মীরের পাড়ার মেয়ে এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী কেন হারিয়ে গেলেন?

EXCLUSIVE Koushani Roy Sarkar: মাত্র ৩৩ বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নেন অভিনয় ছাড়বেন। অবসর নেবেন। টেক্সাস থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কলে টিভি নাইন বাংলা ডিজিটালকে অভিনেত্রী কৌশানী রায় সরকার জানালেন তাঁর অসময়ে অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার কারণ...

মীরের পাড়ার মেয়ে এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী কেন হারিয়ে গেলেন?
কৌশানী রায় সরকার।
Follow Us:
| Updated on: Aug 03, 2024 | 6:56 AM

টেক্সাসে তখন রাত ১২টা। কলকাতায় সকাল ১০টা। ফেসবুক ঘেঁটে পাওয়া গেল তাঁকে। বিয়ে করেছেন। প্রোফাইল লক করা ছিল না বলে সাম্প্রতিক ছবিও পাওয়া গেল। ঘোর সংসারী হয়েছেন অভিনেত্রী কৌশানী রায়। থুড়ি, এখন তিনি কৌশানী রায় সরকার। রাত ১২টাতেও মেসেঞ্জারে অ্যাকটিভ ছিলেন। কলকাতা থেকে তাঁর খোঁজ করছেন কেউ–জেনে খুশিই হলেন। টিভি নাইন বাংলা ডিজিটালের প্রতিবেদককে বলে বসলেন, “এখন অনেক রাত, আমরা কাল সকালে কথা বলতে পারি, যদি আপনার অসুবিধা না হয়।” সময় স্থির হল টেক্সাসের সকাল ১০.৩০টা এবং কলকাতার রাত ৯টার কথোপকথনের। সেই আলাপচারিতা থেকেই বেরিয়ে এল কী কারণে অভিনয় ছেড়েছেন কৌশানী, কোন অভিমানে কলকাতায় ফিরবেন না ভবিষ্যতে…

মাত্র ৫ বছর বয়সে অভিনয় কেরিয়ার শুরু করেছিলেন কৌশানী। থিয়েটার করতেন। মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জের মেয়ে তিনি। মীর আফসর আলির পাড়ায় থাকতেন। ছোটবেলা থেকেই মীরের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। জিয়াগঞ্জের অরিজিৎ সিং (গায়ক) তাঁর বন্ধুস্থানীয়। ছোটবেলায় একসঙ্গে অনেক স্টেজ শো করেছেন কৌশানী-অরিজিৎ। ভয়েস ট্রেনিং করান কলকাতা নিবাসী রেডিয়ো আর্টিস্ট জগন্নাথ বসুর কাছে। তিনি কৌশানীর গুরু। ‘এখানে আকাশ নীল’, ‘রোজগেরে গিন্নি’, ‘কাদের কুলের বউ’-এর মতো সিরিয়াল-সিনেমায় কাজ করেছেন। দর্শক তাঁকে মনে রেখেছেন মিষ্টি মুখের অভিনেত্রী হিসেবে। কিন্তু ২০১৫ সালে, মাত্র ৩৩ বছর বয়সে, সিদ্ধান্ত নিলেন অভিনয় ছাড়বেন। অবসর নিলেন। টেক্সাস থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কলে কৌশানী জানালেন, ঠিক কোন অভিমানে পেশাদার অভিনয় ছেড়েছেন তিনি।

কৌশানীর কাছে ইন্ডাস্ট্রির অর্থ–মন দিয়ে কাজ করার জায়গা। অভিনয় করতে গিয়ে কখনও উচ্ছৃঙ্খল জীবনে ঝুঁকে যাননি তিনি। পার্টি-ফার্টি করতেন না। কাজ-বাড়ি, বাড়ি-কাজ। কৌশানীর সংযোজন, “জানেন, মাঝেমধ্যে খুব বোর ফিল করতাম। বাবা বিয়ে দিতে চাইত। আমার বাবার বন্ধুর ছেলের প্রেমে পড়ে যাই। বর্তমানে তিনিই আমার স্বামী। বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি চটপট। অভিনয়কেও আলবিদা জানিয়ে দিই। চলে যাই দুবাই …”

স্বামীর সঙ্গে কৌশানী।

কথা বলতে-বলতে খানিক স্তব্ধ হয়ে গেলেন কৌশানী। নীরবতা ভেঙে বললেন, “আমার অভিনয় ছাড়ার পিছনে একটা নির্দিষ্ট কারণ ছিলই। আমি স্বর্ণযুগে কাজ শুরু করেছিলাম টেলিভিশনে। ধীরে-ধীরে দেখলাম, ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। সে একটা বিশ্রী পরিস্থিতি। অনেককিছু পাল্টে গেল লহমায়। সেই পরিবর্তন মেনে নিতে খুবই কষ্ট হত আমার। আমার কাছে কাজ মানে সৃষ্টিশীলতা। সেটা কখনওই রাজনীতি নয়। একটা সময়ের পর দেখলাম, মেকআপ রুমেও রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। শিল্পীরা শিল্পীদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। দম আটকে গেল আমার। ২০১৪ সালের ঘটনা এগুলো। ২০১৫ সালেই ঠিক করলাম, আর না, অনেক হয়েছে। অবসর ঘোষণা করলাম। বিয়ে করে চলে গেলাম দুবাই। স্বামী-সন্তান নিয়ে দিব্যি আছি এখন। গত বছরই টেক্সাসে এসেছি।”

দুবাই থেকে আবু ধাবি, আবু ধাবি থেকে বাহরিন, তারপর সেখান থেকে টেক্সাস–৯ বছর দেশের বাইরে থাকা কৌশানীকে কি ইন্ডাস্ট্রি মনে রেখেছে? টিভি নাইন বাংলা ডিজিটালের প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন পরিচালক-অভিনেত্রীদের সঙ্গে। কেউ মনে রেখেছেন তাঁর মুখ, কেউ নাম। নতুন প্রজন্মের কেউই তাঁকে চেনেন না সেইভাবে। তবে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের মতো তারকারা কৌশানীকে মনে রেখেছেন, মনে রেখেছেন তাঁর প্রিয় সহকর্মীরাও। দুবাইয়ের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে কৌশানীর বাড়িতেই থেকেছেন স্বস্তিকা। সংসারী মেয়েটাকে দেখে অবাক হয়ে বলেছেন, “সব ছেড়ে কী করে এত সুন্দর সংসার করছিস বল তো?” কৌশানীর বক্তব্য, “স্বস্তিকাদিকে যে উত্তরটা দিয়েছিলাম, আপনাকেও তাই দিচ্ছি। আসলে জীবনটাই একটা রঙ্গমঞ্চ। জন্মের পর থেকে আমরা সকলে অভিনয়ই করে চলেছি। তাই আমার আক্ষেপ নেই। পেশাদার অভিনয়ে ফেরার ইচ্ছাও নেই।”

দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকলেও, পাড়ার মেয়ে কৌশানীকে ভোলেননি মীর। তাঁকে কৌশানীর কথা জিজ্ঞেস করতেই একগাল হাসলেন। টেক্সাসের সংসারী পাড়ার মেয়েকে কলকাতা থেকে বার্তা পাঠালেন মীর। টিভি নাইন বাংলা ডিজিটালকে কী বললেন তিনি?

“কৌশানীকে অনেক বছর ধরেই চিনি। ওঁর কাজ যখন দেখতাম, খুব ভাল লাগত। ভীষণ ফোকাসড, ভীষণ ডেডিকেটেড এক শিল্পী। ওকে ভাল লাগার পিছনে আরও একটা বিশেষ কারণ এই যে, ও আজিমগঞ্জের মেয়ে। যে আজিমগঞ্জ আমার জন্মস্থান। আমি কলকাতায় বড় হয়েছি বটে, কিন্তু স্কুলজীবনের প্রত্যেক বছর, এমনকী কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত, যে কোনও লম্বা ছুটিতে আজিমগঞ্জে সময় কাটাতাম। আমার সমস্ত আত্মীয়-পরিজন সেখানেই থাকেন। কৌশানী আমার প্রাক্তন কলিগ, আমরা একই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছি। তবে কখনও একসঙ্গে কাজ করিনি আমরা। কৌশানীর পরিবার খুবই সম্ভ্রান্ত পরিবার। আমাদের গোটা পাড়ায় ওদের বাড়ির খুবই নামডাক রয়েছে। কৌশানীকে এটুকুই বলব যে, তুমি যাই করো, যেভাবে করো, সবই যেন মঙ্গল হয়। শুভ হয়। আজিমগঞ্জের মাটিতে যেহেতু আমরা দু’জনেই জন্মেছি, বাস করেছি, আমাদের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই জায়গায় অনেককিছু পাল্টে গেলেও মানুষগুলো পাল্টায়নি। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সেটা কৌশানীকে দেখেই বলছি…”

পুত্রের সঙ্গে কৌশানী।

টেক্সাসের মাটিতে এক বিরাট লড়াইয়ের মুখ হয়ে উঠেছেন কৌশানী। সেই লড়াইয়েরই এক সৈনিক তাঁর ৭ বছরের পুত্র রোদ্দুর। কৌশানীর ফুটফুটে-দুরন্ত পুত্র রোদ্দুর অটিজ়িমের শিকার। ছেলেকে ঘিরেই তাঁর জীবন। কৌশানী বলেছেন, “আমার সঙ্গে অটিস্টিক বাচ্চাদের বাবা-মায়েদের কথা হয়। আমাদের কাছে বাচ্চার এই পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। এটাকে আমরা নর্মালাইজ় করে ফেলেছি। কিন্তু ভারতে, বিশেষ করে কলকাতার মানুষের মননে এখনও কিছু প্রতিবন্ধকতা লক্ষ্য করে লজ্জা বোধ করি। ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালির হৃদয়টা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই সব ফাঁপা বলে মনে হয় এখন। সেই তুলনায় টেক্সাস অনেক এগিয়ে। অটিস্টিক বাচ্চাদের পাবলিক স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে এই দেশ। ওখানকার অন্য বাচ্চাদের বাবা-মায়েরা অটিজ়িমে আক্রান্ত বাচ্চাদের আপন করে নেন সহজেই। নিজেদের বাচ্চাদের মেলামেশা করতে এগিয়ে দেন। কিন্তু কলকাতায় ট্যারা চোখামি আজও বর্তমান। আমার বাচ্চার সঙ্গে এখানে কেউ কি খেলতে পাঠাবে? বুকে হাত রেখে বলতে পারব কলকাতার শিক্ষিত লোকজন আমার ছেলেকে দেখে কটূক্তি করবে না? আড়ালে হাসবে না? তাই ঠিক করেছি, স্বামীর অবসরের পর যদি দেশে ফিরি, এই নিম্নমানের মানসিকতায় পরিপূর্ণ শহরটায় আর ফিরব না…।”