Tarun Majumdar Obituary: সিনেমাকে গোষ্ঠীবদ্ধ না করে মেলে ধরেছিলেন সব ধরনের দর্শকের জন্য
Tarun Majumdar Obituary: আরও কাজ করতে চেয়েছিলেন... আরও একটা 'বাড়ি' হয়তো ছিল কোথাও তাঁর!
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, আগের প্রজন্ম অথবা তারও আগের প্রজন্মের দাদু-ঠাকুমার জেনারেশন—একইভাবে দেখেছেন মানুষটাকে। কোনওদিনও, কোনও অছিলাতেও, নিজের ভাবমূর্তির এতটুকু পাল্টে ফেলেননি তরুণ মজুমদার। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্য, সর্বোপরি সততা… দোসর হিসেবে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিলেন বাঙালির জাতীয় পোশাক সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। বুক পকেটে একটা কলম। মাথায় অল্প টাক। চোখে কালো ফ্রেমের হাইপাওয়ার চশমা। ছোটখাটো চেহারা। ঠোঁটের উপর পাতলা গোঁফের রেখা। বইয়ের মধ্যে ডুবে অবসর কাটাতেন। কিংবা অবসরেই খুঁজে নিতেন নতুন ছবির প্লট।
সাহিত্যকে অবলম্বন করে এগিয়ে গিয়েছেন আজীবন। তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণেও বারবার ফিরে এসেছে সাহিত্যের চরিত্ররাই। একের পর এক কালজয়ী ছবি উপহার দিয়েছেন বাঙালি দর্শককে। কোনওদিনও মুখ ফুটে বলেননি ‘আমার ছবিটার পাশে এসে দাঁড়ান’। দর্শকই বরং তাঁর নাম শুনে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ২০১৮ সালে যখন ‘ভালবাসার বাড়ি’ মুক্তি পেল, প্রেক্ষাগৃহে সে কী লম্বা লাইন! দর্শক সারি বেঁধে দেখতে গিয়েছিল প্রিয় তরুণবাবুর ‘ভালবাসার বাড়ি’। ছবি মুক্তির ১০ বছর আগে মুক্তি পায় তাঁর আরও এক বাড়ির গল্প—’চাঁদের বাড়ি’। সরল, সাধারণ, বাস্তব ধারার চিত্রনাট্য নির্মাণ করেছিলেন মানুষটা। বাঙালি গোগ্রাসে গিলেছে। আজও গিলে চলেছে ‘দাদার কীর্তি’। কখনও ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ দেখে বলে উঠেছে, ‘গলাটি মন্দ নয়…’। কখনও ‘বালিকা বধূ’ হয়ে উঠেছে বাঙালি নবদম্পতির মধু-মাখানো খুনসুটির নিদর্শন। তিনিই বুঝিয়েছিলেন, এভাবেই খুনসুটি করতে হয়! আজও… আজও তিনি সোনার কাঠি বুলিয়ে, চুম্বকীয় আকর্ষণে দর্শককে মোহিত করে রাখতে পারেন। তাঁর শিল্পকলায় আজও দর্শক খুঁজে পান খুব চেনা বাংলাকে, বাংলার জীবনকে, বাংলার সংগ্রামকে… আজও…
বাংলার নায়ক-নায়িকারা তাঁকে ডাকতেন ‘তরুবাবু’ বলে। একে-একে তুলে এনেছিলেন খনি থেকে হীরে। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়দের খুঁজে নিয়ে এসেছিলেন এক-এক করে। দেবশ্রী রায়, মহুয়া রায়চৌধুরীদের কাস্ট করেছিলেন নিজের ছবিতে। অনেকটা তাঁর ছবিতে কাজ করার পরই অভিনয় বিষয়টা মজ্জাগত হয়েছিল এই সব নামজাদা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়—ছোট হোক কি বড়, তরুণবাবু চিরকালই সকলকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। সে যেই হোক না কেন! ‘আপনি’ সম্বোধন থেকে বিরত থাকতেন না একবিন্দুও। তাঁর সিগনেচার ছিল বিষয়টা।
আরও একটা বিষয় নিয়ে মারাত্মক খুঁতখুঁতে, বলা ভাল ছুৎমার্গ ছিল মানুষটার। তিনি ভীষণ প্রচারবিমুখ ছিলেন। ২০১৮ সালে তা বেশ ভাল মতো টের পেয়েছিলেন কলকাতার সাংবাদিকরা। একে ১০ বছর পর ছবি মুক্তি পাচ্ছে তরুণ মজুমদারের, তা-য় সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। সকলে ফলাও করে নিজের ছবির প্রচার করছেন একদিকে। অন্যদিকে, তরুণবাবু লোকচক্ষের আড়ালে।
সাম্প্রতিক ধারা অনুযায়ী যেখানে মৌখিক পরীক্ষার মতো একের পর এক সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারকে দিয়ে চলেছেন অন্যরা, সেই ‘দল’ থেকে ‘ছুট’ হয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। একদিন জানা গেল, মুক্তি পেতে চলেছে তরুণ মজুমদারের নিখাদ ছবি ‘ভালবাসার বাড়ি’। ২০১৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির বসন্তের বিকেলে ছবি রিলিজ় হওয়ার কথা। বিজলী সিনেমা হলে প্রিমিয়ার ‘ভালবাসার বাড়ি’র। নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। মুক্তির আগে ঋতুপর্ণাই প্রচার করেছিলেন ছবির। তরুণবাবুকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়েছিল। ছবি মুক্তির দিন কয়েক আগে কিছু সাংবাদিক তাঁকে পেয়েছিলেন একটি সংবাদপত্রের গ্রন্থাগারে বইয়ে মগ্ন অবচ্ছায়। ৩-৪টে ছবিকেন্দ্রিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন তরুণবাবু। বলেছিলেন, “সৎ থেকে কাজ করা খুব কঠিন। আমি আমার কাজ করে দিয়েছি। কোনও বাড়তি কথা বলতে চাই না। দর্শকের ছবিটি ভাল লাগলেই আমি ধন্য।”
এ হেন তরুণ মজুমদারের রক্তেই ছিল সংগ্রামের আগুন। জন্ম বাংলাদেশের বগুড়া জেলায়, ১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি। বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর লড়াই। আপামর সাহিত্যে ডুবে থাকা তরুণ লেখাপড়া করেছিলেন কেমিস্ট্রি নিয়ে। প্রথমে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল মিশনস কলেজ, তারপর স্কটিশ চার্চ কলেজ। বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়কে। সন্ধ্যার সঙ্গে কাজ করেছিলেন বহু ছবিতে (২০টি চলচ্চিত্রে)। তরুণের ক্যামেরায় বারবার সন্ধ্যা ফিরে এসেছিলেন তাঁর ‘মিউজ়’ হয়ে, কখনও ‘শহর থেকে দূরে’, ‘মেঘমুক্তি’, ‘খেলার পুতুল’ কিংবা ‘অমর গীতিতে’…
গানের সূত্র ধরেই বলতে হয়, তরুণ মজুমদারের ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ। ছবিতে প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান তিনি ব্যবহার করেছিলেন ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবিতে। কাজটা সহজ ছিল না তাঁর কাছে। ছবির নির্মাতা ও ডিসট্রিবিউটাররা প্রস্তাব শুনে আঁতকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, এত আস্তে-আস্তে রবীন্দ্রনাথের গান বাজলে দর্শক কিছুতেই গ্রহণ করবেন না। কিন্তু হল এক্কেবারে উল্টো। মানুষের আরও ভাল লাগল ছবিতে ঠাকুর-সংযোজন। পরবর্তীতে সেই গানই হয়ে গেল তরুণ মজুমদারের ছবির অন্যতম ইউএসপি। কেবল রবীন্দ্রনাথ নন, মজুমদারবাবুর ছবিতে বারবার ফিরে এসেছিলেন অতুলপ্রসাদ, ডিএল রায়, মুকুল দত্তরা। লোকসঙ্গীতেরও একটা বড় জায়গা ছিল। ‘তরুবাবু’ ভালই বুঝতেন, সিনেমার জনপ্রিয়তা লুকিয়ে রয়েছে গানে। তাই গানের বিভাগ নিয়ে বাড়তি যত্নশীল ছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষালদের কণ্ঠ।
সিনেমার জন্য একাধিক জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার পেয়েছেন তরুণ মজুমদার। ভারতের সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছে পদ্মশ্রীতে। ১৯৫৯ সালে শচীন মুখোপাধ্যায় ও দীলিপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘যাত্রিক’ নামে পরিচালনা করেন ‘চাওয়া-পাওয়া’ ছবিটি। উত্তম-সুচিত্রা জুটি। ১৯৬২ সালে ‘কাঁচের স্বর্গ’ মুক্তি পেল। পেলেন জাতীয় পুরস্কার।
কেবল বাংলা বাণিজ্যিক ছবি নয়, তরুণ মজুমদারের কিছু ছবিকে ঘিরে আজও গভীর আলোচনায় মাতেন বুদ্ধিজীবী সমাজ। বামপন্থায় বিশ্বাসী মানুষ তৈরি করেছিলেন ‘পলাতক’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘গণদেবতা’র মতো ছবি। যা নিয়ে আজও চর্চা হয় চায়ের টেবিলে, বাঙালি বাড়ির ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ অন্দরে। পয়সার ‘হেডস’ যদি এই হয়, ‘টেইলস’-এ ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আপন আমার আপন’কে আপন করে নেন বাংলার আঠপৌরে মা-দিদি-বোনারা। এখানেই জয় তরুণ মজুমদারের। সিনেমাকে গোষ্ঠীবদ্ধ করেননি। বরং মেলে ধরেছিলেন সব ধরনের দর্শকের জন্য। কাউকে বঞ্চিত করেননি। রসদ জুগিয়ে গিয়েছেন।
করোনার অতিমারীতে যখন গোটা দেশ তালাবন্ধ হয়ে বাড়িতে বসে, হতাশ হয়ে পড়েননি তরুণ মজুমদার। নিজের কাজে মেতে ছিলেন। স্নেহের পরশ মিলিয়ে কথা বলতেন মানুষের সঙ্গে। কেউ খোঁজ নিলে কুশল বিনিময় করতেন ফোনের ওপার থেকেই। একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছিলেন। বই লিখছিলেন। আরও কাজ করতে চেয়েছিলেন… আরও একটা ‘বাড়ি’ হয়তো ছিল কোথাও তাঁর!