‘চারটে বছর ফিরবে কি?’ আদালতের রায়ে অথই জলে ওঁরা!
অভাবের সংসারে সম্বল বলতে সুশান্তর টিউশনির কয়েকটা টাকা আর তাঁর দাদার স্বল্প বেতনের বেসরকারি চাকরি।
পৌলমী রায় বন্দ্যোপাধ্যায়: গাঢ় কালো অন্ধকারের মধ্যে সূচিছিদ্র দিয়ে আসা আলোর মতই আশা দেখেছিলেন ওঁরা। আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে তখন কেউ নিজের ইশ্বরকে ডাকছিলেন, কেউ পাইচারি দিচ্ছিলেন এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত, কেউবা দাঁত দিয়ে নখ কাঁটচ্ছিলেন। আদালতকক্ষে যে তখন তাঁদের ভবিষ্যত্ নির্ধারিত হচ্ছে! মূল্যায়ন হচ্ছে ওঁদের চারটে বছরের ধৈর্য্যের! কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে আবারও ওঁরা অনিশ্চয়তার মুখে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, প্যানেলে নাম ছিল, তবুও মিলছিল না চাকরি।
২০১৬ থেকে যে অপেক্ষা শুরু হয়েছে, তা যেন ক্রমেই দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। শুক্রবার উচ্চ প্রাথমিক (WB Upper Primary Recruitment) মামলায় আদালতের রায়ে সেই প্রতীক্ষা যেন অনন্ত হল।
শুক্রবারই কলকাতা হাইকোর্ট ২০১৬ সালের উচ্চ প্রাথমিকের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছে। প্যানেল থেকে মেধাতালিকা সমস্ত কিছু বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য। আবারও নতুন লড়াইয়ের সামনে এনে দাঁড় করাল আপার উচ্চ প্রাথমিক চাকরিপ্রার্থীদের। ওঁদের কথায়, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল লড়াই, এক ধাক্কায় চারটে বছর পিছিয়ে যেন সেখানেই দাঁড়িয়ে তাঁরা।
কথা হল সুশান্ত ঘোষের সঙ্গে। বছর তিরিশের সুশান্তের বাড়ি রায়গঞ্জের হেমতাবাদে। বাবার ক্রনিক সুগার মায়ের নার্ভের অসুখ। স্নাতকোত্তর পাশ করে বিএড করেন সুশান্ত। আশা ছিল স্কুলে শিক্ষকতা করবেন। পড়াশোনার জন্য ২০০৭ সালে বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ দিনাজপুরে মামাবাড়িতে আসেন। ২০১৫ সালে উচ্চ প্রাথমিকের টেট পাশ করে ইন্টারভিউ দেন। প্যানেলে নাম ওঠে সুশান্তর। তারপর থেকে শুধুই অপেক্ষা।
অভাবের সংসারে সম্বল বলতে সুশান্তর টিউশনির কয়েকটা টাকা আর তাঁর দাদার স্বল্প বেতনের বেসরকারি চাকরি। ‘স্কুলের চাকরিটা হলে সংসারটা বেঁচে যেত।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন সুশান্ত। এরপরই চোয়াল শক্ত করে বললেন, “দুর্নীতি হয়েছে বলেই আদালত রায় দিয়েছে। কিন্তু যে সময়টা চলে গেল সেটা কী ফিরে পাব? আদৌ চাকরিটা কী হবে!”
একই অভিব্যক্তি পূর্ব মেদিনীপুরের ২৯ বছরের অনুতোষ বড়পণ্ডার। বাবা-মা-কাকিমা-ভাইবোনের সংসারে মূল রোজগেরে বিজ্ঞান শাখায় পাশ করা অনুতোষ। ২০১৫ সালে পরীক্ষা হয় তারপর থেকে চাকরির জন্য প্রহর গোনা শুরু। তাঁর কাছে শুক্রবারের রায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। অনুতোষের প্রশ্ন, ‘নিয়োগ কী করে হবে এবার?’
বহরমপুরের অর্পিতা সাহার নাম আবার ২৪ হাজারের প্যানেলে নেই। তাঁর কথায়, “ইন্টারভিউ দিলেও কয়েকজনের নম্বর বেড়ে যাওয়ায় প্যানেলে বাইরে নাম চলে যায়।” তাঁর প্রশ্ন, “এটা কীভাবে সম্ভব? এখানেই তো দুর্নীতি” অর্পিতার কথায়, “প্যানেল রেকটিফিকেশন হলে ভালো হত। বাতিল করার হলে ২০১৯ সালে ভেরিফিকেশনের সময় কেন করা হল না? দুর্নীতি যে হয়েছে তা তো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাহলে এতদিনে নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়ে যেত। সামনে নির্বাচন। পুরো প্রক্রিয়া এর মধ্যে শেষ করা আদৌ সম্ভব কি? ”
আরও পড়ুন: এ বছর হচ্ছে না শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, জানাল বিশ্বভারতী
সত্যিই অর্পিতার এই আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা মনে করছেন শিক্ষকমহলের একাংশও। সামনেই নির্বাচন। তার আগে এত বড় প্রক্রিয়া শেষ করা দুষ্কর। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া আর চাকরিপ্রার্থীদের অপেক্ষার সময়সীমা যে আরও বেশি দীর্ঘায়িত হবে, তা নিশ্চিত বলেই মনে করছে শিক্ষামহল।
একনজরে উচ্চ প্রাথমিক নিয়োগপ্রক্রিয়া হালহকিকত
২০১৩ অফলাইন ফর্ম ফিলাপ। ২০১৪ সালে অনলাইন ফর্ম ফিলাপ। ২০১৫ সালে পরীক্ষা। ২০১৬ সালে ফল প্রকাশ। টেট পাশ করেন ১ লক্ষ ৮০ হাজার পরীক্ষার্থী। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভেরিফিকেশনের জন্য ফর্ম ফিলাপ করেন ৪৪০০০ চাকরিপ্রার্থী। ইন্টারভিউ হয় ২৮ হাজার ৯০০ জনের। প্যানেল নাম ওঠে ২৪ হাজার চাকরিপ্রার্থীর।