কখনও আইএএস, কখনও পুরকর্তা! অভিযোগের যে ৯ তিরে বিদ্ধ দেবাঞ্জন

Fake Vaccine: গত মঙ্গলবার কসবা থানায় খবর যায়, কসবা নিউমার্কেটের পাশে একটি ফ্ল্যাটে ভুয়ো টিকাকরণ শিবির চলছে। এই শিবিরে কোনও সরকারি অনুমোদন নেই।

কখনও আইএএস, কখনও পুরকর্তা! অভিযোগের যে ৯ তিরে বিদ্ধ দেবাঞ্জন
ছবি-ফেসবুক
Follow Us:
| Updated on: Jun 27, 2021 | 8:32 PM

কলকাতা: একই অঙ্গে কত রূপ! কসবার ভুয়ো ভ্যাকসিনকাণ্ডে ধৃত দেবাঞ্জন দেবকে জেরা করে তদন্তকারীদের মুখে এখন এই শব্দবন্ধই। গত ২২ জুন মঙ্গলবার কসবা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল দেবাঞ্জন দেবকে। সেদিন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, কোনও অনুমতি ছাড়া পুরসভার নাম ভাঙিয়ে করোনার টিকা-শিবির করছেন তিনি। কিন্তু বুধবার থেকে পুরোদমে এই তদন্ত শুরু হওয়ার পর ছ’দিনেই রাজ্যবাসীর চক্ষু ছানাবড়া করে দিয়েছে বছর ছত্রিশের এই যুবক। তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ। তদন্তের হাত ধরে ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে সে তালিকা।

গত মঙ্গলবার কসবা থানায় খবর যায়, কসবা নিউমার্কেটের পাশে একটি ফ্ল্যাটে ভুয়ো টিকাকরণ শিবির চলছে। এই শিবিরে কোনও সরকারি অনুমোদন নেই। যিনি এই শিবিরের আয়োজক তিনি নাকি ‘আইএএস কর্তা’। গাড়িতে সরকারি স্টিকার, নীল বাতির গাড়ি। টিকাপ্রাপকদের একটি করে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতলও দেওয়া হচ্ছে। যেখানে সরকারি লোগো লাগানো। এমনকী সাংসদ মিমি চক্রবর্তীও সেই শিবিরে গিয়ে টিকা নিয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ দেবাঞ্জন দেব নামে এক ব্যক্তির খোঁজ পান। যিনি নিজেকে পুরসভার যুগ্ম কমিশনার বলে পরিচয় দিয়ে এই টিকার শিবির করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধরেও নিয়ে যায় পুলিশ। বুধবার গ্রেফতার করা হয়। ততক্ষণে এই ঘটনায় হইচই পড়ে গিয়েছে। একের পর এক অভিযোগ আসতে শুরু করেছে কসবা পুলিশের কাছে।

অভিযোগ ১: ভুয়ো টিকাকরণ শিবিরের আয়োজন

জলের সঙ্গে পাউডারের গুঁড়ো মিশিয়ে টিকা বানিয়ে সেই টিকা করোনার প্রতিষেধক বলে শতাধিক মানুষের শরীরে দিয়েছেন দেবাঞ্জন। নিজেকে আইএএস পরিচয় দিয়ে সাংসদ মিমি চক্রবর্তীর দফতরেও ফোন করেছেন, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন টিকা নিতে। মিমি তাতে সাড়া দিয়ে টিকা নিয়েও এসেছেন। কসবার পাশাপাশি আমহার্স্ট স্ট্রিটেও একটি টিকাকরণ শিবির করেছিলেন দেবাঞ্জন। সেখানেও বহু মানুষ এই টিকা নেন। অধিকাংশকেই বলেছিলেন কোভিশিল্ড দিচ্ছেন। কারও কারও কাছে দর বাড়াতে নাকি স্পুটনিক ভি’র কথাও শোনান। শুধু ভুয়ো ভ্যাকসিনই নয় ভুয়ো স্যানিটাইজারও বিলি করেছেন। তাঁর অফিস থেকে উদ্ধার হওয়া স্যানিটাইজারের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাতে ইথাইল অ্যালকোহল নেই, রয়েছে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড। যা ঘরবাড়ির জীবাণুনাশে ব্যবহার করা হয়।

অভিযোগ ২: কারও কাছে আইএএস, কারও কাছে পুরসভার পদস্থ কর্তা

কলকাতা পুরসভার যুগ্ম কমিশনার পরিচয় দিয়ে জালিয়াতির জাল বুনেছিলেন দেবাঞ্জন। পুর কমিশনারের সই জাল করে তৈরি করেছিলেন ভুয়ো আইডি কার্ড। পুরসভার নাম করে কসবায় এনজিও চালাতেন। পুরসভার বিশেষ কমিশনারের সই জাল করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন। অ্যাকাউন্ট খুলতে পুরসভার নথি, রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহার করেন। অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন পুরসভার জিএসটি নম্বর। কলকাতা পুরসভার হলোগ্রাম ব্যবহারেরও অভিযোগ উঠেছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় পুরসভার লোগো দেওয়া মাস্ক, স্যানিটাইজার বিলি করতেন। পুরসভার জাল ব্যানার, হোর্ডিং বানিয়ে তিলজলায় ‘দুয়ারে সরকার’ আয়োজন করেন। পুরসভার নাম করে সোনারপুর এবং উত্তর কলকাতায় ত্রাণও বিলি করেন।

অভিযোগ ৩: জাল ভ্যাকসিন দিয়েছিলেন বাবাকেও

বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে নিজের ভুয়ো ভ্যাকসিন ক্যাম্পে বাবা মনোরঞ্জন দেবকেও নিয়ে যান দেবাঞ্জন। মাকেও ভ্যাকসিন দিতে চেয়েছিলেন সেখানেই। কিন্তু তিনি শিবির থেকে নিতে রাজি হননি। বলেছিলেন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নেবেন। পরে তদন্তে জানা যায়, বোনের এক বান্ধবী ও তাঁর পরিবারকেও ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন দেবাঞ্জন।

অভিযোগ ৪: ছোট লালবাড়িই তুরুপের তাস

দেবাঞ্জন দেবের বিরুদ্ধে যে সমস্ত জালিয়াতির অভিযোগ, তার সিংহভাগ পুরসভাকে জড়িয়ে। অভিযোগ, কলকাতা পুরসভার ডেপুটি ম্যানেজারের নামে ফেক ইমেল আইডি খুলেছিল দেবাঞ্জন। বিশেষ কমিশনারের সই জাল করে বেসরকারি ব্যাঙ্কে কলকাতা পুরসভার অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন তিনি। এরকম আটটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন মিথ্যা পরিচয় দিয়ে। কলকাতা পুরসভার সমান্তরাল একটি অফিস কসবাতে খুলে বসেছিলেন তিনি। পুরসভার স্ট্যাম্প ব্যবহার করে ভুয়ো নিয়োগপত্র দিয়ে কর্মী নিয়োগ করেছিলেন। মাসিক বেতন ২৩ হাজার টাকার চুক্তিতে ‘নিয়োগ’ করেছিলেন পুরসভার ‘হেড ক্লার্ক’। পুরসভার নাম ভাঙিয়ে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থাকে ১৭১টি টিকা বিক্রিও করেন দেবাঞ্জন।

অভিযোগ ৫: নিজেই তৈরি করেন টিকার লেবেল

দেবাঞ্জনের অফিসের কম্পিউটারে মিলেছে নকল কোভিশিল্ড-এর লেবেল তৈরির গ্রাফিক্স। অর্থাৎ তার কম্পিউটারেই লেবেল ছাপানোর গ্রাফিক্স তৈরি করা হয়েছিল। তারপর তা বাইরে থেকে ছাপিয়ে এনে প্রত্যেকটি ইনজেকশনের শিশিরের ওপর সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেবাঞ্জনের অফিসের কম্পিউটার হার্ডডিস্ক বাজেয়াপ্ত করেছেন গোয়েন্দারা। ভারতে এখনও অনুমোদনই মেলেনি যার, সেই ফাইজ়ারের ‘টিকা’ দেবাঞ্জনের অফিস থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

অভিযোগ ৬: সরকারি আধিকারিক পরিচয় দিয়ে টাকা হাতানো

ট্যাংরার এক ব্যবসায়ীর দাবি, তাঁর কাছ থেকে কমিউনিটি হল তৈরির নামে দেবাঞ্জন ৯০ লক্ষ টাকা নেন। একটি বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগও দায়ের হয়েছে। যে টাকার বিনিময়ে ওই সংস্থার ১৭২ জন কর্মীকে টিকা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এক ফার্মা কোম্পানিকে টেন্ডার পাওয়ানোর নাম করে ৪ লক্ষ টাকা নেওয়ারও অভিযোগ দায়ের হয়েছে দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ ৭: গৃহশিক্ষককেও প্রতারণার জালে বেঁধেছিলেন

স্নাতক স্তরে পড়তেন তখন। সেই সময়ই টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছিল দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে। বিএসসি পড়ার সময় জুওলজি গৃহশিক্ষককেও প্রতারণার জালে ফাঁসিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। গড়িয়ার দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজে কর্মরত ওই শিক্ষক পড়ানোর পাশাপাশি অভিনয় করতেন। অভিযোগ, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিনেমায় অভিনয়ের টোপ দিয়ে শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নেন। কখনও আর্টিস্ট ফোরামের কার্ড করিয়ে দেওয়ার নামে আবার কখনও শর্টফিল্মে কাজ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন দেবাঞ্জনের সেই মাষ্টারমশাই।

আরও পড়ুন: ভরসন্ধ্যায় দেবাঞ্জনকে নিয়ে মাদুরদহের বাড়িতে লালবাজারের গোয়েন্দারা

অভিযোগ ৮: ফিনান্স কর্পোরেশন থেকে বেতন দিতেন কর্মীদের

ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিনকর্প একটি সরকারি নিগম। সরকারি কর্মীদের বেতন দেওয়া হয় এখান থেকে। দেবাঞ্জনের কসবার অফিসের কর্মীরা ২৫-৩৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন। সেই কর্মীদের অ্যাকাউন্টে বেতনের টাকা ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিনকর্প থেকে ক্রেডিট হয়েছে। যা দেখে তাজ্জব গোয়েন্দারাও।

অভিযোগ ৯: স্মার্ট ক্লাসের জন্য ২০টি স্কুল বেছে নেন

২০টি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে স্মার্ট ক্লাসের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন দেবাঞ্জন। স্পোর্টস অ্যাকাডেমির পাশাপাশি দেবাঞ্জনের স্মার্ট অনলাইন ক্লাস তৈরি করারও একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। বেহালার একটি কোম্পানির কাছ থেকে প্রায় ১২ লক্ষ টাকার সামগ্রী কিনেছিলেন। যার মধ্যে ১০ লক্ষ টাকার প্রতারণা করেছিলেন।