RG Kar: ‘ওরা আমাকে টার্গেট করে নিয়েছিল, টিউব লাইট পর্যন্ত ছুড়েছে’
RG Kar: আমার একটাই প্রশ্ন পুলিশ আর মিডিয়া যদি টার্গেট হয়, তবে ডাক্তারদের কেন মারা হল। এরা কারা? এদের উদ্দেশ্যটাই বা কী ছিল? তিলোত্তমার বিচারই যদি চাইত, তাহলে হাসপাতাল ভাঙচুর করতে হল কেন? আমি তাদের বক্তব্যও নিয়েছি। তারা কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা নিয়ে ছিলেন না। বরং মদ্যপ ছিলেন। ছেলে, মেয়ে কাউকে ছাড়েনি ওরা।
লিমা চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা: মেয়েদের রাত দখল কর্মসূচি। আমার কাছে খবর ছিল, শুধু সাধারণ মানুষই নন, যেখানে এই ঘটনা ঘটেছে সেই আরজি করের ডাক্তার, পড়ুয়ারাও মিছিল করছেন। আরজি কর থেকে শ্যামবাজার অবধি মিছিল করবেন তাঁরা। তবে মিছিলটা শুরু হতে দেরি হচ্ছিল। কারণ এসএফআইও ওখান থেকেই একটা মশাল মিছিল করে। এসএফআইয়ের মিছিল শুরু হতেই ভিড় বাড়তে লাগল আরজি করের সামনে। এত ভিড় যে বেলগাছিয়া থেকে শ্যামবাজার হাঁটার অবস্থা ছিল না।
রাত সাড়ে ১১টার পর থেকে বাইরে যারা দাঁড়িয়েছিল হঠাৎ করে পুলিশকে গালিগালাজ করতে থাকে। মিডিয়াকেও গালিগালাজ শুরু করে। ওদের দাবি ছিল আরজি করের ভিতরে ঢুকবে। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ ঢুকতে দেয়নি। তবে ওখানে মেরেকেটে ১৫-২০ জন পুলিশ ছিল। অথচ হাজার হাজার মানুষ!
এরইমধ্যে মহিলা ডাক্তাররা তৈরি হচ্ছিলেন মিছিল বের করার। কিন্তু এত ভিড় যে সেখানকার পুরুষ ডাক্তাররা একটা মানববন্ধন করে মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন। রাত ১১টা ৫০-এর পর থেকে মারাত্মক পরিস্থিতি হয়ে গেল। পুলিশের গার্ড রেল রীতিমতো ভাঙতে শুরু হল। প্রচণ্ড আওয়াজ। ভাবা যায় না কী অবস্থা।
পুলিশের সঙ্গে ওখানকার পড়ুয়ারাও চেষ্টা করছিল, গার্ড রেলটা যাতে বাঁচানো যায়। কারণ, আর যাই হয়ে যাক আরজি করের পড়ুয়া, চিকিৎসকরা বারবারই চাইছিলেন কোনও অশান্তি, হিংসা যেন না হয়। হাসপাতালের কোনও ক্ষতি আমরা হতে দেব না। তাই ওই মব ভিতরে হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে পড়ুক, তা চাইছিলেন না।
পুলিশের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ওই গার্ড রেল বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন পড়ুয়ারাও। কিন্তু শক্তিতে ওই উন্মত্ত জনতার কাছে পুলিশ-চিকিৎসক পড়ুয়াদের সংখ্যা কিছুই না। কারণ বাকি পড়ুয়ারা মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আর এসবের মধ্যেই ওই গার্ড রেলটা উত্তেজিত জনতা মাথায় তুলে নেয়। একটা সময় মনে হল যেন জনসমুদ্রে গার্ড রেলগুলি ভাসছে।
সেই সময় পুলিশ ছিটকে যেদিকে পেরেছে পালিয়েছে। কারণ, ওই জমায়েত করা মানুষের হাতে লাঠি, বাঁশ, পেরেক লাগানো লাঠি, এমনকী থান ইট। প্রথমেই যেটা করল, ওরা মারতে শুরু করল। আমার সামনে পুলিশ ছিল ৪-৫ জন। ওদের ইট মারতে শুরু করল। ওরা সরে যেতেই আমি টার্গেট হয়ে গেলাম। আমিও পুলিশের পিছনে দৌড়চ্ছি।
যদিও সত্যিই ওরা প্রতিবাদী হতো, যদি তিলোত্তমার নৃশংস মৃত্যু ওদের রাগের কারণ হতো, তাহলে যে জায়গায় তিলোত্তমার জন্য প্রতিবাদ চলছে সেই জায়গাটা কেন ভাঙল? যে মঞ্চে বসে ডাক্তাররা প্রতিবাদ করছেন, সেটা আগে ভেঙেছে। চেয়ারগুলো তুলে মিডিয়া, পুলিশের দিকে ছুড়তে লাগল।
এরপরই ওরা দু’টো দলে ভাগ হয়ে গিয়ে একটা দল এমার্জেন্সির ভিতরে ঢুকে গেল। আরেক দল বাইরে পুলিশের গাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছু ভাঙতে শুরু করল। এমার্জেন্সির গ্রাউন্ড ফ্লোরে যে ঘরগুলো সেখানে ঢুকে লাইট ভাঙা শুরু করে। ওরা আসলে অন্ধকার করে হামলা চালাবে বলে এসেছিল। যাতে ওদের চেনা না যায়।
ভিতরে তখন কয়েকজন রোগীর চিকিৎসা চলছে। তারমধ্যেই ভাঙচুর শুরু করে। আমার দিকে টিউবলাইট পর্যন্ত ছোড়ে। একটুর জন্য বেঁচে যাই। প্রথমেই আমাদের ক্যামেরা ভাঙল। তারপর এমার্জেন্সি থেকে বের করার জন্য তাড়া করল। আমি বেরিয়ে আসি। লাইভ দিচ্ছি তখন। পুলিশ এলাকাছাড়া।
আধ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ শূন্য আরজি কর। আমি আবারও বুম নিয়ে রেডি হচ্ছি দেখে একজন এসে বলেন ছবি কিন্তু করবেন না। আমরা যেটা করছি, সেটা সাধারণ মানুষের দাবি। আমিও বলি, আমার কাছে তো ক্যামেরাই নেই ছবি করব কী দিয়ে? এরপর আমি বাথরুমে লুকিয়ে অফিসকে জানাতে থাকি কী পরিস্থিতি। জানাই, আমার উপর অ্যাটাক হতে পারে।
ওদের টার্গেট ছিল থার্ড ফ্লোর। কিন্তু ওদের তিন তলা আর থার্ড ফ্লোরের কনফিউশন হয়। ওরা ভেবেছিল তিনতলাতেই সেমিনার রুম। তাই তিনতলা অবধি তাণ্ডব চালিয়েছে। চতুর্থ তলে সেমিনার রুমটায় ওরা যায়নি। এরপর যাকে যেখানে দেখছে অ্য়াটাক করছে।
আমি ততক্ষণে ট্রমা সেন্টারের বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটতে থাকি। গিয়ে দেখি সেখানে সব পুলিশ, চিকিৎসক, নার্সরা দাঁড়িয়ে। পুলিশ লুকিয়ে বসে আছে। ছোট্ট একটা তালা গেটে। ভাবলাম এই তালা ভাঙা তো কোনও ব্যাপারই না। এরপর সেভেন্থ ফ্লোরে চলে যাই। সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন আমার সঙ্গে ছিল।
আমাকে বলছিলেন মোবাইল সাইলেন্ট করুন, কোনওভাবেই কেউ যেন জানতে না পারে আমরা এখানে আছি। একইসঙ্গে বলছিলেন, অ্যাটাক হলে আমরাও চুপ থাকব না। আমাদেরও মারতে হবে। কিন্তু আমি পেশায় একজন সাংবাদিক। আমি খবর করি। কীভাবে কারও উপর হাত তুলব? ওনারা বলছিলেন, আপনার হাতে বুমটা দিয়ে মারবেন। কিন্তু এই বুম আমাদের হাতিয়ার ঠিকই, তবে সেটা মানুষের কথা বলার জন্য।
সত্যি বলতে আমার মধ্যে প্রাণভয় কাজ করছিল। কোনও চেনা মুখ নেই। যে যেখানে পেরেছে লুকিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসি। দোতলায় এসে শুনতে পাই আমার যিনি ক্যামেরা পার্সন বলছেন বাইরে কাঁদানে গ্য়াস ছুড়ছে। আর আমাকে টার্গেট করা হয়েছে। কিছুতেই যেন না বেরোই।
আমি নিজে চোখে দেখেছি তিনবার আমার দিকে আঙুল তুলে কিছু বলছিল। সে সময় আমি ভাবিইনি, তবে এবার আমারও একটা ভয় হচ্ছিল। প্রাণের ভয় হচ্ছিল। আমি সাড়ে ১০টা থেকে লাইভ দিচ্ছিলাম, সেটা দেখেছে ওরা। আর টিভিনাইন বাংলার প্রতি ওদের তো ক্ষোভ আছেই। একদল চায় তিলোত্তমার সঙ্গে কী হয়েছে তা সামনে না আসুক। বুধবার রাতে সেই একদল তো নিশ্চিত ওখানে ছিল।
এভিডেন্স ট্যাম্পার করাই ওদের টার্গেট ছিল। কিছু পরে বাইরে এলাম। যে ভয়াবহতা দেখে গিয়েছিলাম, আরও তোলপাড় চলেছে। তবে উন্মত্ত জনতা হাসপাতালে আর নেই। ফোর্স বেড়েছে, পুলিশ হাসপাতাল দখল নিয়েছে। তবে ইট, পাথর, কাচের বোতল তখনও বাইরে থেকে ছোড়া হচ্ছে। যদিও পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে তখন।
এরপরই সিপি, অ্যাডিশনাল সিপিরা এলেন। আমার একটাই প্রশ্ন পুলিশ আর মিডিয়া যদি টার্গেট হয়, তবে ডাক্তারদের কেন মারা হল। এরা কারা? এদের উদ্দেশ্যটাই বা কী ছিল? তিলোত্তমার বিচারই যদি চাইত, তাহলে হাসপাতাল ভাঙচুর করতে হল কেন? আমি তাদের বক্তব্যও নিয়েছি। তারা কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের পতাকা নিয়ে ছিলেন না। বরং মদ্যপ ছিলেন। ছেলে, মেয়ে কাউকে ছাড়েনি ওরা।