি প্রজেক্ট, অপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আছে, সেটা আর কত বড় হবে’। এরপর যখন শুটিং শুরু হয়, তখন দেখছি তারিখ বাড়তে থাকে। ওরা প্রাথমিকভাবে যে কথা বলেছিল, তার থেকে অনেক বেশিদিন ধরে শুট চলে। কাজ করতে করতে শাশ্বত নাকি সকলের নজরে এতটাই কেড়েছিল, যে দিন দিন ওর চরিত্রটা বাড়তে থাকে, সেটা নিয়ে নতুন করে কাজ হতে থাকে। ছবির শুট যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন আমরা জানতে পারি, বিরতির পর, মানে ছবির দ্বিতীয়ভাগে মূলত খলনায়ক ওই, তাই ওর চরিত্রটা অনেক বড় হয়ে যায়।
দীপিকা-প্রভাসের সঙ্গে কাজ করা নিয়ে বাড়িতে কোনও গল্প বলেন না?
না, সেভাবে কোনও কথা হয় না। কথায় কথায় মাঝে মাঝে কথা প্রসঙ্গে উঠলে বলে, দীপিকা খুব ভাল মেয়ে। প্রভাসের মনটা খুব ভাল। দীপিকা যখন শুনেছিলেন যে আমাদের মেয়ে ওর খুব ভক্ত, তখন দীপিকা ওর একটি সাদা কালো ছবিতে অটোগ্রাফ করে শাশ্বতর ভ্যানিটি ভ্যানে রেখে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মেয়েকে দিতে। তবে অমিতাভের সঙ্গে ওর কোনও শুটিং শিডিউল ছিল না।
দক্ষিণের এই ‘মানস’, বলিউডের ‘ট্রুটি-ফ্রুটি’-‘বব বিশ্বাস’কে কি টলিউড একটু দেরীতে আবিষ্কার করল?
দেখুন, এই প্রশ্নের দুটো উত্তর হয়। আমি যদি অপুর হয়ে উত্তর দিতে যাই, তবে অপু বলত, ‘আমি যেটা পেয়েছি, আমি অনেক পেয়েছি। ভাগ্যে যখন যেটা পাওয়ার, সেটাই তো পাব’। আর আমি স্ত্রী হিসেবে বলতে পারি, ওর যখন অল্প বয়স ছিল, ওকে নিয়ে আরও ভাবা উচিত ছিল। ও তো আর আজ অভিনয়ে আসেনি। আপনি যদি ওর ‘এক আকাশের নীচে’ দেখেন, ‘রূপকথা’ দেখেন, তখন ওর আলাদা একটা চার্ম ছিল। ‘এটা আমাদের গল্প’-তে এসেও সেটা বাঙালিদের মন ছুঁয়ে যায়, তার মানে নিশ্চয়ই ওর মধ্যে কিছু একটা ছিল।
দর্শকের কাছে বব বিশ্বাস শাশ্বত, কিন্তু পর্দায় পরবর্তীতে পাওয়া গেল অভিষেককে। শাশ্বতদার এই নিয়ে মন্তব্য আমরা শুনেছি, তবে সবার আড়ালে আপনার কাছে কখনও খারাপ লাগার কথা বলেছেন?
এটা ওর সঙ্গে প্রথম ঘটেছে, এমন নয়। আমরা সবাই জানতাম ‘বব বিশ্বাস’ ওই করছে। আমাদের জানানোই হয়নি যে এটা অন্য কারও হাত চলে গিয়েছে। অপু বলে, ‘পরিচালক যাঁকে ঠিক মনে করেছেন, প্রযোজক যাঁকে ভাল ভেবেছেন, তাঁকে নিয়েছেন।’ যেমন বাংলায় এখন একটা সিরিজ চলছে, যেটা নিয়ে অনেকবার ওকে গল্প শোনানো হয়েছিল। পরে শুনলাম, ওটা অন্যকেউ করছেন। ও না কখনও এগুলো নিয়ে ভাবে না, ‘ও মা আমার হল না’, ‘আমায় দিল না’, বলে আক্ষেপ করে না। ও সব সময় বলে, ‘আমিই তো বব বিশ্বাস। যে দ্বিতীয়বার হয়েছেন, তিনি তো আমার চরিত্রকে নিয়ে এগিয়েছেন।’ এই যেমন করণ জোহরের ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’, সেখানে মিস্টার চ্যাটার্জি (পর্দায় আলিয়া ভাটের বাবা)-র চরিত্রটা তো ওর কাছে এসেছিল। ও হাত জোর করে বলেছিল, ‘দেখুন আমি সব পারব, কিন্তু নাচটা পারব না। আমি প্রযোজককে ঠকাতে পারব না। পারি বলে ঢুকব, পরবর্তীতে প্রযোজককে বিপদে ফেলব, এটা আমি চাই না। আমায় ক্ষমা করবেন।’
এত বড়-বড় চরিত্র শাশ্বতর ঝুলিতে, তাও সেভাবে লাইম লাইটে কেন নেই?
এমন অনেক ছবি দেখেছি আমি, যেখানে ও হয়তো একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করছে, কিন্তু অন্য চরিত্রগুলোকে বেশি হাইলাইট করা হচ্ছে ওর থেকে। ও এগুলো গায়ে মাখে না। তবে কোথাও গিয়ে যেন আমার খারাপ লাগে। ও কেন্দ্রীয় চরিত্র, কিন্তু ওকে গুরুত্ব না দিয়ে অন্যদের নিয়ে এত মাতামাতি। অন্যদের নিয়েও করুক। করবে না কেন? তবে ওকে নামিয়ে নয়। আমার ভাল লাগে না। কষ্ট হয় তো বটেই।
শাশ্বত তো নিজেরটা ফলাও করে বলতেও পছন্দ করেন না, ফলে অনেকেই অনেক কিছু জানতে পারে না…
ও সেভাবে নিজের কোনও বিজ্ঞাপন পছন্দ করে না। লকডাউনের পর ফোনটা নেয়। আর এখন বাইরে কাজ হচ্ছে বেশি, সেটার জন্য রাখছে। এই যেমন একদিন সেটে রণবীর সিং এসেছিলেন। দীপিকা অন্তঃসত্ত্বা, ফলে উনি এসেছিলেন। তখন শাশ্বতর সঙ্গে দেখা। ও কথা বলতে গেলে রণবীর ওকে নাকি বলেছিলেন, ‘দাদা, আপনাকে কে না চেনে…।’ আমি বলি, একটা ছবি তুলতে পার না? হাসতে হাসতে বলে, ‘সবাই তো কস্টিউমে থাকে, আমি ওভাবে বলতে পারি না। এটা ঠিক দেখায় না। আর পরে গিয়ে ছবি তুলব, ওটা আমার আসে না।’
ভাল কাজ মানেই তো দাম ভাল। কল্কির পর কি কলকাতায় শাশ্বতর পারিশ্রমিক বাড়ছে?
না-না। একদমই নয়। ওই দিকটা তো আমিই দেখি। ও একেবারেই ভাবতে চায় না। ও ভাবলে আজ হয়তো মুম্বইতে সমুদ্র সৈকতের ধারে আমাদের একটা বাংলো থাকত। ও উল্টে বলে, বাংলা ইন্ডাস্ট্রি অনেক ছোট। ওদের মতো বড় বাজেটের ছবির সামর্থ কোথায় আমাদের? সেটা তো ভাবতে হবে। একটা বিশাল অঙ্কের টাকা যদি একজন অভিনেতা চেয়ে বসেন, তবে কাজটা হবে কীভাবে? প্রযোজককে শুধু শুধু বিপদে ফেলা। এক এক জনের এক এক রকম বিশ্বাস। ও সত্যি ভাল চরিত্রের খিদেতে ছটফট করে, টাকা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই।
বলিউড, দক্ষিণ পেড়িয়ে এবার তো শাশ্বত বাংলাদেশে…
হম, ও এখন বাংলাদেশে। ওখানে একটা ওয়েব সিরিজের শুট করছে। ওখানেও বেশ যত্ন পাচ্ছে। একটা ছবি দেখলাম, অনেকেই ওকে ঘিরে রয়েছে। ছয়-সাতজন দেখলাম বিমানবন্দর থেকেই আগলে রেখেছে।
শাশ্বত তো খেতে পছন্দ করেন, স্টার মানেই তো ডায়েট, সেখানে কি কোনও বদল এল?
আরে না না। ও শরীরচর্চা করে না। আর এটা সত্যি যে ও খেতে পছন্দ করে। আমরা মাঝে মধ্যে বাইরের খাবারও খাই। তবে শাশ্বত এখন সেদিকটা একটু নজরে রেখেছে। খুব বেশি খায় না। খায় সবই, তবে এখন খুব অল্প পরিমাণে। অনেক ধরনের কাজ তো আসছে। তাই এবার একটু নজর দিচ্ছে শরীরের দিকে। তার মানে কড়া ডায়েট এমন একেবারেই নয়।
শাশ্বত আজ ভারতীয় ছবিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, আপনিও জড়িত (শাশ্বতর ছবির নানা বিষয় খেয়াল রাখেন মহুয়া নিজেই), মেয়ে যদি আসতে চায়?
আমি খুব সাপোর্ট করব বিশ্বাস করুন। তবে সব কিছুরই তো শিক্ষা লাগে। অনেকে মনে করেন অভিনয়টা খুব সহজ। আদপে নয়। সুযোগ পাওয়া, টিকে থাকা, সবকিছুর আগে অভিনয়টা জানা, এগুলো না থাকলে খুব মুশকিল। তাই সেই মতো ওকেও তৈরি করা। অপুও বলে, শিক্ষাটা জরুরী। শিখে আসতে হবে। তালিম তো লাগবে, আগে ভিত তৈরি করতে হবে। নয়তো এমন অনেককেই দেখবেন, একটা সিরিয়াল, একটা কাজের পর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা চাই না আমি। মেয়েও তেমনই ট্রেনিং নিচ্ছে। দেখা যাক ও আবার কতটা কী করতে পারে।
শাশ্বতর সঙ্গে তো আপনি সংসার পেতেছেন, বাড়ির চার দেওয়ালে মানুষটা কি অচেনা?
না, না। খুব স্বচ্ছ। যেটা আপনারা দেখেন, সেটাই ও। কিছু ভাল না লাগলে বিরক্ত প্রকাশ করে। খুশি হলে সেটাও মন খুলে বলে। কোনও আবেগঘন মুহূর্তে কেঁদেই চলেছে। বাড়িতে থাকলে একেবারে শান্ত। একটা রিক্লাইনার আছে, ব্রেকফাস্ট করে সেখানে গিয়ে বসে পড়ে। ব্যস। এরপর খেলা, সিনেমা নিয়ে বসে থেকে রাত গড়িয়ে দেয়। ওর মধ্যে স্টার ব্যপারটাই নেই। ওর ম্যানেজাররা বলে, এমন হতে হবে, তেমনটা করতে হবে, ও এসবের মধ্যে নেই। ওর একটা স্পটবয় থাকে, ব্যস, ওইটুকুই। মুখোশ পরা বিষয়টা অপুর নেই।