আলাপনকে ধরে রাখতে সুকৌশলী মমতা, এক ঢিলে মারলেন দুই পাখি

বিতর্কিত এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তির পর রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, ক্ষুরধার চালে কার্যত এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

আলাপনকে ধরে রাখতে সুকৌশলী মমতা, এক ঢিলে মারলেন দুই পাখি
অলংকরণ-অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Updated on: May 31, 2021 | 8:09 PM

কলকাতা: আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাসে কোনও আমলার নাম এতবার চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে কি না, সেটা মনে করতে পারছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশ। বিগত সপ্তাহখানেক সময় ধরে পশ্চিমঙ্গের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যসচিবকে নিয়ে যেভাবে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে দড়ি টানাটানি হয়েছে, তা এককথায় নজিরবিহীন বললেও কম হয়। তবে শেষ পর্যন্ত গোটা বিবাদের যবনিকা আজ, অর্থাৎ ৩১ মে বিকেলে পতন হয়ে গিয়েছে। আর বিতর্কিত এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তির পর রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, ক্ষুরধার চালে কার্যত এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব করলেন মমতা? সেই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার আগে একবার দেখে নেওয়া প্রয়োজন বিগত কয়েকদিনে আলাপন কীভাবে রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলেন।

ফ্ল্যাশব্যাক

আজকের দিনেই মুখ্যসচিবের পদ থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু রাজ্য বর্তমানে যে কোভিড পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, তা সামলানোর জন্য একজন দক্ষ আমলা প্রয়োজন। এই মর্মে আলাপনের মেয়াদ বৃদ্ধি করার দাবি জানিয়ে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেন মুখ্যমন্ত্রী। গত ২৪ মে একটি চিঠি লিখে কেন্দ্র জানায়, আবেদন মঞ্জুর করা হচ্ছে। মুখ্যসচিবের পদে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে আলাপনের।

তারপর রাজ্যে আঘাত হানে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। গত ২৮ অগাস্ট মুখ্যসচিবকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে বের হন মুখ্যমন্ত্রী। তারই মাঝে ইয়াসের রিভিউ বৈঠকে কলাইকুণ্ডায় আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারীর উপস্থিতির কারণে বৈঠক এড়িয়ে যান মমতা। যদিও মোদীর সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তুলে দেন মমতা। এরপর তাঁর অনুমতি নিয়েই দিঘায় চলে যান মুখ্যসচিবকে নিয়ে।

তারপরই সে দিন রাতেই রাজ্যের উপর পত্রবোমা হানে কেন্দ্র। আচমকা চিঠি দিয়ে জানানো হয়, ৩১ মে-র সকালে রাজ্য সরকারের থেকে অব্যাহতি নিয়ে দিল্লির নর্থ ব্লকে রিপোর্ট করতে হবে তাঁকে। কেন্দ্রের এহেন নির্দেশের তীব্র বিরোধিতা করেন মমতা। হাতজোড় করে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন, এই নির্দেশ যেন প্রত্যাহার করা হয়।

কেন্দ্র আপোসের পথে হাঁটেনি। মাথা নোয়াতে চাননি মমতাও। আজ সকালেই দিল্লিতে রিপোর্ট করার কথা থাকলেও নবান্নে চলে আসেন মুখ্যসচিব। স্পষ্ট হয়ে যায়, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশের তোয়াক্কা করছেন না। অন্যদিকে, নর্থ ব্লকে যোগ না দেওয়ায় শো-কজ করা হয় আলাপনকে। কিন্তু মমতা সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, তিনি আলাপনের মতো দক্ষ আমলাকে কোনও ভাবেই ছাড়ছেন না। আলাপন স্বেচ্ছায় অবসর নিচ্ছেন। কিন্তু আলাপনকে নিজের মুখ্য উপদেষ্টার পদে আনা হচ্ছে বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।

কীভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন মমতা?

আরও পড়ুন: রাজ্যের নতুন মুখ্যসচিব হলেন হরেকৃষ্ণ দ্বিবেদী, অবসর নিলেও বড় পদ পাচ্ছেন আলাপন

মমতা যে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নবান্ন-ছাড়া করতে চাননি, তা এ দিন ফের একবার স্পষ্ট করে দেন। কিন্তু তাঁর অবসরের সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে এক চালেই দু’টো কিস্তি মাত করেছেন মমতা। প্রথমত, আলাপনকে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে পেরেছেন। অবসর নেওয়ার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে এখন বস্তুত আর কোনও পদক্ষেপ করতে পারবে না কেন্দ্র। অবসর না নিয়ে তাঁকেই মুখ্যসচিব পদে বহাল রাখা হলে বিষয়টির জল আদালত পর্যন্ত গড়াতো। তখন বিতর্ক বাড়ত বই কম হত না।

দ্বিতীয়ত, মুখ্যসচিবের পদে না রাখলেও যেভাবে তাঁকে পাশে রাখতেন, এখনও আগের মতোই রাখতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যসচিবের মতো আমলা যেহেতু রাজ্যের আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর কার্যত শেষ কথা, সে ক্ষেত্রে প্রশাসন পরিচালনার বিষয়ে প্রায় পুরোটাই তাঁদের উপরই নির্ভর করেন মুখ্যমন্ত্রীরা। এ ক্ষেত্রে মুখ্যসচিবের পদে না থাকলেও, উপদেষ্টার পদে থাকার ফলে আগামী ৩ বছর আগের মতোই আলাপনের সহায়তা পাবেন মুখ্যমন্ত্রী। এবং তিনি এখন শুধুমাত্র রাজ্য সরকারের একজন আধিকারিক হয়ে রইবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলাপনের শুধু পদটাই বদলে গেল, কাজ নয়। সুতরাং মমতা যেটা চেয়েছিলেন সেটা তো হলই, উল্টে কেন্দ্রের সঙ্গে বিবাদ এবং দ্বন্দ্বের জল বেশি দূর গড়াল না। যা রাজ্যের জন্য ইতিবাচক বলেই জানাচ্ছে প্রাক্তন আমলা মহল।

আরও পড়ুন: নারদ মামলা অন্য রাজ্যে সরানোর দাবি কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? হাইকোর্টে প্রশ্ন রাজ্যের