Subrata Mukherjee: ‘মৃত্যুর পর দেহটা পড়ে থাকে, আত্মা পাঁচিলের উপর বসে বসে দেখে আর কাঁদে’

Subrata Mukherjee: "শোনো আমি ভূতে বিশ্বাস করি, আর আধা ঘণ্টা সময় দিলে এমন করে বোঝাব যে তুমিও বিশ্বাস করবে।''

Subrata Mukherjee: 'মৃত্যুর পর দেহটা পড়ে থাকে, আত্মা পাঁচিলের উপর বসে বসে দেখে আর কাঁদে'
ভূতে ভয় পেতেন আবার ভূতের গল্প বলতে ততটাই উৎসাহী। অলংকরণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 05, 2021 | 3:34 PM

সৌরভ গুহ: স্মৃতির তোড়ে কথা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। কী দিয়ে যে শুরু করি… আপনিই বলুন না সুব্রতদা । হাসছেন আপনি? হাসি উপচে পড়ছে। চোখ দুটো কুঁচকে আপনি হেসেই চলেছেন। আর বলছেন, “শুরুর কতাই যদি বলবে তো আমার কাচেই জিজ্ঞাসা কর, এ শহরের যত বান্দা দেক, আমি সবার খবর জানি। আমি হলাম গে ভূষণ্ডির কাক। কি বুচলে?” বলেই আবার হাসি। আবার কথার ফোয়ারা ছোটালেন। “শোনো আমি ভূতে বিশ্বাস করি, আর আধা ঘণ্টা সময় দিলে এমন করে বোঝাব যে তুমিও বিশ্বাস করবে।” আপনার ভূতে অটল বিশ্বাস। সেই এমারজেন্সির সময় মহাকরণের করিডরে নাকি আপনি ভূত দেখেছেন! তার পর থেকে তো রাতে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ঘুমোনো অভ্যেস-ই করে ফেলেছেন।

আপনি স্মৃতির ঝুলি থুড়ি ভূত দেখার গল্পের ঝুলি উপড় করতে নিজেই আগ্রহী। তবু আমি বললাম, ‘থাক ছেড়ে দিন’। আপনি ছাড়ার পাত্র নন। সটান বললেন, “ছাড়ব কেন? ওসব ক্যামেরা রাখো, যা বলি শোনো…।” শুরু হল আপনার ভূত দেখা আর ভূতে বিশ্বাসের গল্প। সেই খ্যাসখ্যাসে ট্রেডমার্ক গলায় একটু রহস্য আনতে চাইলেন। “শোনো, আত্মা কখনও মরে না। মৃত্যুর পর যখন দেহটা পড়ে থাকে তখন আত্মা পাঁচিলের ওপর বসে বসে দেখে। কাঁদে দেহ টাকে দেখে।” কীসব!

কালী পুজোর রাতেই আপনার অসাড় শরীরটা যখন হাসপাতাল থেকে বের করে আনা হচ্ছিল, আমি চারিদিকে তাকাচ্ছিলাম। আমার ভূতে অবিশ্বাসী মন হঠাৎ ভাবছিল, ভূত-প্রেত পরজন্মে প্রবল বিশ্বাসী আপনি নিশচয়ই বসে বসে কাঁদছেন জীবনটা ফুরিয়েই গেল তাহলে সুব্রতদা! আহা কত সাধের জীবন। নিজেই তো বলতেন “আমার জীবনটা কিন্তু রূপকথার মতো, তাই না?” হ্যাঁ রূপকথাই তো বটে।

বাটানগরের সারেঙ্গাবাদ থেকে গড়িয়াহাট। মাঝখানে ইতিহাসের ওঠা-পড়ার সাক্ষী হয়ে বয়ে যাওয়া এই পরিক্রমা তো রূপকথাই বটে। সেই জীবন এখন লাশ সুব্রতদা? সুব্রতদা আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন? নিজেকে দেখে আপনি কি কাঁদছেন সুব্রতদা? আপনার তো কান্না দেখা হল না! আপনার বিশ্বাস নিয়ে আপনি চলে গেলেন। আপনার সঙ্গে সঙ্গে অসমাপ্ত থেকে গেল এক কথকের আখ্যান। এক ফেলে আসা সময়ের জ্যান্ত কথক ছিলেন যে আপনি। আপনার একডালিয়া এভারগ্রিনের পুজো, মাঞ্জা দিয়ে পাটে পাটে ধুতি, কথায় কথায় ঐতিহ্যের দোহাই পাড়া, বাঙালির মরচে ধরা বহু অভ্যাসকে যে সযত্নে লালন করে চলা আপনি চলে গেলেন! ২০২১ সালের দীপাবলির রাতে একটা সময়, একটা যুগেরও অবসান হল আপনার সঙ্গে। সে দিনের গল্প আর কে শোনাবে সুব্রতদা?

আপনার ছাত্রজীবন, আপনাদের আন্দোলন, মূল্যায়ন, প্রশাসক হিসাবে আপনার কাজ, মন্ত্রী হিসাবে… সে তো এক বিরাট সফর। সে ভার বইবে সময়। আপাতত ওই রূপকথার গপ্পো আরেক বার হয়ে যাক সুব্রতদা? রাজি? অমনি ঘাড় নেড়ে দিলেন। ঝুড়ি উপুড় করে ‘গপ্পো’ না করলে আপনার তো আবার চলে না। আচ্ছা, সুচিত্রা সেন তাঁর বাড়িতে নিজের হাতে রেঁধে কোন পদ খাইয়েছিলেন? জীবন ছেড়ে যাবার সময় সেই স্বাদটা মনে পড়ছে? কিংবা ওই যে ওই এক রোদধোয়া দুপুরে সাদা সালোয়ার কামিজে হেঁটে যাওয়া মুনমুন সেনকে প্রথম দেখার মুগ্ধতা, যা আপনি অকপট বলে বেড়াতেন। মনে পড়ছে না? আর ইন্দিরাজির সঙ্গে কপ্টারে উঠে কী বিপদেই না পড়েছিলেন বলুন তো। কপ্টারে পাশে বশা ইন্দিরাজির প্রশ্ন আর থামে না… “এটা কী নদী? ওটা কি নদী না শাখা?” মহা ফ্যাসাদে পড়েছিলেন আপনি। শেষে পশ্চিমবঙ্গের ভূগোল বইতে পড়া যে ক’টা নদীর নাম জানেন, প্রায় সব আন্দাজে বলে গিয়েছিলেন একটার পর একটা। পরে নিজেই সে কথা শোনাতেন ঠোঁটের কোণায় সেই মৃদু হাসিটা রেখে। কী কান্ড তাই না? আপনার ঠোঁট চেপে সেই হেসে ওঠার দৃশ্যগুলো আজ বারবার মনে পড়ছে।

ইন্দিরাজি। অথচ, ইন্দিরাজি-র কথা টাই আপনি রাখলেন না। রাখলেন তো জ্যোতি বসুর কথা টাই। ইন্দিরাজি চাইছিলেন আপনি সাংসদ হয়ে দিল্লির রাজনীতি করুন। সেবারতো একেবারে নাছোড়বান্দা যাকে বলে। চারদিকে লেখালেখি আপনি এমপি ইলেকশনে দাঁড়াবেন। বিধানসভায় গিয়েছেন। হঠাৎ আর্দালি এসে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী ডাকছেন। ‘জ্যোতি বসু? আমাকে? হঠাৎ!’ আপনি আকাশ থেকে পড়লেন। তার পরই ছুটে গেলেন রাশভারী মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে। আপনাকে চমকে দিয়ে জ্যোতি বসু বলে উঠলেন, “শুনলাম নাকি এমপি হচ্ছেন?” আপনি তখন ইতস্তত বোধ করছেন। দেখে জ্যোতি বাবু হেসে বলেছিলেন, “ডঃ রায় আমরা হতে পারতাম না? পারতাম, কিন্তু হইনি। শুনুন মশাই, মানুষের কাজ করতে গেলে বিধায়ক হয়ে কাজ করুন, সাংসদ না। ব্যাস আপনিও নাকচ করে দিলেন প্রস্তাব!

ইন্দিরাজি কত রেগে গিয়েছিলেন বলুন তো! শেষে বেলুড় মঠের ভরত মহারাজের পাঠানো প্রসাদ দিল্লি পৌঁছে মানভঞ্জন করেছিলেন আপনি। আজ মনে পড়ছে? এত সব গল্পের জমাটি আসরটা ছেড়ে আপনি হঠাৎ ধাঁ করে কোথায় রওনা দিলেন বলুন তো? তবু এ কথাও আজ মেনে নিতেই হবে, বিধানসভা, গড়িয়াহাটের বাড়ি, দফতর, একডালিয়া কোথাও আর আপনি নেই। কোথাও না? এক্কেবারে উধাও! ভাবা যায় সুব্রতদা?

আরও পড়ুন: Subrata Mukherjee: সুব্রত-কথা: ক্রুদ্ধ মমতার গর্জন ‘তোমাকে আর নেব না, নেব না, নেব না…’