শঙ্খ ঘোষ আলতো করে আমার কাঁধে হাত রেখে সুন্দর হাসি উপহার দিলেন

আমরা মানুষের বাইরেটাই দেখি, ভেতরের দিকে কখনও নজর দিই না। তিনি ক্রমশ যেন ভেতরের দিকটা আমার কাছে প্রকাশ করলেন। আমি দেখলাম, তিনি একজন অদ্ভুত স্নেহময় পুরুষ।

শঙ্খ ঘোষ আলতো করে আমার কাঁধে হাত রেখে সুন্দর হাসি উপহার দিলেন
শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিচারণে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
Follow Us:
| Updated on: Apr 21, 2021 | 10:44 PM

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়: আমি যখন ছাত্রজীবন শেষ করে সবে লেখার জগতে প্রবেশ করেছি, সেই সময় শঙ্খ ঘোষ আমার প্রিয় কবি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি কোথায় থাকেন, তাঁর স্ট্যাটাস কী– এসব আমার জানার প্রয়োজন ছিল না। কারণ লেখাই বড়। আমি তাঁর ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতাটি অনর্গল পড়তাম। কখনও আমার লেখায় উদ্ধৃত করতাম। খুব আনন্দ পেতাম এই মনে করে যে আমার লেখার সঙ্গে তাঁর চিন্তার কোথাও একটা যোগসূত্র রয়েছে! যদিও তিনি আমার থেকে অনেক বেশি উচ্চতায় অবস্থান করতেন। তাই আমি সবধানে নিজেকে সরিয়ে রাখতাম। আমরা মানুষের বাইরেটাই দেখি, ভেতরের দিকে কখনও নজর দিই না। তিনি ক্রমশ যেন ভেতরের দিকটা আমার কাছে প্রকাশ করলেন। আমি দেখলাম, তিনি একজন অদ্ভুত স্নেহময় পুরুষ। বড়-ছোট যে কোনও মানুষকেই আপন করে নিতেন।

একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি, তিনি আমার পাশের আসনে এসে বসলেন। আলতো করে আমার কাঁধে হাত রেখে এত সুন্দর একটা হাসি আমাকে উপহার দিলেন– যা আমি আজও ভুলিনি। সেই অনুষ্ঠানে আমরা দু’জনেই সংবর্ধিত হয়েছিলাম। সেবারই তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা। মনে মনে এই ভেবে আশ্বস্ত হলাম– তিনি বুঝি আগে আমার নাম শুনেছেন। আমার লেখা হয়তো তিনি সামান্য উল্টেপাল্টে দেখেছেন। ওই মুহূর্তে আমার পাশে বসে তিনি এত আপনজনের মতো ব্যবহার করলেন যে, আমার মনে হল তিনি একজন সুন্দর কোমল মনের মানুষ এবং একজন আদ্যোপান্ত বাঙালি। তিনি এই বাংলার সার্থক প্রতিরূপ।

এরপর অক্সফোর্ডের একটা সভায় আবার তাঁকে দেখলাম। তিনি সকলের থেকে দূরে আলাদা বসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হল বেটে! আমি ভেবেছিলাম ওনার বক্তব্য শেষ হলে উনি চলে যাবেন। তারপর আমার বক্তব্য শুরু হবে। কিন্তু দেখলাম উনি খুব সুন্দর ভাবে জমিয়ে বসলেন। আমি উদ্যোক্তাদের জিগ্যেস করলাম– শঙ্খবাবু কি থাকবেন? সেই উদ্যোক্তা আমাকে জানালেন– “স্যার বলেছেন যতক্ষণ সঞ্জীবের বক্তৃতা শেষ না-হবে ততক্ষণ আমি থাকব। কারণ আমি ওঁর বক্তৃতা শুনতে ভালবাসি।” একথা শুনে আমার অত্যন্ত আনন্দ হয়েছিল। ওনার মতো একজন মানুষ আমার বক্তব্য পছন্দ করেন! আমার বক্তব্যের মধ্যে অনেক রসিকতা থাকে। আমি দেখলাম ওনার মতো গম্ভীর মানুষও মুচকি হাসছেন!

আরেকবার পয়লা বৈশাখে দে’জ পাবলিশিংয়ের সামনের ঘটনা। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। উৎসব ঝিমিয়ে আসছে। পাশে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গাড়িতে উঠবেন। সামনের রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। আমি এক পা এগোতেই উনি হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। যেন আমি না পড়ে যাই! কোথায় আমি ওনাকে সাহায্য করব তা না, উনি আমাকে সাহায্য করতে লাগলেন। আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজের গাড়িতে ফিরে গেলেন। কত বড় মানুষ হলে এরকম করতে পারেন!

পরপর কয়েকটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে। এমনও শুনেছি, তিনি আমার বক্তব্য শোনার জন্য এসেছেন। এই যে ভাললাগা– ঘটনাগুলো আমার সঞ্চয়ে রইল। আমিও তো একদিন তাঁর পথেই যাব! তখন হয়তো আবার দেখা হবে দু’জনের। এরকম একটা ভাবনা আমার মনে ঘোরাফেরা করছে আর নিজেকে বড় একা লাগছে। আস্তে আস্তে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতটা কীরকম শূন্য হয়ে যাচ্ছে। বাঙালির তো আর গর্ব করার মতো কিছু থাকল না। আমরা এখন শেষের পর্যায়ে আছি। সেই সময় এমন একটা স্তম্ভ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল!

আমি তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। পরে যদি কোথাও জন্ম হয় যেন একসঙ্গে জন্মাতে পারি। একই এলাকায় যেন জন্ম হয় আমাদের দু’জনের। আবার তিনি লিখবেন আবার আমি পড়ব। আবার তিনি হাসবেন এবং আমি উপভোগ করব। আমি তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়াকে কীভাবে সহ্য করব বুঝতে পারছি না। আমি প্রার্থনা করি তিনি যেখানেই থাকুন আনন্দে থাকুন। তিনি যেরকম আনন্দে এই মর্তে বিচরণ করেছেন, সেরকম আনন্দেই তিনি যেন সব সময় থাকেন। তাঁর যে অবয়ব সেটাকে আমি চিরকাল চোখ বুজে স্মরণ করব। আমার ডায়েরিতে তাঁর চলে যাওয়ার দিনটি আন্ডার লাইন করে রাখব। বারে বারে দেখব আর তাঁর কথা ভাবব। একা হয়ে যাচ্ছি, ক্রমশ একা।