Lok Sabha Elections 1952: গণতন্ত্রের সুর বাঁধা হয়েছিল ১৯৫২-তেই, কেমন ছিল দেশের প্রথম নির্বাচন?

Lok Sabha Elections 1952: আরও একবার জয় হয়েছে গণতন্ত্রেরই। গোটা বিশ্ব আরও একবার অবাক বিস্ময়ে দেখেছে। মাথা চুলকিয়েছে এই ভেবে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে কীভাবে কোনও সমস্যা ছাড়াই দশকের পর দশক ধরে নির্বাচন হয়ে চলেছে? আসলে এর সুরটা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল দেশের একেবারে প্রথম নির্বাচন থেকেই।

Lok Sabha Elections 1952: গণতন্ত্রের সুর বাঁধা হয়েছিল ১৯৫২-তেই, কেমন ছিল দেশের প্রথম নির্বাচন?
নির্বাচনের পর, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, "নয়া হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ"Image Credit source: TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Jul 03, 2024 | 12:10 AM

কলকাতা: সদ্য শেষ হয়েছে ১৮তম লোকসভা নির্বাচন। নির্বাচনের আগে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, দেশ স্বৈরাচারের দিকে এগোচ্ছে। সংকটে গণতন্ত্র। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। আরও একবার জয় হয়েছে গণতন্ত্রেরই। গোটা বিশ্ব আরও একবার অবাক বিস্ময়ে দেখেছে। মাথা চুলকিয়েছে এই ভেবে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে কীভাবে কোনও সমস্যা ছাড়াই দশকের পর দশক ধরে নির্বাচন হয়ে চলেছে? আসলে এর সুরটা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল দেশের একেবারে প্রথম নির্বাচন থেকেই। ১৯৫২ সালে, স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছর পরই নির্বাচন হয়েছিল সারা ভারত জুড়ে। ১৯৫১ সালের ২২ নভেম্বর, রাত সাড়ে আটটায় অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে এক ভাষণ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “এটা আমাদের সকলের পরীক্ষা। ভোটাধিকার পাওয়ার পর, এটাই আমাদের প্রথম নির্বাচন। আজ এখানে আমরা যে মান স্থির করব, সেটা একটা নজির হয়ে থাকবে। পরবর্তীকালের নির্বাচনের চালিকা শক্তি হয়ে উঠবে।” বাস্তবে, কেমন ছিল ভারতের প্রথম নির্বাচন? আজকের থেকে কতটা আলাদা ছিল? বাংলার ছবিটাই বা কী ছিল? আসুন ফিরে দেখা যাক দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস। নেহরু যে পরীক্ষার কথা বলেছিলেন, তাতে কি পাশ করেছিলেন দেশবাসী?

প্রেক্ষাপট

স্বাধীনতা লাভের মাত্র কয়েক বছর পরে, ১৯৫১ থেকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রথম নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এখনও প্রথম নির্বাচনই সবথেকে দীর্ঘদিন ধরে চলা নির্বাচন। শুরু হয়েছিল ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর, চলেছিল ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে, ১৯৪৮ সাল থেকেই তখনকার নেতারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে গঠন করা হয়েছিল নির্বাচন কমিশন। ১৯৫০-এর ২৫ জানুয়ারি স্থাপিত হয়েছিল নির্বাচন কমিশনের প্রথম কার্যালয়। একই বছরের মার্চে, দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল, সিভিল সার্ভিসেস অফিসার, সুকুমার সেনকে। তবে, নির্বাচন পরিচালনার জন্য তখনও পর্যন্ত ভারতে কোনও আইন-কানুন ছিল না। কয়েক মাস পরই, অন্তর্বর্তীকালীন সংসদে পাশ হয়েছিল ‘জনপ্রতিনিধি আইন’। এভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল প্রথম নির্বাচনের প্রেক্ষাপট।

কারা দেবে ভোট?

তবে, তারপরও অনেক কাজ বাকি ছিল। ভারতের মতো বিশাল এবং বৈচিত্রময় দেশে নির্বাচন করাটা সহজ কথা ছিল না। না ছিল সরকারের এই ধরনের বিশাল কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিজ্ঞতা, না ছিল বা জনগণের ই ছিল না। ১৯৫১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, সেই সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি। ঠিক হয়েছিল, জাতি, বর্ণ, বা ধর্ম নির্বিশেষে ২১ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী সকলকে ভোটাধিকার দেওয়া হবে। জম্মু ও কাশ্মীর বাদ দিয়ে এই জনসংখ্যাটা ছিল ১৭ কোটি ৩২ লক্ষ। তবে, অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। যুক্তি দিয়েছিলেন, প্রাপ্তবয়স্ক সকলকে ভোটাধিকার দিলে, ভোটারদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। সরকারের পক্ষে এত মানুষের ভোট পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। গণপরিষদ অবশ্য এই যুক্তি গ্রহণ করেনি।

নিরক্ষর দেশ

তবে, প্রাপ্তবয়স্ক সকলকে ভোটাধিকার না দেওয়ার দাবির পিছনে আরও একটা জোরদার যুক্তি ছিল, যা নির্বাচন কমিশনের কাছে অত্যন্ত বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিল। সেই যুক্তি হল ভোটারদের নিরক্ষরতা। প্রথম নির্বাচনে ভারতের যোগ্য ভোটারদের ৮৫ শতাংশই ছিল নিরক্ষর। কাজেই ভোটার শনাক্তকরণ, তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা ছিল কমিশনের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি, ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা, ভোটের কাজ করার জন্য দক্ষ আধিকারিক নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো আরও অনেক সমস্যা ছিল। এর পাশাপাশি, সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের বহু রাজ্যে সেই সময় চলছিল খাদ্য সংকট। সেই সংকটের মোকাবিলায় ব্যস্ত ছিলেন প্রশাসনের একটা বড় অংশ। কিন্তু সেই পাহাড় প্রমাণ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন সুকুমার সেন। ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রত্যেক আধিকারিককে তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে প্রত্যেক ভোটারের নাম নিবন্ধন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মহিলা ভোটার

আরও এক চ্যালেঞ্জ ছিল মহিলা ভোটারদের নাম তালিকাভুক্ত করা। সুকুমার সেনের নির্দেশ ছিল, মহিলাদের সঠিক নাম ভোটার তালিকায় দিতে হবে। কেউ তাঁর সঠিক নাম না দিলে, তাঁর নাম বাদ দেওয়া হবে। তবে, ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধি’ গ্রন্থে লিখেছেন, অনেক মহিলা ভোটারই নিজের নাম নথিভুক্ত করার পরিবর্তে, নিজেদের পরিচয় ‘অমুকের মা’, ‘তমুকের স্ত্রী’ হিসেবে দিয়েছিলেন। এই কারণে প্রায় ২৮ লক্ষ মহিলা ভোটারের নাম প্রথম নির্বাচন থেকে বাদ পড়েছিল। এঁদের বেশিরভাগই বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ এবং রাজস্থানের। তারপরও, মোট তালিকাভুক্ত ভোটারের ৪৫ শতাংশ ছিলেন মহিলা।

ব্যালট ও ব্যালট বাক্স

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভোট গ্রহণ করা হবে কীভাবে? গত কয়েক দশক ধরে ভারতে ভোট গ্রহণ করা হয় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম-এর মাধ্যমে। তার আগে ছিল ব্যালট বাক্সে। ব্যালটে পছন্দের প্রার্থীর নাম ও নির্বাচনী প্রতীকের উপর ছাপ দিয়ে, ব্যালট বাক্সে ফেলতেন ভোটাররা। প্রথম নির্বাচনে ব্যালট বাক্স থাকলেও, ভোটদানের পদ্ধতি ছিল অনেকটাই আলাদা। প্রাথমিকভাবে, কমিশন প্রার্থীদের জন্য বিভিন্ন রঙের ব্যালট বাক্স রাখার কথা ভেবেছিল। ১৯ লাখ ইস্পাতের ব্যালট বাক্স তৈরির জন্য এক ডজনেরও বেশি নির্মাতার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। তবে, শীঘ্রই বোঝা গিয়েছিল এই পরিকল্পনাটি চলবে না। এরপর, অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রতিটি বুথে প্রতিটি প্রার্থীর জন্য একটি করে পৃথক ব্যালট বাক্স থাকবে। অধিকাংশ ভোটদাতারা নিরক্ষর। তাই, প্রার্থীদের নাম পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার সমাধানে, প্রার্থীদের নামের পরিবর্তে, প্রতিটি ব্যালট বাক্সের উপর ওই প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতীক লাগানো হয়েছিল। জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পেয়েছিল জোড়া বলদ প্রতীক। আর এখন যে হাত প্রতীক নিয়ে লড়ে কংগ্রেস, সেই হাত প্রতীক পেয়েছিল অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক।

নির্বাচনের জন্য কমিশন প্রায় ৬২ কোটি ব্যালট পেপার ছাপিয়েছিল। প্রতিটির আকার ছিল ১ টাকার নোটের মতো। গোলাপী রঙের সেই ব্যালটের গায়ে লেখা ছিল ‘ইলেকশন কমিশন ইন্ডিয়া’। লোকসভা এবং বিধানসভা, দুই নির্বাচনের জন্যই মতদান করেছিলেন ভোটাররা। তাই প্রতিটি বুথে ভোটদানের জন্য দুটি করে পর্দাঘেরা জায়গা তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, “ভোটদানের নিয়মানুযায়ী ভোটদাতাগণকে আপনা হইতে নিজ নিজ এলাকার ভোটগ্রহণ ক্ষেত্রে গিয়া প্রথমে রাজ্য বিধানসভার এবং তৎপর লোকসভার সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের নির্বাচনে ভোট দিতে হইবে। প্রতি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে এই জন্য ২টি করিয়া পর্দাঘেরা ভোটদান কেন্দ্র থাকিবে। প্রত্যেক ভোটদাতার উহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া সংগৃহীত ব্যালটপত্র বা ভোটপত্র নিভাঁজ অবস্থায় ব্যালট বাক্সের উপরিস্থ ছিদ্রপথে উহার অভ্যন্তরে ফেলিয়া দিতে হইবে। বাহিরে ফেলিলে ঐ ভোটপত্র বাতিল হইয়া যাইবে। কোন ব্যালট বাক্সেই কোন নির্বাচন প্রার্থীর নাম থাকিবে না। তৎপরিবর্তে বাক্সগাত্রে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রতীক আঁটা থাকিবে। ভোটদাতাকে ঐ ছবি দেখিয়া মনোমত প্রার্থীর বাক্স চিনিয়া লইয়া উহার মধ্যে ভোটপত্র ফেলিতে হইবে।”

ব্যালট কারচুপি

ব্যালট এবং ব্যালট বাক্স নিয়ে ভোটদাতাদের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তিও তৈরি হয়েছিল। কারচুপিও কম হয়নি। নবতিপর সাংবাদিক কে বিশ্বনাথন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “প্রার্থীর প্রতীক দেওয়া বাক্সে ব্যালট কাগজ ফেলতে হত। কিন্তু প্রথম নির্বাচন বলে, এই নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। অনেক জায়গায় কেউ কেউ ব্যালট পেপারগুলি বাক্সগুলির উপরে রেখে দিয়েছিলেন। এর ফলে ব্যাপক জালিয়াতিও হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলি সেই সব ব্যালট সংগ্রহ করে নিজ নিজ প্রার্থীদের বাক্সে ফেলে দিয়েছিল।”

অবশেষে ভোট

নির্বাচন কমিশন এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার পর, ১৯৫১ সালের অক্টোবরে শুরু হয়েছিল প্রথম নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ভারতের দীর্ঘতম নির্বাচনে ভোট নেওয়া হয়েছিল ৬৮ দফায়। সবার প্রথমে ভোট হয়েছিল হিমাচল প্রদেশের চিনি এবং পাঙ্গি মহকুমায়। কারণ, এই দুই জায়গায় শীত নামছিল। আর শীতে তুষারপাতের ফলে, এই দুই উপত্যকা বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর ১৯৫১-র ডিসেম্বরে একে একে ভোট নেওয়া হয় ত্রিভাঙ্কোর-কোচিন (বর্তমানে কেরল), ওড়িশা, মধ্য প্রদেশ, হায়দরাবাদ এবং পঞ্জাবে। বাকি সব রাজ্যে ভোট হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে। বাংলায় ভোট শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি। ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েক দফায় ভোট গ্রহণ করা হয়েছিল। শুধুমাত্র মেদিনীপুরের নায়ারণগড় কেন্দ্রে ভোট হয়েছিল ৫ ফেব্রুয়ারি। উত্তর প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চলে (এখন উত্তরাখণ্ডে) ভোট নেওয়া হয় ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে, শীতের বরফ গলে যাওয়ার পর। সদ্য স্বাধীন দেশে, অধিকাংশ ভোটার নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও, প্রথম নির্বাচনে বৈধ ভোটারদের ৪৫.৭ শতাংশ নিজেদের মত প্রকাশ করেছিলেন। সর্বোচ্চ ভোট পড়েছিল কেরলের কোট্টায়াম সংসদীয় কেন্দ্রে, ৮০.৫ শতাংশ। অন্যদিকে, সর্বনিম্ন ভোট পড়েছিল মধ্য প্রদেশের শাহদোলে, ১৮ শতাংশ।

বাংলার প্রথম ভোট 

এবার আসা যাক বাংলার কথায়। প্রথম নির্বাচনে অন্যান্য রাজ্যের মতো বাংলাতেও একই সঙ্গে লোকসভা এবং বিধানসভার জন্য ভোট দিয়েছিলেন মানুষ। বর্তমানে বাংলায় বিধানসভা আসন হয়েছে ২৯৪টি এবং লোকসভা আসন ৪২টি। ১৯৫২-র নির্বাচনের সময় বিধানসভা আসনের সংখ্যা ছিল ২৩৮। আর লোকসভায় বাংলা পাঠিয়েছিল ৩৪ জন প্রতিনিধি। ২৩৮টি বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন মোট ১৩৭৮ জন। আর লোকসভার ৩৪ আসনের জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন ১৪৮ জন। দুই ভোট মিলিয়ে ৬৬০ জন নির্দল প্রার্থী ছিলেন। বাকিরা ছিলেন জাতীয় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, জনসংঘ-সহ ২০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। সেই সময়, বাংলায় মোট ভোটার ছিলেন, ১ কোটি ২৮ লক্ষ। ৩ জানুয়ারি প্রথম দফার ভোট গ্রহণের দিন নির্বাচনে কলকাতা বাদে, ১৪টি জেলার ২২টি বিধানসভা আসনে ভোট হয়েছিল। আনন্দবাজার ও বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভোট হয়েছিল একেবারে শান্তিপূর্ণ। কোথাও কাউকে ভোটদানে বাধা দেওয়া, রাজনৈতিক হিংসার খবর ছিল না। কোনও কোনও কেন্দ্রে শতকরা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়েছিল, আবার কোনও কোনও কেন্দ্রে ভোটদানের হার ছিল ৩৫ শতাংশ।

পালা এবার গণনার

ভোট গ্রহণের মতো, ভোট গণনাও হয়ছিল বেশ কয়েক ধাপে। ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৫২-র ২ এপ্রিল। সেই সময় জওহরলাল নেহেরুর মতো জনপ্রিয়তা আর কোনও নেতার ছিল না। কাজেই, কংগ্রেসের বড় জয় প্রত্যাশিতই ছিল। হয়েছিলও তাই। ৪৮৯ লোকসভার মধ্যে কংগ্রেস জিতেছিল ৩৬৪ আসনে। ৪৪.৯৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল নেহেরুর দল। ১৬টি আসনে জিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি। সিপিআই ভোট পেয়েছিল ৩.২৯ শতাংশ। ১০.৫৯ শতাংশ ভোট পেলেও, ১২টি আসন জিতে তৃতীয় স্থানে ছিল সোশ্যালিস্ট পার্টি। এছাড়া ভোটে লড়েছিল কিষাণ মজদুর প্রজা পার্টি, ভারতীয় জনসংঘ, অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা, মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের মতো বেশ কয়েকটি দল।

পশ্চিমবঙ্গে ৩৪টি লোকসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেস জয়ী হয়েছিল ২৪টি আসনে। ৪২.১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তারা। ৯.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ৫টি আসন জিতেছিল সিপিআই। এছাড়া, ২টি আসনে জিতেছিল জন সংঘ, ২টি জিতেছিল আরএসপি এবং হিন্দু মহাসভা জিতেছিল ১টি আসনে।

বিধানসভা নির্বাচনেও দুর্দান্ত জয় পেয়েছিল কংগ্রেস। ৩৮.৮২ শতাংশ ভোট পেয়ে বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস জিতেছিল ১৫০টি আসনে। ১০.৭৬ শতাংশ ভোট এবং ২৮টি আসনে জিতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ছিল দ্বিতীয় স্থানে। ১৫টি আসন জিতে তৃতীয় স্থানে ছিল কিষাণ মজদুর প্রজা পার্টি। এছাড়া, মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক ১১টি, ভারতীয় জন সংঘ ৯টি, হিন্দু মহাসভা ৪টি, ফরোয়ার্ড ব্লক (রুইকর) ২টি আসনে জয়ী হয়েছিল। এছাড়া, ১৯ জন নির্দল প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন।

বড় জয়, অবাক করা পরাজয়

প্রার্থীদের মধ্যে কংগ্রেসের জওহরলাল নেহেরু, ভারতীয় জন সংঘের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের মতো হেভিওয়েট প্রার্থীরা জিতেছিলেন। তবে বম্বে আসনে হেরে গিয়েছিলেন দেশের পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই। তবে প্রথমবারের নির্বাচনে সম্ভবত সবথেকে আশ্চর্যজনক পরাজয় হয়েছিল সংবিধান প্রণেতা বিআর আম্বেদকরের। বম্বে উত্তর মধ্য আসনে প্রায় ১৫,০০০ ভোটে তাঁকে হারিয়েছিলেন তাঁরই প্রাক্তন ব্যক্তিগত সহকারী, নারায়ণ সদোবা কাজরোলকর। মজার বিষয় হল, সেই সময়ের সবথেকে জনপ্রিয় নেতা জওহরলাল নেহরু হলেও, প্রথমবারের নির্বাচলে সবথেকে বড় জয় তিনি পাননি। এই কৃতিত্ব রয়েছে এক কমিউনিস্ট নেতার। তিনি রবি নারায়ণ রেড্ডি।

শেষ কথা

ভারতের প্রথম নির্বাচন আয়োজনে খরচ হয়েছিল ১০.৪৫ কোটি টাকা। নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন এই নির্বাচনকে বলেছিলেন, ‘মানব ইতিহাসে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা’। নিবন্ধের শুরুতে জওহরলাল নেহেরুর রেডিয়ো ভাষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তিনিও নির্বাচনের আগে পরীক্ষার কথা বলেছিলেন। আর নির্বাচনের পর, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “নয়া হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ।” রামচন্দ্র গুহর ”ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’ অনুযায়ী, নেহেরু বলেছিলেন, “তথাকথিত নিরক্ষর ভোটারের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। ভারতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার নিয়ে আমার যে সন্দেহ ছিল, তা পুরোপুরি দূর হয়েছে।” মাথায় রাখতে হবে, ভারতে যখন ভোট হচ্ছিল, সেই একই তখন পাকিস্তানে খুন হয়েছিলেন তাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। একই সময়ে যুদ্ধ চলছিল ভিয়েতনাম ও ফ্রান্সের মধ্যে। খুন হয়েছিলেন সেই সময়ের ইরানের প্রধানমন্ত্রীও। আজও ভারতে যখন প্রশ্ন ওঠে পাকিস্তানের নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে, বাংলাদেশের নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে, ভারতে মুক্ত ও অবাধ ভোট হয়। আজও ভারতে জিতে যায় গণতন্ত্র, মাথা তুলতে পারে না স্বৈরাচার।