Subrata Mukherjee: সুব্রত-কথা: ক্রুদ্ধ মমতার গর্জন ‘তোমাকে আর নেব না, নেব না, নেব না…’

Subrata Mukherjee: সেই সুব্রতদাকেও ফের ফিরতে হয়েছিল তৃণমূলে। আর মমতাও 'নেব না' বলে শেষপর্যন্ত ফিরিয়ে-ই নিয়েছিলেন। সব সত্যি লিখে দিয়েছিলাম। তবু আঁতে লাগেনি সুব্রতদার। কালীঘাটের সাংবাদিক বৈঠকেও সেই সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠেছিল তৃণমূল নেত্রীর সামনেই।

Subrata Mukherjee:  সুব্রত-কথা: ক্রুদ্ধ মমতার গর্জন 'তোমাকে আর নেব না, নেব না, নেব না...'
অলংকরণ: অভীক দেবনাথ
Follow Us:
| Edited By: | Updated on: Nov 05, 2021 | 4:07 PM

রাজা চট্টোপাধ্যায়: ৩১ মে ২০২১। একদম সকাল সকাল আমার হোয়াটসঅ্যাপে সুব্রত দার ‘সুপ্রভাত’। সঙ্গে আবার গোলাপি ফুলওয়ালা একটা গাছের ছবি! এই রে, শেষে সুব্রতদারও সকাল-সন্ধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে ‘Good Morning’ ‘Good Night’ মেসেজ পাঠানোর অভ্যাস হল নাকি?

না, তেমন কিছুই হয়নি। ওই একদিনই। কারও কাছে পাওয়া ছবিটি হোয়াটসঅ্যাপে ফরওয়ার্ড করেছিলেন ওই একবারই। দলের ভোটকুশলীর পাল্লায় পড়ে এই সব অ্যাপ ব্যবহার করার তাগিদ জেগেছিল হয় তো বা। তবে ভার্চুয়াল নয়, সুব্রতদা মুখোমুখি বসে জমিয়ে ‘গালগপ্পো’ করতে অভ্যস্ত ছিলেন।

জমাটি গল্প মানেই সুব্রতদা। কাজ করতেন ঢের কিন্তু সদাব্যস্ত কাজ-কাজ ভাব করতেন না। বিধানসভার ঘরে ফাইল সই করতে করতে এমন সব প্রসঙ্গ উঠত যার সবটা জনসমক্ষে আনলে লেখক এবং পাঠক উভয়কেই বিব্রত হতে হয়। সবটা নাই বা বললাম। অপ্রিয় সত্যি কথা বলতে বলতে সম্বিত ফিরলে মনে করিয়ে দিতেন, “কোনও দিন কোথাও বলে ফেল না যেন।”

চিরকেলে ফাঁসা গলায় যখন হাসির রোল তুলতেন মনে হত যেন বাচ্চা ছেলে। একবার কংগ্রেসের এক সতীর্থকে বলে ফেলেছিলেন, ‘অতৃপ্ত আত্মা’। সেটা মুখে মুখে রটে গেল সাংবাদিক আর রাজনৈতিক মহলে। তখন আমি একটা খবরের কাগজে চাকরি করি। সালটা ওই ২০১০ হবে। কলকাতা পুরভোটের আগে সুব্রতদা দ্বিতীয়বার তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন। অফিসে ‘কপি’ লিখতে বসলাম। হেডলাইন হল, ‘আবার দলবদল সুব্রতর, আসছে বছর আবার হবে!’ পরের দিন সকালেই আমার পুরনো অফিসের সম্পাদক মহাশয়কে ফোন। সরাসরি জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ডিকটেশন দিয়েছ আর রাজা লিখেছে, তাই না?’

আসলে আদি গঙ্গার পাড়ে ফিরে যাওয়ার আগে সুব্রতদাকে একটা সংকল্প ভাঙতে হয়েছিল। ২০০৫-এ মমতার সঙ্গে ঝগড়া করে বলেছিলেন, ‘আমি আর যাব না, যাব না, যাব না (TMC)।’ আর তৃণমূল নেত্রীর জবাব ছিল, ‘তোমাকে আর নেব না, নেব না, নেব না।’

সেই সুব্রতদাকেও ফের ফিরতে হয়েছিল তৃণমূলে। আর মমতাও ‘নেব না’ বলে শেষপর্যন্ত ফিরিয়ে-ই নিয়েছিলেন। সব সত্যি লিখে দিয়েছিলাম। তবু আঁতে লাগেনি সুব্রতদার। কালীঘাটের সাংবাদিক বৈঠকেও সেই সব অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠেছিল তৃণমূল নেত্রীর সামনেই।

৭৭’ এ বালিগঞ্জ হাতছাড়া হওয়ার পর সুব্রতদা ‘৮২- তে জোড়াবাগান বিধানসভায় ভোটে দাঁড়ান। সুব্রতদার মাথায় জোড়াবাগান নামটা ঢুকিয়েছিলেন অমর সিং। অমর তখন রাজনীতিতে শিক্ষানবিশ। সুব্রতদা গল্প করতেন, ‘অমর তখন ছায়াসঙ্গী আমার, জানো? বড়বাজারে বাবার তালার দোকানে বসত না অমর।’ ব্যবসা না দেখে সকাল নেই রাত নেই অমর সুব্রতদার সঙ্গেই সময় কাটাতেন। ওঁর কাছেই শুনেছি, “অমরের বাবা ভাবত, আমি ওর ছেলেটার মাথা খাচ্ছি।”

সুব্রতদা স্বীকার করতে দ্বিধা করতেন না যে জোড়াবাগান থেকে প্রথমবার সরলা মহেশ্বরীকে হারানোর বীজমন্ত্রটিও অমরই দিয়েছিলেন তাঁকে। জাতপাতের রাজনীতি না করলেও ‘৮২-তে সরলা মাহেশ্বরীকে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সিপিএম। জোড়াবাগানে মাহেশ্বরী বোর্ড ছিল খুব প্রভাবশালী। অমরের পরামর্শে সুব্রতদা শিল্পপতি কেকে বিড়লার শরণাপন্ন হন।

কেকে বিড়লা থাকতেন সুব্রতদার আদি কেন্দ্র বালিগঞ্জের অন্তর্গত গুরুসদয় দত্ত রোডে। সুব্রতদা তাঁকে ‘বাবুজি’ বলে ডাকতেন। গল্পের মাঝেই জেনেছিলাম খোদ কেকে বিড়লা সুব্রতদা কে জেতানোর জন্য জোড়াবাগানে দু’ দুটি প্রচার সভায় হাজির হয়েছিলেন।

মজার মানুষ সুব্রতদার কাছে ভূতের গল্পও তো কম শুনিনি। আমৃত্যু বিশ্বাস করতেন ভূত আছে। মানুষের গা ঘেঁষেই ভূতদের নীরব উপস্থিতি। তাই তো রাতে বেডরুমে আলো জ্বালিয়েই ঘুমোতেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

অন্যদের পরামর্শ দিতেন, ‘আমের সময় বেশি করে আম খাবে। রোজ দুটো-তিনটে করে আম খাবে।’ নিজেও তাই করতেন।

প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সিকে বেশি দিন ‘কভার’ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সুব্রতদার কাছে বহু ঘটনা শুনে শুনেই প্রিয়বাবুর সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে পেরেছিলাম।

ইয়ার-বান্ধবরা অনুরোধ করলে সুব্রতদার গলা নকল করে শোনাই মাঝেমাঝেই। একবার এক বিখ্যাত সাংবাদিকের বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে অন্যতম বক্তা সুব্রতদা কে মঞ্চে ডাকার সময় তাঁর ট্রেডমার্ক কণ্ঠস্বর নিয়ে একটা সরস মন্তব্য করে বসেছিলাম। সেখানে তখন প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। তবু আমার রসিকতায় একটুও রাগ করেননি সুব্রতদা। ঢের শিখেছি এই মানুষটির কাছে। সবকিছু বই পড়ে শেখা যায় না। এমন শিক্ষক-ও হাতেগোনা। প্রণাম রইল সুব্রতদা।

আরও পড়ুন: Subrata Mukherjee: ‘মৃত্যুর পর দেহটা পড়ে থাকে, আত্মা পাঁচিলের উপর বসে বসে দেখে আর কাঁদে’