‘বিশ্ব বাংলা’ থেকে ‘অশিক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী’- মুকুলের যে সব তিরে বিদ্ধ হয়েছিলেন মমতা
শিবির বদলে যায়, কিন্তু মন্তব্যগুলো রয়ে যায়। 'নরমপন্থী'দের তালিকায় থাকা মুকুলও (Mukul Roy) একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন তৃণমূল নেত্রীর বিরুদ্ধে।
কথায় বলে, ধনুকের তির আর মুখের কথা নাকি একবার বেরোলে আর ফেরানো যায় না। তবে রাজনীতির জগতে মন্তব্যগুলো ভুলে যাওয়া যায় সহজেই। আজ, শুক্রবার বাংলার রাজনীতি সাক্ষী থাকল এক বড়সড় পালা বদলের। তৃণমূলে ফিরলেন মুকুল রায়। তাঁকে দলে স্বাগত জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ভোটের সময় মুকুল রায় তৃণমূল সম্পর্কে কোনও কু-কথা বলেননি। আর দলে ফেরানোর ক্ষেত্রে সেটাই তৃণমূলের অন্যতম যুক্তি। সেই যুক্তিতে মমতা ‘নরমপন্থী’দের দলে ফেলেছেন মুকুল রায়। তবে প্রায় সাড়ে তিন বছর গেরুয়া শিবিরে থাকাকালীন তৃণমূলকে আক্রমণ করতে পিছপা হননি মুকুল রায়। প্রয়োজনে তৃণমূল নেত্রীকেও আক্রমণ করেছেন। বিশ্ব বাংলার লোগো নিয়ে অভিষেকের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। ডিজিটাল দুনিয়ায় সোশ্যাল প্লাটফর্মে ঘুরে-ফিরে আসে সে সব মন্তব্য।
‘বিশ্ব বাংলা সরকারের প্রতিষ্ঠান নয়, এটা একটা কোম্পানি, মালিকের নাম অভিষেক’
বিজেপিতে গিয়েই এই ইস্যুতে মমতা-অভিষেকের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছলেন মুকুল। তাঁর দাবি ছিল বিশ্ব বাংলা রাজ্য সরকারের কোনও প্রতিষ্ঠান নয়, এই বিশ্ব বাংলার লোগোর মালিক নাকি অভিষেক। আর সেই বিশ্ব বাংলাই যখন বিশ্বকাপ ফুটবল স্পনসর করেছিল, তখনও সরব হয়েছিলেন মুকুল। কাগজ দেখিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে, জনসভায় আক্রমণ করেছিলেন তিনি। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত।
‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি’
মমতার দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা মুকুল। বাংলায় বিরোধী হিসেবে সব আন্দোলনেই মমতার পাশে ছিলেন তিনি। তৃণমূলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও তিনি। বিজেপিতে যোগ দিয়ে সেই মুকুল বলেছিলেন, তৃণমূলে ‘পাপ’ করেছেন তিনি আর বিজেপিতে এসে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করছেন। খড়গপুরের এক জনসভা থেকে তিনি বলেন, ‘মমতার যে সব দুর্বলতা আছে, সেগুলো ঢেকে রেখে আমরা মমতাকে ‘মমতা’ করেছি। আজ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে সারা বাংলা ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাংলায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম না করা অবধি পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে না।
‘অশিক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী’
ভোটের সময় মুকুলের মুখে কড়া আক্রমণ শোনা যায়নি ঠিকই। বরং বিধানসভা নির্বাচনে কিছুটা চুপচাপই ছিলেন বাংলার রাজনীতির ‘চাণক্য।’ তবে আক্রমণ করতে গিয়ে মমতাকে ‘অশিক্ষিত’ও বলেছেন তিনি। একসময় এক সভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এমন অশিক্ষিত মুখ্যমন্ত্রী আর দেখেছেন? বলে দিলেন গান্ধীজির অনশন ভাঙাতে নাকি রবীন্দ্রনাথ জল নিয়ে গিয়েছিলেন। এত বড় অশিক্ষিত আর দেখিনি।’
‘বিদেশ থেকে মাথায় করে শিল্প আনবেন’
এক জনসভা থেকে মুকুল বলেছিলেন, ‘মমতা বলেন কৃষি আর শিল্প হল হাসি আর খুশি। ‘হাসি’ তো কোথায় উড়ে গিয়েছে, ‘খুশি’ও আর নেই।’ মুকুলের সেই মন্তব্যে গেরুয়া জনসভায় তখন হাততালির ঝড়। তারপরই বিদেশযাত্রা নিয়ে মমতাকে কটাক্ষ করেন তিনি। বলেন, ‘আগে যখন বুদ্ধবাবুরা বিদেশ যেতেন তখন মমতা কটাক্ষ করে বলতেন গরমকালে হাওয়া খেতে যাচ্ছে। আর এখন দেখি শিল্প আনতে মাঝেমধ্যেই মমতা বিদেশ যাচ্ছেন। আবার একা যাচ্ছেন না। সঙ্গে ৪০-৪২ জন লোককে নিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ অফিসারকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? উনি কি মাথায় করে শিল্প আনবেন?
‘পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাস তৈরি করেছেন মমতা’
রামনবমী ঘিরে বাংলায় অশান্তি। আর তাতেই মমতার পরিকল্পিত সন্ত্রাসের ছায়া দেখেছিলেন মুকুল রায়। বলেছিলেন, ‘তৃণমূল কখনও রামনবমী করেনি। হঠাৎ কেন করল?’ আর যখন অশান্তি চলছে তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে উনি দিল্লি চলে গেলেন।
‘মেট্রো ডেয়ারিতে কত টাকা খেয়েছেন?’
কিছুদিন আগেও সামনে এসেছিল এই মেট্রো ডেয়ারি দুর্ণীতির অভিযোগ। সংস্থা থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে। একসময় মুকুল বলেছিলেন, ‘মেট্রো ডেয়ারি বিক্রি করে মমতার দল কত টাকা কাটমানি খেয়েছে, তার বিচার হোক। সবথেকে বড় বিলগ্নিকরণের মাস্টার মমতা। উনি বলুন কত টাকা খেয়েছে তৃণমূল?
‘মমতা ব্যানার্জির মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে’
ভোটের আগে প্রচারে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘আমি তো বলব শুভেন্দুর চেয়ে মুকুল ভাল।’ কেন মুকুলকে কৃষ্ণননগরে টিকিট দেওয়া হল, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন মমতা। আর এ সব শুনে মুকুলের মন্তব্য ছিল, ‘আমি এমন অনেক কিছুই শুনেছি, জবাব দিই না, দেবও না, মমতা ব্যানার্জির মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে।’
‘সিপিএম আর মমতার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই’
ক্ষমতায় আসার পর একাধিকবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছেন মমতা। সেই প্রসঙ্গে মুকুলের মত ছিল, ‘মমতা নিজের লড়াই থেকে সরে গিয়েছেন। বুদ্ধ ভট্টাচার্যকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ভুলে গেলেন এক দিন বুদ্ধবাবুর বাড়ি ঘেরাও করতে গিয়েছিলেন। সিপিইএম আর মমতার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।
‘ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে আর, নাচা-গানা করছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী’
২০১৭-র ১১ নভেম্বর। মুকুল তখন পদ্ম শিবিরে পা রেখেছেন সদ্য। সে দিন ছিল শহরে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন। আর তার কয়েক ঘণ্টা আগেই সমাবেশ থেকে মুকুল বলেন, ‘২০০৭-এ মানুষ মারা যাচ্ছিল। আর এক দিকে চলচ্চিত্র উৎসবে ঘণ্টা বাজাতে হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আজই সেই একই দৃশ্য। শুধু মানুষটা পাল্টে গিয়েছে। ডেঙ্গিতে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, আর নাচা-গানা-খাওয়া, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’
‘পাল্টে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’
আক্রমণ তো ছিলই, কখনও কখনও আক্ষেপও করতেন তিনি। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর প্রথম সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘পাল্টে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’ সদ্য ছেড়ে আসা পুরনো শিবির সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, তৃণমূলে কোনও গণতন্ত্র নেই। দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মমতাকে সরাসরি নিশানা করে মুকুল বলেন, ‘আপনার যদি সরকার চালানোর অধিকার থাকে, আমারও সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে।’