Singur Movement: বুদ্ধদেবের ঘোষণা থেকে ন্যানোর গুজরাট-পাড়ি, ফিরে দেখা ঘটনাপ্রবাহ
Singur Movement: কলকাতা হাইকোর্টে মামলা। আদালত জানাল, বাম সরকার জমি অধিগ্রহণ করে ভুল করেনি। তবু অদম্য মমতা। টানা ১৫ দিন ধরনায়। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে অবরুদ্ধ। এবার একেবারে সিঙ্গুর থেকেই বিরোধিতা তৃণমূল সুপ্রিমোর।
কলকাতা: ২০০৬ সাল। বিপুল জনাদেশে জিতে ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যেদিন শপথগ্রহণ, সেদিনই ঘোষণা করলেন হুগলির সিঙ্গুরে টাটা মোটরস তাদের কারখানা করবে। সেই কারখানায় তৈরি হবে টাটাদের এক লাখের গাড়ি ‘ন্যানো’। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মোতাবেক শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। সিঙ্গুরে প্রায় ১ হাজার একর জমিতে কারখানা তৈরির কথা হয়।
ধিকি ধিকি আগুন জ্বলা শুরু
কৃষিনির্ভর সিঙ্গুরে কারখানা হলে কৃষকদের কী হবে? কৃষকরা কি ঠিকমতো জমির দাম পাবেন? বহুফসলি জমিতে কারখানা হলে চাষাবাদ যে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে- এরকম বহু আশঙ্কা-প্রশ্ন দানা বেঁধেছিল সিঙ্গুরের কৃষকদের একাংশের মনে। এই আশঙ্কা থেকেই শুরু হয় বিরোধিতা। মে মাসে টাটা মোটরসের প্রতিনিধিরা জমি পরিদর্শনে গেলে একপ্রস্থ বিক্ষোভও দেখান স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের বিরোধী শিবিরে। জুলাই মাসে কারখানার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে জমি অধিগ্রহণ শুরু হতেই সিঙ্গুরের বুকে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন।
মাস্টারমশাইয়ের নেতৃত্বে শুরু আন্দোলন
তখন তৃণমূলের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই তিনি। তাঁরই নেতৃত্বে মাঠে নামেন সিঙ্গুরের কৃষকরা। ক্রমেই জোরদার হতে থাকে ন্যানো বিরোধী আন্দোলন। এরপর ২৪ জুলাই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে স্তব্ধ করে চলে প্রতিবাদ। অগস্টে বিডিও অফিসে ঘেরাও। ২০০৬ এগোচ্ছে। এবার সেপ্টেম্বর মাস। বিরোধিতার আগুন আরও তীব্র।
এক লাখি গাড়ি চাননি কৃষকদের একাংশ
রতন টাটা ন্যানোর কারখানা ঘোষণা করে দিয়েছেন। দেশজুড়ে চর্চা। ১ লক্ষ টাকা বা তার থেকে কিছু বেশি দাম দিয়ে গাড়ি কেনার সুযোগ। মধ্যবিত্তের ঘরেও গাড়ি আসবে এবার। তার থেকেও বড় কথা, এমন বড় ঘোষণার বাস্তবায়ন হবে বাংলার মাটি থেকে, সিঙ্গুর থেকে। এদিকে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকরা কিছুতেই জমি ছাড়বেন না। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে একদিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নেমে পড়লেন কৃষকরা। সিঙ্গুরের গ্রামের লোকের সঙ্গে উর্দিধারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ। এতদিন কলকাতা থেকে সুর চড়ালেও এবার একেবারে ময়দানে নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জোর করে জমি নেওয়া যাবে না : মমতা
মমতার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, যাঁরা জমি দিতে চান তাঁরা দিন। কিন্তু কোনও কৃষক জমি দিতে না চাইলে, কোনওভাবেই তাঁকে জোর করে জমি নেওয়া যাবে না। রাতারাতি আন্দোলনের ঝাঁঝ তুঙ্গে। জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতায় সিঙ্গুরের কৃষকদের নিয়ে ধরনায় বসলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে তৃণমূলের নেতারা। মেয়ো রোডে মমতার অনশন। দিল্লিতে পৌঁছল বাংলার খবর। ২৫ দিন টানা অনশন তৃণমূল সুপ্রিমোর। ২৬ দিনের দিন ভাঙলেন অনশন। ১৫ দিন ধরে অবরুদ্ধ দুর্গাপুর। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। মমতাকে চিঠি লিখলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও। ওদিকে বিরোধিতার প্রশ্নে অনড় মমতা।
‘কারখানা হচ্ছে না’ : রতন টাটা
কলকাতা হাইকোর্টে মামলা। আদালত জানাল, বাম সরকার জমি অধিগ্রহণ করে ভুল করেনি। তবু অদম্য মমতা। টানা ১৫ দিন ধরনায়। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে অবরুদ্ধ। এবার একেবারে সিঙ্গুর থেকেই বিরোধিতা তৃণমূল সুপ্রিমোর। ২০০৭ এর পর ২০০৮-ও চলল বিরোধিতায়। ২০০৮ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট জমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয়। সেই জুনেই ন্যানো কারখানার গেট ভাঙেন আন্দোলনকারীরা। মমতা গর্জে ওঠেন, অনিচ্ছুক কৃষকদের ৪০০ একর জমি ফেরাতেই হবে। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর। রতন টাটা ঘোষণা করলেন সিঙ্গুরে তাঁরা প্রকল্প করছেন না। ৭ অক্টোবর ঘোষণা করা হল সিঙ্গুরের প্রস্তাবিত কারখানা যাচ্ছে গুজরাটের সানন্দে। সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ক্ষমতায় তৃণমূল সরকার
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গড়ল বাংলায়। ৩৪ বছরের বাম রাজত্ব শেষ। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই সিঙ্গুর আন্দোলনই বাংলার রাজনৈতিক পটবদলের অন্যতম অনুঘটক। সে বছরই জুনে কৃষকদের জমি ফেরানোর কথা ঘোষণা করল মমতার সরকার। ১৩ জুন বিধানসভায় পাশ হল ‘সিঙ্গুর বিল’। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে টাটা মোটরস গেল হাইকোর্টে। সরকারের পক্ষেই থাকল রায়। এরপর সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৬ সালের ৩১ অগস্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দিল, ‘সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ অবৈধ’। সে বছরের অক্টোবরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি ফেরালেন কৃষকদের, পাট্টা দিলেন। জমিতে ছড়ালেন ফসলের বীজ। বললেন, ‘জমি যার লাঙল তার’।
টাটা মোটরসের মামলা
ভিন রাজ্যে কারখানা গেলেও সিঙ্গুরে কারখানা না হওয়ার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছিল টাটা মোটরস। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আরবিট্রাল ট্রাইবুনালে দীর্ঘদিন ধরে সে মামলা চলছিল। সেই মামলায় রায় দিয়েছে তারা। সিঙ্গুরে কারখানা না হওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের থেকে ৭৬৫.৭৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করবে টাটা মোটরস। এছাড়াও ২০১৬ সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ থেকে ক্ষতিপূরণ শোধ না হওয়া পর্যন্ত বার্ষিক ১১ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে রাজ্য সরকারকে। তিন মাসের মধ্যে টাকা দিতে হবে রাজ্যকে।