বিশ্লেষণ: একটা হোয়াটসঅ্যাপ কলেই খেল শুরু পেগাসাসের! মোবাইলের ক্যামেরায় অন্য কেউ চোখ রাখছে না তো?

Explained: মোবাইলের ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন ব্যবহার করা যেতে পারে পেগাসাসের মাধ্যমে। কখন মোবাইল এসে প্রবেশ করবে 'স্পাইওয়্যার' জানবে না কেউ।

বিশ্লেষণ: একটা হোয়াটসঅ্যাপ কলেই খেল শুরু পেগাসাসের! মোবাইলের ক্যামেরায় অন্য কেউ চোখ রাখছে না তো?
Follow Us:
| Updated on: Jul 20, 2021 | 8:56 PM

এক ধবধবে সাদা ঘোড়া। দু’পাশে দুটো ডানা। রূপকথার পাতার সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া আসলে গ্রিক পুরাণের ‘পেগাসাস’। গত কয়েকদিন ধরে সংবাদ শিরোনামে সেই পেগাসাস। কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়, তবে বাস্তবের ‘পেগাসাস’-কেও চোখে দেখা যায় না। সে সন্তর্পণে ঢুকে পড়তে পারে আমার-আপনার মোবাইলে। সাদা চোখে দেখা না গেলেও এই স্পাইওয়্যার ঘাপটি মেরে বসে থাকে মুঠোফোনের অন্দরমহলে। এই সাইবার অস্ত্রের মাধ্যমেই অ্যান্ড্রয়েড কিংবা আইফোনের সব খবর চলে যেতে পারে অন্য কারও হাতে। সম্প্রতি এক রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। ভারতের একাধিক সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ফোনে নাকি আড়ি পাতা হয়েছে এই পেগাসাসের মাধ্যমে। তবে কি সুরক্ষিত নই আমরা কেউ? কোথা থেকে এল এই ‘পেগাসাস’?

২০১৯ সাল থেকে ১৬টি সংবাদমাধ্যম মিলে ‘পেগাসাস প্রোজেক্ট’ নামে একটি তদন্ত করেছিল। সম্প্রতি, সেই রিপোর্টের কিছু অংশ সামনে এসেছে।

কী এই পেগাসাস?

ইজরায়েলের সংস্থা এনএসও-র তৈরি একটি সফটওয়্যার। মোবাইল ফোন থেকে সব তথ্য হাতিয়ে নিতে সক্ষম এটি। তাই একে ‘স্পাইওয়্যার’ বলে চিহ্নিত করা হয়। ব্যবহারকারীর অজান্তেই তাঁর মোবাইলে হানা দিতে পারে এই স্পাইওয়্যার। মোবাইলের সব ব্যক্তিগত তথ্যে নজরদারি চালানো যায় এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ম্যালওয়্যার (ম্যালিসাস সফটওয়্যার) বাজারে আরও অনেক আছে। কিন্তু এতটা নিঃশব্দে কাজ করতে পারে খুব কম সফটওয়্যার। ফোনের মালিককে কিছু বুঝতে না দিয়েই চুরি করে নিতে পারে সব তথ্য।

কী অভিযোগ ভারতে?

সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়্যার’-এ প্রকাশিত তথ্যে দাবি করা হয়েছে, ভারতের আইনজীবী, বিচারপতি, ব্যবসায়ী, সরকারি আধিকারিক-সহ প্রায় ৩০০ জনের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে এই পেগাসাসের মাধ্যমে। এই তালিকায় রয়েছেন ভারতের ৪০ জন সাংবাদিক, তিন বিরোধী নেতা, একজন সাংবিধানিক প্রধান, মোদী সরকারের দুই বর্তমান মন্ত্রী, বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার প্রাক্তন এবং বর্তমান প্রধান-সহ অনেকেই। এমনকি তৃণমূলের ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও রয়েছে সেই তালিকায়।

মানবাধিকার কর্মী আহমেদ মনসুরের ফোনে যাওয়া এক মেসেজেই রহস্যের সূত্রপাত

সালটা ২০১৬। আরব আমিরশাহীর জেলে কী ঘটছে, তার গোপন খবর জানা যাবে। এমনই একটি মেসেজ গিয়েছি সে দেশের মানবাধিকার কর্মী আহমেদ মনসুরের ফোনে। মনসুরের সন্দেহ হওয়ায় সাইবার বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ হন তিনি। জানতে পারেন মেসেজ খুলে লিঙ্কে ক্লিক করলেই তাঁর ফোনের সব তথ্য পাচার হয়ে যেত। তখনই সামনে আসে ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও-র নাম। ২০২০-তেও একটি ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচে এই স্পাইওয়্যার কিনেছিল সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। সে দেশের যে সব সাংবাদিক বা রাজনৈতিক নেতা প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাজ করছেন, তাঁদের ফোনে আড়ি পাততেই পেগাসাস কিনেছিল এই দেশ।

হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয় জামাল খাসোগির দেহ, ঘটনার নেপথ্যেও পেগাসাস

২০১৮-তে ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটে নৃশংসভাবে খুন হন সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি। খাসোগিকে হত্যা করে তাঁর লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সৌদি সরকারের সমালোচক ছিলেন ওই সাংবাদিক। জানা যায় খাসোগির ঘনিষ্ঠ দুই মহিলার ফোনে পেগাসাসের মাধ্যমে আড়ি পেতেই খাসোগির অবস্থান জানতে সক্ষম হয়েছিল আততায়ীরা। একজন বিমানকর্মী হানান এলাটার ও অপরজন খাসোগির স্ত্রী। খাসোগির মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল, হত্যাকাণ্ডের মাস ছয়েক আগে থেকেই তাঁদের ফোনে নজরদারি চালাচ্ছিল স্পাইওয়্যার। হানান নামে ওই মহিলার ফোনে এসেছিল চারটি মেসেজ, তাতেই ছিল ম্যালওয়্যার।

কোথায় আছে, কার সঙ্গে কথা বলছেন, সব জানার ক্ষমতা আছে পেগাসাসের:

ফোন কল ট্র্যাক করার পাশাপাশি মোবাইলের অবস্থানও ধরে ফেলে এই স্পাইওয়্যার। ভিডিয়ো ক্যামেরার তথ্যও হাতিয়ে নিতে পারে অনায়াসে। ফোনে থাকা ছবি, মেসেজ, ফাইল, স্কাইপ কিংবা মেসেঞ্জারের মতো অ্যাপে থাকা সব তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে পেগাসাস। শুধু তাই নয়, আপনার ফোন থেকে অজান্তে তুলে নিতে পারে স্ক্রিনশট, ফোনের ক্যামেরা থেকে গোপনে তুলতে পারে ছবি, ফোনের মাইক্রোফোন ব্যবহার করে আশেপাশে কারা কথা বলছে, সেটাও শুনে ফেলতে পারে।

মোটা টাকা খরচ করে দামি ফোন কিনলেই কি আপনি নিশ্চিন্ত?

একসময় শুধুমাত্র ফোন করা যাবে, এমন মোবাইল ব্যবহার করার চল ছিল। পরে বেড়েছে দাম, বেড়েছে বৈশিষ্ট্য। অ্যান্ড্রয়েডের রমরমা বাজার তো আছেই, তবে ফোনের সুরক্ষা নিয়ে যারা সচেতন তাঁরা আই ফোন কিনতেই পছন্দ করেন। কিন্তু পেগাসাসের হাত থেকে মুক্তি নেই কারও। অ্যান্ড্রয়েডের প্রায় সব ভার্সানেইই কাজ করতে সক্ষম এই স্পাইওয়্যার। ছাড় নেই আইফোনেরও। আইওএস (আইফোনের অপারেটিং সিস্টেম) ১৪.৬ ভার্সান পর্যন্ত দুর্বল এই স্পাইওয়্যারের কাছে। আইফোন বা আইপ্যাডে নজরদারি চালাতে সক্ষম এটি। সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, আইফোনের সব অ্যাপ বা অ্যাপল মিউজিক হ্যাক করা সম্ভব এই পেগাসাসের মাধ্যমে।

হোয়াটসঅ্যাপে একটা মিসড কল! খেল শুরু পেগাসাসের

কী ভাবে ফোনের ব্যক্তিগত তথ্যে নজরদারি চালানো যায়, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালাচ্ছে এই সংস্থা। শুরুর দিকে মোবাইলে পাঠানো হত কোনও লিঙ্ক। সেটাতে ক্লিক করলেই ফোনের তথ্য চলে যেত স্পাইওয়্যারের হাতে। কিন্তু, সময় বদলেচ্ছে, অনেকেই এ সব বিষয়ে ওয়াকিবহাল। তাই কাজ সারতে হবে চুপিসাড়ে। তাই হোয়াটসঅ্যাপে একটা মিসড কল দিয়েই সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার উপায় বের করেছে পেগাসাস। আর সেই পদ্ধতিকেইই বলা হচ্ছে ‘জিরো ক্লিক অ্যাটাক।’ ২০১৯-এর একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছিল, ১৪০০ ফোনের তথ্য হাতানো হয়েছে একটি সাধারণ হোয়াটসঅ্যাপ কলের মাধ্যমে।

ফোন ফেলে দেওয়া ছাড়া গতি নেই!

পেগাসাস থেকে মুক্তির উপায় কী? তা নিয়ে সাইবার বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছেন। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ফোন ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। ফোন না ফেলে দেওয়া পর্যন্ত পেগাসাস থেকে মুক্তি নেই। এমনকি ফ্যাক্টরি রিসেট করেও কোনও লাভ হয় না। তাই স্পাইওয়্যারের উপস্থিতি বুঝতে পারলে সেই ফোন ফেলে দিতে হবে। নতুন ফোনে যদি পুরনো অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়, তাহলে খেয়াল রাখতে হবে যাতে লেটেস্ট ভার্সান রাখা যায়।

ভারতীয় এজেন্সি কি পেগাসাস ব্যবহার করে?

এই বিষয়ে কোনও স্পষ্ট তথ্য নেই। ভারতীয় আইনের ধারা অনুযায়ী, আইনিভাবেই কেবলমাত্র নজরদারি চালানো যায়। যে সব সংস্থা এই নজরদারি চালাতে পারে তারা হল আইবি, ইডি, র এবং দিল্লির পুলিশ কমিশনার। প্রয়োজনে আইন মেনে সেই নজরদারি চালানো হয় বলে আগেই জানিয়েছিল কেন্দ্র।

অভিযোগ নিয়ে কী বলছে কেন্দ্র?

সাম্প্রতিক অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। ১৯ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে বাদল অধিবেশন, আর তার ঠিক আগেই সামনে এসেছে এই অভিযোগ। ২০১৯ থেকে এই আড়িপাতা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। মোদী সরকারের মন্ত্রীদের দাবি, অধিবেশনের আগে এরকম একটি অভিযোগ আদতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দাবি, এর পিছনে শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশও রয়েছে। অন্যদিকে, তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের দাবি, এই অভিযোগের কোনও ভিত্তি নেই।

এই পেগাসাসের খবরে ঘুম উড়েছে অনেকেরই। তবে কি হাতে থাকা মোবাইল থেকে অজান্তে চলে যাচ্ছে সব তথ্য! সাধারণ মানুষের মোবাইলে পেগেসাস ব্যবহার করার উদাহরণ তেমন নেই। তবে মেসেজ বা হোয়াটসঅ্যাপে আসা লিঙ্ক যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, যে কোনও অজানা লিঙ্ক থেকে দূরে থাকাই ভাল।